পরদিনও ফিরলো না খোকাভাই। সেজোচাচাও কোনো খবর নিলো কি নিলোনা কিছুতেই জেনেও উঠতে পারলাম না আমি। তবে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছিলো তখন। পাত্রপক্ষ আর দেরী করতে পারবেন না। পাত্রের বাবার শরীর ভালো না। হার্টের পেশেন্ট তিনি। এই এখন তখন যায় যায় অবস্থা। তাই বিয়েতেও তড়িঘড়ি ছিলো। দু'সপ্তাহ সময় সাবাস্ত হলো পাত্র এবং পাত্রী দু'পক্ষকেই বিয়ের প্রস্তুতি নেবার জন্য।
এই বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ি চুনকাম করানো হলো। সারাই করা হলো যত পুরাতন ভাঙ্গা-চোরা আসবাব, দরজা জানালা। হাড়ি পাতিল ডেক থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটা মানুষের বিয়ে গায়ে হলুদ বৌভাত প্রতিটা অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা পোশাক আষাকের ব্যবস্থার আয়োজন শুরু হলো। চারিদিকে হই হই রই রই ব্যপার।এই বিয়ে উপলক্ষে এই সাজ সাজ রব শুধু এ বাড়িতেই সীমাবদ্ধ রইলো না সারা পাড়াই যেন মেতে উঠলো এই বিয়ের অনুষ্ঠানে। এর আগেও এ বাড়িতে বিয়ে হয়েছে কিন্তু এত আনন্দ উৎসব আর কোনো বিয়েতে করা হয়নি কখনও।
বিয়ে উপলক্ষে দূর দুরান্ত থেকে ধেয়ে এলেন নানা আত্মীয় পরিজন। মীরা আপাও এলেন। তার কোলে ফুটফুটে এক ছেলে। এত্ত সুন্দর বাচ্চাটা ঠিক দেবশিশুর মত দেখতে। কি মিষ্টি করে হাসে। সবাই তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলো। কে কার আগে কোলে নেবে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেলো। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তাকে দেখে। মনে হলো অমন আরেকটি নিস্পাপ শিশু নিঃশব্দে শুয়ে আছে এ বাড়ির পেছনদিকের বাগানের মাটির নীচে আস্তাকুড়ের কাছে। যাকে গলা টিপে হত্যা করেছে এ বাড়িরই কিছু নিষ্ঠুর মানুষজনেরাই। আমার মনে প্রশ্ন এলো আচ্ছা মীরা আপারও কি ওর কথা মনে পড়ে? মীরা আপার বাচ্চাটার নাম তূর্য্য। আচ্ছা বেঁচে থাকলে ঐ বাচ্চাটার নাম কি হত?
নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমার মাথায়। এই বিয়ে উপলক্ষে আমার ৩ ফুপু এ বাড়িতে এসে জাকিয়ে বসেছেন। তাদের হম্বিতম্বি হাকডাকে সারা বাড়ি উন্মাতাল। পুরো বাড়ি জমজমাট এবং সোরগোল এ মাতোয়ারা। নানানজন নানান উপদেশ দিচ্ছেন। পাড়া পড়শী এমনকি বাঁধা ভিক্ষুকগুলো পর্যন্ত নানান আবদারে মুখর হয়েছেন। দাদীমা কাউকেই ফেরাচ্ছেন না। আমি আমার ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি সাদা ধপধপে শাড়ি পরা নাকে সাদা রং তিলক কাটা হিন্দু একজন মহিলাকে। যিনি বাড়ির খিড়কী দূয়ারে এসে তার সাদা ধপধপে শাঁখটা মুখে নিয়ে হাক দিতেন। মহিলা কথা বলতে পারতেন মা। প্রতি মঙ্গলবার আসতেন ঐ মহিলা। কিছু চাল কোচার খুঁটে বেঁধে নিয়ে ফিরে যেতেন উনি। কালো কুচকুচে মসৃন তেল পিছলে পড়া ঐ মুখে নাকের উপর ওমন নক্সাদার সাদা তিলক ছোট থেকেই ছিলো আমার কৌতুহলের উৎস! সেই মহিলাও এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি হাসি মুখে রসিকতায় অভিনয় করে বুঝিয়ে দিলেন তারও একখানা রাঙ্গা চেলি আর শাড়ি চাই আমার বিয়ে উপলক্ষে। সেই শাড়ি পরে তিনি আবারও শ্বশুরবাড়ি যাবেন।
এছাড়াও আমাদের বাড়িতে আল্লাহর ত্রিশ দিনের বাঁধা ক্রাচে করে আসা এক খোঁড়া ভিক্ষুক আলী হোসেন সেও নতুন কাপড়ের বায়না ধরলো। আলী হোসেনের ক্রাচটা ছিলো ট্রায়াঙ্গেল এক তেরছা কাঠের টুকরো। উপরের দিকটা মলিন কাপড় মোটা করে জড়িয়ে রাখা। মনে হয় হাতের ভরে যেন কষ্ট না হয় তাই সে ব্যবস্থা ছিলো। ছেলেবেলা থেকেই সৌন্দর্য্য বিলাসী ছিলাম আমি। ঐ মলিন কাপড় জড়ানো অংশটুকু ক্রাচের সৌন্দর্য্য কমিয়ে দিয়েছিলো বলেই আমার মনে হত। একেই হয়ত বলে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ! উনি হাঁটতে পারতেন না ক্রাচ ছাড়া আর আমি দেখতাম তার ক্রাচের সৌন্দর্য্য! এছাড়াও মাখনওয়ালা, মাছ ওয়ালা, ড্রেইন সাফ করা মেথরানী সকলেরই দাবী গরীব বলে তাদেরকে ঠকানো যাবে না তাদেরও চাই ষোল আনা। এ বাড়িতে এমন বিয়ে এমন উৎসব মুখর পরিবেশ আগে কেউ কখনও দেখেনি। সারাবাড়ি গমগম করলো পুরো দুসপ্তাহ জুড়েই।
বিয়েবাড়ি উপলক্ষে আসা মানুষগুলো শুধু আনন্দেই ছিলো না। এরই মাঝে চলছিলো মনোমালিন্য ঝগড়াঝাটি মান অভিমান এবং হিংসা বিদ্বেষও। পুরো বাড়িটাই যেন হয়ে উঠেছিলো এক বাস্তব জীবনের রঙ্গমঞ্চ! বড়ফুপা হঠাৎ সেদিন রাগ করে চলেই যাচ্ছিলো। তার জন্য শোবার ব্যবস্থাটা তার বিশেষ পছন্দ হয়নি। তার রুমের ফ্যান নাকি সারারাত কটকট কটকট শব্দ করে তার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি এ বাড়ির বড় জামাই অথচ এতটুকু চিন্তা নেই কারো? অনেক কষ্টে তাকে বাবা আর চাচারা হাতে পায়ে ধরে মান ভাঙ্গালেন। সেদিন আবার মেজোফুপুর নাকি সোনার চেইন হারিয়ে গেলো। এই নিয়ে তিনিও বাড়ি মাথায় করলেন। কে চুরি করলো? কেনো করলো? কিভাবে করলো। তারস্বরের চিল্লানীতে সেদিন বাড়িতে কাকচিল বসতে পারলো না। সেজোচাচা গিয়ে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক ধমক দিতেই শুরু হলো তার প্রলয়ঙ্কারী কান্না। এতদিন পর বাড়িতে এসে তার কোনো কদর নেই। তারই বাবার বাড়ি সেই বাড়িতেই খাচ্ছেন বসে তার সহদরেরা অথচ এতটুকু সন্মান তাদের কাছে তিনি কি আশা করতে পারেন না!!!
শত শত নাটক সিনেমা চলচিত্র বয়ে যেতে থাকে এই বিয়েবাড়ির হট্টগোল ঘিরে। এরই মাঝে হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় মীরা আপা নাকি বাগানের অন্ধকার কোনে লুকিয়ে কথা বলছিলো আর কাঁদছিলো পাশের বাড়ির নিখিলের সাথে। এই নিয়ে চাপা উত্তেজনা ওঠে। দাদীমার কাছে হিড় হিড় করে কান ধরে টেনে আনেন সেজোচাচী মীরা আপাকে। ঘরের দরজায় খিল তুলে দেওয়া হয়। ঐ ঘরে তখন মীরা আপা, সেজোচাচী আর দাদী। আমি দাদীর বিছানাতেই লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলাম। আমাকে পাত্তা না দিয়েই সেজোচাচী মীরাআপাকে টেনে এনে ফেলেন দাদীর পায়ের কাছে। মীরা আপা অঝর ধারায় কাঁদছিলো। সেজোচাচী, দাদীমাকে বলেন, দেখেন এই কূলটা অলক্ষী মেয়ের কীর্তি। এত কষ্ট করে ধরে বেঁধে এক দেবতার মত ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম তবুও এখনও তার নিখিল প্রীতি যায় না! বিস্ময় ঝরে পড়ছিলো সেজোচাচীর মুখে মেয়ের এমন দুঃসাহস দেখে। মীরা আপা মেঝের উপর বসে নিশব্দে কাঁদছিলেন। চাচী তার মাথায় এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
- বল বল কি বলছিলো ঐ মুদি দোকানদারের বাচ্চাটা, আস্ত ছোটলোকটা তোকে? কি ওর সাথে পালিয়ে যাবার বুদ্ধি করেছিলি তাইনা! কত্ত বড় সাহস তোর! অবাক হয়ে যাই আমি। বল বল কি বুদ্ধি করছিলি ওর সাথে?
মীরা আপা চোখ মুছে কড়া চোখে তাকালো চাচীর দিকে তারপর বললো,
- পালানোর বুদ্ধি করিনি। পালিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছেও নেই আর আমার তবে যে বাচ্চাটাকে খুন করেছো তোমরা, মাটি চাপা দিয়ে রেখেছো আস্তাকুড়ের পাশে। সেইখান থেকে এক মুঠো মাটি চায় নিখিল। আর কিছুই চাইবার নেই তার...... কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মীরা আপা কিন্তু মীরা আপার কথা শেষ হবার আগেই চাচী আরও কয়েক প্রস্ত চড় থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন মীরা আপাকে। দাদীমা চাচীকে থামায়। মীরা আপাকে টেনে উঠায় বিছানার উপর, পাশে বসিয়ে মীরা আপার কান্না ভেজা মুখটা বুকে চেপে ধরেন দাদীমা। দাদীর বুকে মুখ লুকিয়ে অঝর ধারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মীরা আপা।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার! এত দিনের অজানা প্রশ্নের উত্তর পাই আমি। সেদিনের সেই গর্হিত কাজের পাপী যে নিখিল তা আমার বুঝতে বাকী থাকে না। সেদিন থেকে কালো কুচকুচে মায়াবী চেহারার নিখিল আমার কাছে কৃষ্ণ হয়ে ওঠে আর ধপধপে চেহারার মীরা আপা হয়ে যায় রাঁধা। নিখিল ও পাড়ার মুদী দোকানের মালিকের ছেলে ছিলো। মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার পর বসতো সে তার বাবার দোকানে আর বসে বসে বাঁজাতো তার আশ্চর্য্য মোহময় বাঁশী। সেই বাঁশির সূর শুনে দাদীমাও মাঝে মাঝে বলতো। বাপরে! কি সুন্দর বাঁশি বাঁজায় ছেলেটা। আমার দাদুবাড়ির ঐ বিশাল ভবন আর চারপাশে অজস্র গাছপালা নিয়ে বিশবিঘা জমির উপর ছিলো। তার পাশেই ছিলো নিখিলদের বাড়ি। সে আমাদের প্রতিবেশী ছিলো। কিন্তু আমি যত দূর জানি শান্ত স্বভাবের মীরা আপা কখনও ঐ মুদী দোকানেও যায়নি বা ওদের বাড়িতেও না তবুও কি করে নিখিলের সাথে তার গোপনে এই প্রনয় হয়েছিলো সে আজও এক রহস্য রয়ে গেছে আমার কাছে।
বিয়ে উপলক্ষ্যে এ বাড়ির লোকজন আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি কাজের লোকজন সকলের জন্যই শাড়ি কাপড় অর্ডার দেওয়া হলো। ঢাকার বেনারসী পল্লীতে অর্ডার দেওয়া হলো সকল চাচীদের জন্য একই রকম সবুজ পাড়ের ঘি কালারের মিরপুর কাতান। মেয়েদের জন্যও সালোয়ার কামিজ ফ্রক, জুতা, গয়না আনা হলো। ছেলেদের জন্যও নতুন সব পোশাকের আয়োজন করা হলো। আমার অত টুকুন জীবনে আমি আর কখনও অমন ঈদের চাইতেও বড় উৎসব দেখিনি। আমি অবাক চেয়ে দেখি! আর দেখি।
দাদীমা তার গয়নার বাক্স খুলে বের করে দিলেন সাতনরী সীতাহার আর বাজুবন্দ।এটা আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে তার উপহার। আমি মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। মা তার সকল গয়নাই আমাকে দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু দাদীমা বাঁধা দিলেন। বললেন নীরুর সব গয়না নতুন করে গড়িয়ে দেওয়া হবে। নারায়ন স্বর্ণকারকে খবর দাও। নারায়ন স্বর্ণকার! এই মানুষটি আমার কাছে আরেক শিল্পের যাদুকর ছিলেন। সেই ছোট্টবেলা থেকেই মা চাচীদের গয়না গড়াতে আসতেন তিনি বাড়িতেই। যে কোনো গয়নাই তিনি নিয়ে আসতেন একটা ছোট কারুকার্য্য মন্ডিত সেগুন কাঁঠের বাক্সে করে। আজকাল আমরা বলি জ্যুয়েলারী বক্স তখন সেটার নাম জানতাম গহনার বাক্স। নায়ায়ন স্বর্ণকার অতি যত্নে ঐ বাক্স থেকে বের করে আনতেন তার গহনা । বেগুনী রং এর জিলজিলে এক কাগজে করে মুড়িয়ে আনতেন গহনা তিনি। সেই কাগজখানি অতি যতনে মেলে ধরতেন সকলের সামনে। চকচকে সোনা রং গয়নাগুলো ঝিকিমিকি হাসতো তার গাঢ় বেগুনী কাগজের ভাজে। তার বাক্সে থাকতো আরও আরও কিছু বিস্ময়! ছোট্ট একটা সোনা মাপা রুপোর দাড়িপাল্লা আর তার ছোট্ট ছোট্ট বাটখারাগুলির সাথে সাথে কিছু কুঁচফল। সেই কুঁচফল চাইতাম আমরা ছোটরা। উনি আমাদের জ্বালায় দু একটা কুঁচফল আমাদের হাতে তুলে দিতেন।
সেই কুঁচফলের গাছ দেখেছিলাম আমি একবার আমার জীবনে। বিশালদেহী এক গাছের নীচে পড়ে ছিলো অনেক অনেক কুঁচফল। কোনো কোনো কুঁচফল মনে হয় পায়ের চাপে ফেটেও গিয়েছিলো যা দেখে আমার বড় খারাপ লেগেছিলো। আজকাল ছোটদের বিদেশী গল্পের বই এ আঁকা লাল রং লেডিবার্ডগুলো দেখলে আমার ঐ কুঁচফলের কথা মনে পড়ে। সে যাইহোক নারায়ন স্বর্ণকারকে দেখে দাদীমা বললেন এক্কেবারে নতুন কোনো প্যাটার্ণের গয়না দেখাতে। নারায়ন স্বর্ণকার একে একে বের করে ধরলেন কান পাশা, ঝুমকা, চেইন পাশা, চেইন ঝুমকা, নয় লহরী, বারো লহরী কঙ্কন, বিছাহার, নবরত্নের আংটি আরও কত কত রকমের যে গহনা পত্র! সব গয়না পছন্দ করলেন দাদীমা নিজে। আমাকে একটা একটা গহনা পরিয়ে পরখ করে দেখছিলেন কোনটায় কেমন মানায়। সবাই ঘিরে বসেছিলো আমাকে আর দাদীমাকে। দাদীমা বলছিলেন আগের দিনে নাকি এক পাল্লায় কণে আরেক পাল্লায় গহনা মেপে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হ্ত! কি আশ্চর্য্য কথা রে বাবা! তবে কেনো কবি লিখলো, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নয়!
এরপর আসে শাড়িওয়ালা, চুড়িওয়ালা। কয়টা শাড়ি, কয়টা ব্লাউজ পাত্রপক্ষের জন্য কি কি দিতে হবে। পাত্রের জন্য স্পেশাল সদাই আয়োজন। ডালা কুলা সাজানো, অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। সব চাচারা চাচীরা মুখর হয়ে উঠলো। আমাদের বাড়িটা বদলে গিয়ে হয়ে উঠলো যেন এক মুক্তমঞ্চের আলোছায়া অভিনীত নাটকের দৃশ্য। দৃশ্যপটগুলো বদলে বদলে যাচ্ছিলো। এত এত অতিথি অভ্যাগত, এত এত আয়োজন তবুও আমার মন কেঁদে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায় কোথায় যে তা আমি নিজেও জানিনা। মাথার ভেতর এক অদ্ভূত শূন্যতা, এক ভোতা অনুভূতি। আমার চারিদিকে কি ঘটছে কি হচ্ছে ঠিক বুঝিনা আমি। শুধু অবাক চোখে দেখে যাই।
যাইহোক, ক্রমে কেটে যায় সেই ঘটনাবহুল দুই সপ্তাহ। খোকাভাই ফেরে না। একেবারেই যেন লা পাত্তা হয়ে গেছে। কেউ তার কোনো খবরও নেয় না। বড় চাচীমা খুব নির্বিকার থাকে। মাঝে মাঝেই আমার ইচ্ছা হয় তাকে জিগাসা করি খোকাভায়ের কথা। মনে হয় তাকে জিগাসা করি, সবাই না হয় ভুলে গেছে, তুমি কি করে মা হয়ে ভুলে থাকতে পারলে খোকাভাইকে! কিন্তু আর বলা হয় না। গায়ে হলুদের আগের দিন দুপুরে আমি চুপি চুপি সিড়ি দিয়ে উঠে আসি আমার প্রিয় সেই ছাঁদের ঘরটিতে। খোকাভায়ের ঘরে সব জিনিস পত্র, খোকাভায়ের জামা কাপড়, টেবিল চেয়ার, বিছানা এলোমেলো পড়ে আছে। ধুলি ধুসরিত। কেউ বুঝি একটা বারের জন্যও উঁকিও দেয়নি এই ঘরটিতে। চারিদিকে এত লোকজন, এত আনাগোনা কারো কি একটাবার নজরেও পড়েনি এই ছাঁদের ঘরটাকে?
আমি কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি ঘরের ঠিক মধ্যিখানে! আমার চোখে জল ভরে আসে। চারিদিকে কত স্মৃৃতি, কত কথা। ঐ তো সেই জানালা যেখানে প্রথম আমার ঠোঁট ছুঁইয়েছিলো আরেক জোড়া ঠোঁটে। সেই প্রথম চুম্বনের স্মৃতিটি স্থির চিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐ জানালার পাশেই। জানালার বাইরে উঁকি দিচ্ছে সেই একাকী মলিন বেদনা বিধুর তমাল গাছ। নিঃস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমারই মতন। মেঝের এক কোনে সেই ডানা ভাঙ্গা ঘুড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বিছানার পাশে এক পাটি ঘরে পরার চটি। চেয়ে আছে আমারই দিকে। জানিনা আরেক পাটি কোথায় গেছে? চারিদিকের সব কিছুই আজ বিষন্ন বদনে চেয়ে আছে যেন আমারই দিকে।
আমি খোকাভায়ের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আঁচলের তলা থেকে বের করে আনি নির্মলেন্দু গুণের একখানি কবিতার বই " নির্বাচিত ১০০ কবিতা"। আমার নিজের জমানো টাকায় কেনা। খোকাভায়ের জন্মদিনে দেবো বলে কিনেছিলাম। টেবিলের উপর পড়ে থাকা খোকাভায়েরই ফেলে যাওয়া একটি কলম টেনে নিয়ে তাতে লিখি- খোকাভাই ভালো থেকো..... সুন্দর থেকো....
নিরুপমা
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ২:১২