নৌকা চলতেই খোকাভাই খানিক দূরে গলুই এর উপর বসে হাতের আড়ালে হাওয়া আটকে সিগারেট ধরালো। তারপর পোড়া দিয়াশলাই কাঁঠিটা ছুড়ে ফেললো পানিতে। কাঁঠিটা পানির তালে তালে দোল খেয়ে এগিয়ে চললো আমাদের সাথে সাথে কিছুদূর। সেদিক থেকে চোখ ফেরাতেই দূরে ভেসে আসা একটা ছোট সাদা পাল তোলা নৌকায় চোখ আটকালো আমার।ওমন পাল তোলা নৌকা এত কাছ থেকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। আমার মনের মাঝে জেগে উঠলো গুনগুন, অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই ওমন তরনী বাওয়া। আসলেই আমি ওমন তরনী বাওয়া আমার এত টুকু জীবনে আর কখনই দেখিনি। তবে ঐ অমল ধবল গানের পালের সাথে সেই ছোট নাওটির মলিন ধবল রঙ্গের দীনতা রবিঠাকুরের ঐ গানটির সাথে ঠিক মিলছিলো না আমার সেইটুকু জীবনের রুপকথা রঙ্গিন কল্পনার সাথে।
মাঝিটার মনে অনেক প্রশ্ন ছিলো। সে নৌকা বাইতে বাইতেই আবারও জিগাসা করলো,
- মনিরা আপনেরা কোন বাড়ির ? তালুকদার বাড়ির নাকি চাকলাদার বাড়ির?
খোকাভাই নিরুত্তর রইলো আর আমি তার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে তারে গিলে ফেলবো নাকি হাত দিয়েই ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দেবো ভাবছিলাম। যাইহোক সব রাগ সামলে ওকেই জিগাসা করলাম,
- তুমি কোন বাড়ির? তোমার গ্রাম কই?
- আমার গেরাম কুমোরখালি? মনিরা তুমরা কি বাড়ি ছাইড়ে পলাইসো নাহি? দেইহো আমারে আবার বিপদে ফেলাইও না। চাকলাদার বাড়ি তালুকদার বাড়ির মানুষ হলি পরে আমার আর জেবন নিয়ে বাঁচা লাগবি নেনে। দয়া কইরে আমারে বিপদে ফেলাইওনা মা জননী।
আমার তার কথা শুনে হাসি পেলো। মাথায় শয়তানি বুদ্ধিও জাগলো। বললাম আমাদের বাড়ি নেই। আমরা রাজশাহী থেকে এসছি। হোটেলে উঠেছি। সেই কথা শুনে ঐ লোকের চোখ কপালে?
-উ উ তাই বলো! তালি পরে তুমরা হছো গিয়ে ভীনদেশী, তুমরা হছো গিয়ে ভাই বোন ঠিক না? আমি তো ভাবছিলাম পলানি কেস। যাক যাক শোনো ঘাটে নাইমে পরে এই ঘাটের বিখ্যাত মিষ্টি খাওয়াবানে। তো তুমরা শহর থেইকে আসছো তো যাচ্ছো কনে? আমার তখন মনে হচ্ছিলো এই লোক পুলিশের গোয়েন্দা বা টিকটিকি নাকি। না হলেও সে এই কাজ করলে অনেক ভালো করতো জীবনে। খোকাভাই উত্তর দিলো। প্রদীপ ঘোষেদের বাড়ি যাচ্ছি আমরা।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম প্রদীপ ঘোষ আবার কে? সে যাইহোক জলে ভেসে আসছিলো কচুরীপানারা ও তার অপরূপ মায়াময় বেগুনী গোলাপী ফুল। কচুরীপানার ফুল এত সুন্দর আগে বুঝিনি আমি। যেন এক ঝাঁক জলের রাজকন্যারা, দল বেঁধে ভাসছে সকলে হাত ধরাধরি করে ঢেউ এর তালে তালে। কচুরীপানার ফুলের উপরে উড়ছিলো কয়েকটা মৌমাছি। তাদের গায়ের কালো হলুদ ডোরা কাটা নক্সা আর ঐ বেগুনী গোলাপী ফুলগুলো কি যে এক অবাক সৌন্দর্য্য! দাদীমার ঘরের দেওয়ালে তার হাতের বোনা অনেক সেলাই কাঁচ আর কাঁঠের ফ্রেমে বন্দী করে ঝোলানো ছিলো। সেখানেও ছিলো জলে ভাসা পদ্ম আর শাপলার ছবি। আচ্ছা কচুরীপানার ফুলও তো কত্ত সুন্দর তাকে কেউ আঁকে না কেনো? কেনো সে এত সুন্দরী হয়েও সকলের অবহেলার! পদ্ম বা শাপলার চাইতে সেও তো কম নয়! এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আজ হয়ত পাবো কিন্তু খুঁজতে চাইনা আমি আর। আমি আমার সেই কৈশোর পেরুনো তারুন্যে দেখা কচুরীপানার ফুলের সেই অপরূপা সৌন্দর্য্য নিয়েই সারাটা জীবন থাকতে চাই।
আকাশের উঁচুতে উড়ছিলো ছোট্ট ছোট্ট চাতক পাখি। মাঝিটা তাই দেখে বললো, ঈশানকোনে মেঘ জমতিছে। মনিরা আইজকে কিন্ত দেওয়া হবি। তুমরা বাপু বেশি দেরী কইরো না কলাম, তাহলি পরে আমি নিয়ে যাতি পারবো নানে। খোকাভায়ের এইসব কথায় কান বা মন ছিলো না। খোকাভাই কোনো কথাও বলছিলো না। অনেক উপরে আকাশে চাতক পাখিদের উড়াউড়ির সাথে সাথে অনেক নীচের আকাশে নদীর উপর উড়ছিলো কিছু ফড়িং। আমি আজও জানিনা ফুলের বনে থাকবে প্রজাপতি, মৌমাছি আর ফড়িং এরা কিন্তু ঐ মাঝনদীর বুকে উড়ে উড়ে ফড়িংরা কি খুঁজছিলো সেদিন! যাইহোক ক্ষীন স্রোতধারার সেই নদী তীরে কয়েক মিনিটেই বুঝি চলে এলো আমাদের নৌকাটা। ঠিক তার আগে আগে নদীর জলে ছোঁ মেরে উপরে উড়ে গিয়ে এক উঁচু গাছের ডালে বসলো এক অদ্ভুত সুন্দর পাখি। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর পাখিটিই সেই মাছরাঙ্গা পাখিটি। সৃষ্টিকর্তা মনে হয় এই পাখিটাকে বানিয়ে তার প্রিয় রংগুলো দিয়ে বসে বসে একে একে এঁকেছেন তার চোখ মুখ গলা ও বর্নীল পাখা দুটি। আমি হা করে চেয়ে রইলাম। মাঝি হাঁক ছাড়লো। আমরা তো এইসে গেলাম। নামো ইবার তুমরা। বেড়ানি শেষ হলি পরে তাড়াতাড়ি ফিরে আইসো। দিন কাল খুব একটা ভালো না কলাম।
আমরা পাড়ে নামলাম বটে তবে তখন নদীর ঐ পাড় জুড়ে বসেছিলো বাজার। সেদিন মনে হয় হাঁট ছিলো। নানা রকম শাক সব্জী ফলমূল গামছা স্যান্ডেলের মত নানা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পসরা সাঁজিয়ে মাটির উপরেই চট বা মাদুর এসব পেতে বসেছিলেন পসারীরা। অনেকেই এই গ্রামে আগত দুই অচেনা মানব মানবীকে দেখে থমকে তাকালো। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে এসে হাজির হলো খোকাভায়ের সেই প্রদীপ। প্রদীপ আমাদেরকে নিয়ে একটা বেড়ার ছাউনি দেওয়া মিষ্টির দোকানে বসালো। সেই দোকানের মেঝে মাটির। মানে মাটির উপরেই তিনদিকে বেড়া দিয়ে মনে হয় বানানো হয়েছিলো ঐ মিষ্টির দোকানটা। সামনে বড় বড় কালো কুচকুচে কড়াই এর মধ্যে রসগোল্লা পান্তুয়া ভাসছিলো এক কড়াই রসের মাঝে। আরেক কড়াইতে ভেঁজে তুলছিলো দোকানী কমলা রঙ্গের লবঙ্গ লতিকা।
লবঙ্গ লতিকা! আহা আমি জানিনা পৃথিবীতে আর কোনো মিষ্টির এত সুন্দর নাম আছে কিনা। যেমনই তার নাম তেমনই তার কমলা চেহারা। এই মিষ্টি আমাদের বাড়িতেও বানানো হত। সুনিপুন দক্ষতায় আমার দাদীমা বানাতেন এই মিষ্টি। সবচেয়ে মজার অংশটুকুই ছিলো লবঙ্গ লতিকার শেষ ভাঁজটা দেবার পরে শেষে এসে মুখটা লবঙ্গ দিয়ে আটকে দিতে হয়। তাই নাকি এর নাম লবঙ্গ লতিকা। এই লবঙ্গ লতিকা দোকানে ওমন কমলা জাফরান রঙ্গের পাওয়া গেলেও আমাদের বাড়িরটাতে কোনো রঙ্গ মেশানো হত না তাই সে সব ছিলো একটু অন্য রকম। কিছুটা লালচে রঙ্গের। ভাজার কারণেই ওমন রং হত কিন্তু দোকানীদের লবঙ্গ লতিকা ছিলো মন হরণ করা কমলা রঙ। যাইহোক প্রদীপ সেই লবঙ্গ লতিকাসহ যত রকম মিষ্টি ছিলো দোকানে সবই একটা বড় কাসার থালাতে করে নিয়ে আসলো আমাদের জন্য। সেখানে গরম কেবলই ভেঁজে তোলা গজাও ছিলো। অত মিষ্টি আমরা খেতে পারিনি বটে তবুও বন্ধুত্বের আপ্যায়নে প্রদীপ সেদিন ওমন নৈবদ্য সাজিয়ে দিলো আমাদের জন্য।
ঐ দোকানের কাঁঠের বেঞ্চি আর নড়বড়ে টেবিলে বসে ছিলাম যখন আমরা। সেখানেও হাজির হয়েছিলো কয়েকটা ছোট ছোট আদুল গায়ের ছেলেমেয়েরা। ওদের হাতে ছিলো কাঁঠি আইস্ক্রিম। হাত বেয়ে নামছিলো সেই মিষ্টি বরফ গলা লাল কমলা রঙের পানি। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিলো না তাদের। ওরা দেখছিলো আমাদেরকেই। যেন আজব গ্রহের দুইটি অদ্ভূত প্রাণী আমরা। প্রদীপ তার বাড়িতে নিয়ে গেলো আমাদেরকে। কাঁচামাটির বাড়িটা। সেদিন ওদের বাড়ির সকলেই গিয়েছিলো পাশের গ্রামের কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে। প্রদীপেরও সেদিন রাতে সেই বিয়েতে যোগ দেবার কথা। শুধু খোকাভাই বলেছে আমরা আসবো তাই সে থেকে গিয়েছিলো। প্রদীপ এতগুলো মিষ্টি খাইয়ে আনার পরেও বাড়িতে এনে আমাদেরকে কি খাওয়াবে, কোথায় বসাবে সেই চিন্তায় ব্যতিব্যাস্ত হয়ে উঠলো। বাড়িতে কেউ না থাকায় সে কিছুই না পেয়ে সামনে এনে দিলো একটা ছোট ঝাকায় করে এক গাদা পানিফল। সেই পানিফল খেতে দিয়ে এটাও বললো যে আমরা যেন না ভাবি এটাই দুপুরের খানা। সে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার আয়োজন করেছে। আমার খুব লজ্জা লাগছিলো। আমার আবদারে মানে আমার জ্বালায় খোকাভাই এই প্রদীপকেও জ্বালিয়ে মারতে বাধ্য হয়েছে। আমরা উঠোনে বসে ছিলাম। উঠোনের ধারে একটা পোলোর ভেতরে ঢাকা দেওয়া ছিলো মা মুরগী আর তার সদ্য প্রস্ফুটিত ছানাপোনা। কি সুন্দর নরম তুলতুলে হলুদ কালো আর সাদা রং ছানাগুলো। যেন ঠিক তুলোর বল। বাড়ির চালে এক ঝাঁক পায়রা। উড়ে উড়ে বসছিলো। কোনো কোনো কপোত কপোোতিরা মত্ত ছিলো বাক বাকুম রবে।
সে যাইহোক প্রদীপ তার ঘর খুলে দিয়ে চলে গেলো। বললো খুব শিঘ্রিই সে দুপুরের খানা নিয়ে ফিরবে। প্রদীপ চলে যেতে খোকাভাই মুখ খুললো। বললো,
- ভয় পাচ্ছিস না ?
আমি তো সে কথা শুনে অবাক! এহ রে খোকাভাইকে আবার কিসের ভয়! তাই নির্ভিক চিত্তে বললাম,
- কিসের ভয়!
খোকাভাই মনে হয় হতাশ হলো। আমার নির্ভিক চিত্তের বলিষ্ঠ কন্ঠের উত্তর শুনে হাসতে লাগলো।
আমি তখন ওদের উঠোনের ধারে ছোট করে চালাঘরের মত করে বাঁধা রান্নাঘর, কলতলা, কলাগাছ আবার কলাবতী ফুলগাছ দেখতে লাগলাম পরম আগ্রহে। তুলসী গাছের নীচে মনে হয় ওরা পূজো দিত রোজ সন্ধ্যায়। যাইহোক এসব দেখে দেখে আমি ও বাড়ির লোকজনদেরকে এবং ওদের জীবন যাত্রার স্টাইলটাকে ঠিক ঠাক বুঝার চেষ্টা করছিলাম। খোকাভাই বিরক্ত হয়ে বললো,
- কি দেখিস! মানুষের হাড়ির খবর নেবার স্বভাব কেনো তোর?
সেই কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ কারণ সত্যিই আমি রান্নাঘরে তাদের তাকের উপর সাজানো থরে থরে ওমন ঝা চকচকে বড় বড় হাড়ি পাতিল দেখে অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম।
- প্রদীপ ওর ঘর খুলে দিয়ে গিয়েছিলো। সেই ঘরের দরজায় দাড়ালেই সামনের দেওয়ালে ঝোলানো ছিলো এক প্রকান্ড আয়না। এ বাড়ির আর সব আসবাবের সাথে এই আয়নাটা যেমন যায় না তেমনই যায় না ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকান্ড কারুকার্য্য খচিত পালঙ্কটা। আমি দরজায় দু হাত দিয়ে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হা করে দেখছিলাম। খোকাভাই আমার পেছনে দাঁড়ালো। মধ্যদুপুরের আলোছায়ার ঐ মাটির ঘরটির হিম হিম মায়ার ঐ প্রকান্ড আরশীর মাঝে ফুটে উঠলো আমাদের দুজনের যুগল ছবি। যেন এক ফ্রেমে বন্দি অতি সুন্দর অতি অপার্থীব স্বর্গীয় যুগল আমরা। খোকাভাই আমার ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আমি হিম হয়ে গেলাম।
গ্রামের কাঁচা মাটির ঐ নিকানো ঘরের মেঝেতে আমার পায়ের ছোট বাটন হিলের বাটনটা দেবে দেবে ছোট ছোট গর্ত হয়ে যাচ্ছিলো।
বিকেলে যখন ফিরছিলাম আমরা তখন গাঁয়ের সেই বাজারটা আরও জমে উঠেছে। নারী পুরুষের ভীড়ে গম গম করছিলো বাজার। ছোট ছেলেমেয়েদের মাটির হাঁড়িকুড়ি, টেপা পুতুল থেকে শুরু করে কাগজের গিরগিটি শোলার পাখি। কি সব অত্যাশ্চর্য্য সুন্দর সব খেলনা পাতি। এর মাঝে জোড়াতালি দেওয়া রঙ্গিন কাপড় পরা সার্কাসের ক্লাউনের মত একজনকে ঘিরে খুব ভীড় জমেছিলো। আমরাও উঁকি দিতে দেখলাম নানা রকম কাঁচ নিয়ে বসেছেন সেই দোকানী। তাকে ঘিরেই ছেলে বুড়োর সেই ভীড়। খোকাভাই সেই পসারী থেকে কিনে নিলেন একটা অতি সুন্দর আতশ কাঁচ। আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোর জন্য আমার উপহার......
শুনেছি কাঁচ কাটা হীরের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু সেই কাঁচ কাটা আতশ কাঁচটির মূল্য হীরার থেকেও দামী হয়ে রইলো আমার কাছে সারাটা জীবন......
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:২৫