নাহ! বাবা মারা যাননি সেদিন। বাবার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছিলো এবং ডক্টরের কিছু ঔষধে সমস্যাটা খুব শীঘ্রই নিয়ন্ত্রনেও চলে আসে। বাবাকে নিয়মিত চেকআপ আর ঔষধ পত্র চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন ডক্টর। বলেন তেমন কিছু না বটে তবে বাবার খাদ্যাভ্যাস আর জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। আর সিগারেটটা ছেড়ে দিতে হবে একেবারে। আমাদের পরিবারে সবচাইতে বয়ঃবৃ্দ্ধ দাদুও কখনও এমন আচমকা অসুস্থ্য হয়ে পড়েননি। তাই আমরা একটু চমকেই গিয়েছিলাম। বাবার এমন আকস্মিক অসুস্থ্যতার কারণ হিসেবে আমার আজ যা মনে হয় তা হলো তার সাস্থ্য অসচেতনতা এবং অনিয়মানুবর্তিতা। বাবা ভীষন রিচ ফুড খেতেন। গরুর রেজালা, মাংস, পোলাউ, ঘি মাখন ছাড়া তার তেমন চলতো না সাথে ছিলো সিগারেটের নেশা। এসবই ছিলো সেদিনের সেই বিপদটির কারণ। এসব ঝুটঝামেলার মধ্য দিয়েই পরীক্ষা শেষ হলো আমার।
ভেবেছিলাম এত কিছুর মধ্যে মা নিশ্চয় সেই বিকালের ঘটনাটা ভুলেই গেছেন। কিন্তু মা আর যাই ভুলুক। আমার ব্যপারে আসলে কিছুই ভুলতেন না। তার প্রচন্ড আত্ম অহমিকা ও সবে ধন নীলমনি আমাকে কঠোর শাসন বারণে রেখে নিজের মনের সকল অপ্রাপ্তির সাধ আহলাদ সে সব আমার পছন্দ অপছন্দের তোয়াক্কা না করে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। এই কারনেই ঐ ভয়ংকর ভুল করা বয়সের আমি যেন তার পছন্দের বাইরে এক পাও না বাড়াতে পারি সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। আর সেদিনের ঘটনার যথা সময়ে বিচার না করতে পেরে এবং বিচার ব্যবস্থার বিলম্বিকরণে মা নতুন বুদ্ধি আটলেন।
মা দাদুর কাছে, দাদীমার কাছে এবং বাবার কাছে তথা পুরো পরিবারের কাছেই কেঁদে কেটে একাকার করলেন। বললেন বাবার এই অবস্থা, কখন কি হয়! তার বড় ভয় হয় আমাকে নিয়ে। আর তাই আমাকে এখুনি বিয়ে দিয়ে দিতে চান। মা যতই আমাকে নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করুক না কেনো আমি ঠিকই বুঝেছিলাম তার মনের আসল অভিসন্ধিটা। যাইহোক মায়ের এই এহেন আবদারে কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছিলো না কিন্তু আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! কারণ আমি মাকে জানি আর আমি কিছুতেই এখন বিয়ে করতে চাই না। কিন্তু মাকে সে কথা বলবো কি করে! বললেই তো উনি আমাকে সেদিনের কত ধানে কত চাল গুনতে বসিয়ে দেবেন। চিন্তায় আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে পড়লো।
খোকাভাইকে এ খবরটা জানালাম। আর অবাক হলাম এ সংবাদে খোকাভাই তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না বরং মনে হলো এ সংবাদ তার কানে ঢুকলোই না বা এ সংবাদটির কোনো গুরুত্বই নেই তার কাছে। আমি একটা জিনিস ইদানিং খেয়াল করেছি আজকাল খোকাভাইকে আমার বড় ভাবলেশহীন লাগে। মনে হয় তার কানে কিছু ঢুকছে না, কিছু বুঝছে না এমন। অনেক সময় ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগাতে হয়। চেয়ারে বসে থেকেও কেমন যেন আনমোনা হয়ে থাকে। খোকাভাই কি তবে সন্যাসী হয়ে গেলো নাকি! খোকাভায়ের মাঝে এই পরিবর্তনটা বাড়ির অন্য কেউ খেয়াল করেছিলো কিনা জানিনা তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম। অথবা খোকাভাই ঐ বয়সেও খুব জেনে গিয়েছিলো আমাদের এই সম্পর্কের কোনোই ভূত ভবিষ্যৎ নেই, তাই হয়ত নির্লিপ্ত হয়ে পড়ছিলো। জানিনা আমি, আসলে কিছুই জানতাম না তখন তবে তার কিছু একটা পরিবর্তন আমি ঠিকই বুঝতাম।
আর তার এই পরিবর্তনটা যে সেই তেরো দিনের অন্তর্ধানের কারনেই সেটাও বেশ বুঝতাম আমি। কিন্তু বারবার জিগাসা করা সত্বেও কোনোভাবেই আমি সে রহস্য উৎঘাটন করতে পারছিলাম না ঐ তেরোদিন ঠিক কোথায় ছিলো খোকাভাই। সেজচাচুও একটা বারের জন্যও সে কথা খোলাসা করেননি কারো কাছে শুধু বুঝেছিলাম সেদিনের পর থেকে সেজচাচুর কোনো এক অজ্ঞাত মায়া কাজ করছিলো খোকাভয়ের জন্য। ও বাড়িতে কেও কখনও খোকাভাইকে ভালোবাসেনি। সেও যে এ বাড়ির বড় ছেলের সন্তান কেউই সেটা মনেও রাখতে চায়নি। অসহায়া বড়চাচীমা ও বাড়ির পাকাপোক্ত রাঁধুনীতেই পরিনত হয়ে গিয়েছিলো আর তাই সবাই বিশেষ করে মেয়ে মহলে একটু কদরও পেয়েছিলো। বিনা পয়সার এমন উদয়স্ত খাঁটুনির অক্লান্ত পরিশ্রমী ঝি কোথায় পাবে তারা?
খোকাভায়ের দিকে কারো কোনো নজর ছিলো না বটে। সে খেলো কি না খেলো মরলো কি বাঁচলো কারো কিছুই যেত আসতোনা। আমার ধারনা কারো তাকে মনেই পড়তো না। তার খাবারও পৌছে দিয়ে আসতো রুস্তম তার ঘরে আর বড় চাচীমা তার দায়িত্বে থাকায় অন্তত খাবারের সমস্যাটুকু তার ছিলো না। কিন্তু ঐ তেরো দিন অন্তর্ধানের পরে হঠাৎ একদিন বিকেলে সেজচাচা একটা খুব সুন্দর নীল রং সাইকেল নিয়ে আসলেন। সাইকেলটার নাম ছিলো ফনিক্স। হা হা আমরা ফনিক্সই বলতাম এবং সেই সাইকেলটা তিনি খোকাভাইকে ডেকে দিয়ে বললেন, কাল থেকে তুমি এটা নিয়ে কলেজে যাবে বাবা!
আমি খুব অবাক হলাম! এই প্রথম এ বাড়িতে কেউ মনে হয় খোকাভাইকে বাবা সম্বোধন করে এইভাবে স্নেহময় সূরে কিছু বললো। শুধু বললোই না ওমন একটি দামী উপহারও দিলো!। সেখানে যারা ছিলেন তারা অবাক হলো কিনা জানিনা তবে বিরক্ত হলো কেউ কেউ। আমার মায়ের চেহারাখানা ছিলো, মানে মায়ের মুখের উপর এক অদৃশ্য আয়না থাকতো যেই আয়নায় আমি দেখতাম নানা দৃশ্যাবলী। সেই আয়নায় আবার রেডিও সেট করা থাকতো আর সেই রেডিও শুনতে পেতাম শুধুই আমি। সেই রেডিও এবং আয়নায় আমি দেখলাম মা মুখ বাঁকিয়ে বলছেন, আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। এই ধামড়া বুড়ো খোকাকে আদর করে উনি আবার নীল টুকটুক ( লাল টুকটুক হয় নীল কি হয় জানিনা কিন্তু সেই সাইকেলটার রং বড়ই মনোহর ছিলো তাই নীল টুকটুক লিখলাম আর কি) সাইকেল দিচ্ছেন। যত্তসব!!! লাই দিয়ে মাথায় উঠাচ্ছেন আমার সর্বনাশ করার জন্য! আর মায়ের সেই সর্বনাশটাই ছিলাম জলজ্যান্ত আমি!
যাইহোক এই এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো খোকাভায়ের সাথে এতগুলো দিন পরে এসে এ বাড়িতে কিন্তু খোকাভায়ের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। খোকাভাই মুখ নামিয়ে ছিলো যেন সে এই উপহারের যোগ্য নয় বা কোনো এক অপরাধী। সেজোচাচা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, খুব মন দিয়ে পড়ালেখা করো বাবা। তোমার মায়ের মনে কোনো কষ্ট দিও না। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। খোকাভাই হ্যাঁ না কিছুই বললো না। চুপচাপ সাইকেলটাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ পিংকু বাঁদরটা কোথা থেকে এসে সাইকেলের বেলটা ধরে ক্রিং ক্রিং করে মাথা ধরায় দিলো। খোকাভাই তাকেও কিছুই বললো না।
এর মাঝে শুরু হলো আরেক উৎপাত দাদুর কোন জনমের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার ছেলে শহরে পড়তে এলো। এই ছেলে নাকি এ বাড়িতে থেকেই পড়ালেখা চালাবেন। তো চালাক কোনো সমস্যা নেই। ওমন এ বাড়িতে আগেও অনেকেই এসেছে। আমার জন্মের পর থেকেই দেখছি এসব। কিন্তু এবারের সমস্যটা অন্যরকম ছিলো কারণ ঐ ছেলেরও থাকবার বন্দোবস্ত হলো খোকাভায়ের সাথেই মানে খোকাভায়ের ঐ ছাদের ঘরেই নাকি আরেকখানা চৌকি পেতে থাকতে দেওয়া হবে তাকে। শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। এ দেখছি দিনে দিনে বিপদের উপর বিপদ আসতে শুরু করলো জীবনে। এমন রাগ লাগছিলো আমার। কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না কিন্তু যত রকম বিপদই আসুক সকলই কাটিয়ে উঠবার ক্রিয়েটিভ আইডিয়ার অভাব ছিলো না আমার ছোটবেলা থেকেই। এই বিষয়ে আমি রিতীমত বিশেষজ্ঞ ছিলাম। কাজেই শত হাজারভাগ কনফিডেন্স নিয়ে মাথা খাটাতে শুরু করে দিলাম।
কিন্তু মাথা খাঁটিয়েও লাভ হলো না। ঐ বক্কর আলী বক্কু ঠিকই খোকাভায়ের ঘরে আসন গেড়ে বসলেন। আর এই ব্যপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন আমার মা। খোকাভায়ের আপত্তির কোনো উপায় ছিলো না। এমনিতেই অনাদরে অবহেলার পরাশ্রিত স্বর্ণলতার জীবন ছিলো তার। খোকাভাই চুপচাপ রইলেন। ঐ ছোট ঘরটার মাঝেই আরেক সাইডে বসিয়ে দেওয়া হলো আরেকখানা চৌকি ঐ বক্কর আলীর জন্য। মা বললেন, বেশ হয়েছে এখন থেকে দু'জনে মিলে এক সাথে পড়ালেখা করবে। একজন সঙ্গী হলো তোমার। ঐ সময় মায়ের মুখে এক আত্মতৃপ্তিমূলক প্রশান্তির হাসি ছিলো। মা ভাবছিলেন আহা মেঘ না চাইতেই জল। সারাদিন আমাকে চোখে চোখে রাখা কখন ছাদে চলে আসি এই ঝামেলাটা থেকে বুঝি তার মুক্তি মিললো অবশেষে। এখন এই বক্কু মিয়ার চক্ষু ফাঁকি দিয়ে আমি তো আর খোকাভায়ের ছায়াও মাড়াতে পারবো না। কিন্তু ঐ যে মা থাকতেন ডালে ডালে আর আমি পাতায় পাতায়।
কিন্তু পাতা ডাল সব কিছু বাদ দিয়েও বক্কু মিয়াকে আমি যে কতই না ঘোল খাইয়েছিলাম সেই কথা ভাবলে আমার আজ আসলেও কষ্টই লাগে। কিন্তু তখন সম্পূর্ণ বিনা দোষে বক্কু মিয়া হয়ে উঠেছিলো আমার দু'চোখের বিষ, শত্রুর শত্রু, জনম জনমের পরম শত্রু। পারলে আমি তাকে বিষ খাইয়েই মারতাম হয়ত। তবুও তার সহজ সরল স্বভাব আর বোকামীর কল্যানেই হয়ত প্রানে বেঁচে গিয়েছিলো সে। আমার মত তার জন্য পাষানীর প্রাণেও একটু মায়া আর দয়া হয়েছিলো। হা হা সবচেয়ে যেই কথাটা মনে পড়লে আমার দমফাটা হাসি পায় সেই ঘটনাটা আমি কাউকেই বলতে পারি না। শুধু মনে মনেই ভেবেছি এতদিন। আজও লিখবো কিনা ভাবছি।
আচ্ছা লিখবো না হয় নইলে অনেকেই কেনো লিখলাম না কেনো লিখলাম না বলে বলে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে। নয়ত সারাজীবন চিন্তায় থাকবে কি করেছিলাম আমি। কি করেছিলাম সেটা হয়ত কেউ এখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারছে না আর আমিও ভাবি এত শয়তানী বুদ্ধি আমি কেমনে পেতাম সেসব দিনে! তাও আবার কারো সাহায্য ছাড়াই ওয়ান ম্যান আর্মী হয়ে সকল শয়তানীর সহযোগী আমি একাই নিজে ছিলাম নিজের সাথে। সাধে কি আমাকে মা বলতো আমি নাকি শয়তানীতে একাই দুইশো ছিলাম। সেই আমি এখন কত্ত ভালো হয়ে গেছি তাই না?
যাইহোক, বক্কুর নামটাই ছিলো সবার আগে আমার তাকে মনে কষ্ট দেবার প্রথম অস্ত্র। যখন তখন তাকে দেখলেই বা ইচ্ছা করেই ছাদে গিয়ে তাকে দেখলেই বলতাম। বক্কু মিয়া বক্কু মিয়া.... হিহি এটা কেমন নাম বাবা বক্কু মিয়া বেক্কল!!! আচ্ছা তোমার নাম এই বক্কু রেখেছে কে! সে হাসি হাসি মুখে বলতো, বক্কু নাতো আমার নাম বক্কর। এটা খুবই ভালো নাম। আমি বলতাম ভালো না ছাই এটার মানে হলো তুমি এক নাম্বারের গাধা মানে বোকা সোজা ভাষায় বেক্কল তাই তোমার মা তোমার এই নাম রেখেছে বক্কু। সে বলতো না না মা না আমার দাদী আমার দাদী রেখেছে সে অনেক ভালোবাসে আমাকে। আমি থামিয়ে দিতাম ভালোবাসা না ছাই বোকাদের এই নামই রাখে জানোনা !!! সে অসহায় বোধ করতো। প্রতিবাদ করতো, আমি তাকে ধমকে বা ব্যঙ্গ করে থামিয়ে দিতাম। ভেংচে বলতাম বক্কু বক্কু তোর নাই চক্কু, তুই এক বেক্কল তোর নাই আক্কল....যদিও সেই অস্ত্র ছুড়ে তাকে বার বার ঘায়েল করতে না পেরে আমি একের পর এক অস্ত্র ছুড়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু সহজ সরল বক্কু কিছুতেই বুঝতো না যে সম্পূর্ণ বিনা কারণে আমি কেনো তাকে কষ্ট দিতে চাই। তাকে যতই ছোট করতাম সে ততই হাসতো আমাকে ক্ষমাও করে দিত। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হত না। আমার রাগ সবাইকে ছাড়িয়ে শুধু তার উপরেই। কেমনে তাকে খোকাভায়ের ঘর থেকে দূর করবো সেই চিন্তায় মত্ত থাকতাম আমি।
এই বক্কর আসাতে খোকাভায়ের সাথে যোগাযোগের অবস্থা একেবারেই কমে গেলো। আমি চিঠি লিখতে শুরু করলাম খোকাভাইকে। কিন্তু খোকাভাই বেশিভাগ সময় সে সব চিঠির উত্তর দিত না। তবে বাড়িতে তার সাথে কথা বার্তা বলতে না পেরে একদিন আমরা প্ল্যান করলাম কলেজ থেকে আমরা কোথাও চলে যাবো সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু হায়! ঐ মফস্বল শহরে যে অলিতে গলিতে হাজারও চোখ আছে ঐ বয়সের বুদ্ধিতে এইটুকু মাথায় ছিলো না। সারাজীবন শুনেছি দেওয়ালেরও চোখ আছে কিন্তু মফস্বল শহরের অলি গলি পথে ঘাটে আনাচে কানাচে শত শত চোখ ঘাপটি মেরে আছে।
যাইহোক সেসবের কোনো তোয়াক্কা না করেই একদিন আমরা কলেজ পালালাম। খোকাভায়ের সাইকেলের পিছে আমি। সেইদিনটার কথা ভাবলে আমি আজও হারাই। এক্কেবারে সেই গানটার সাথে কি যে মিলে যায় আমার সেই দিনটা! কোন গানটা বলোতো মিররমনি!!
নিশ্চয় ধরেছো.... ঠিক আছে বললাম না। ধাঁধা থাকলো তোমার জন্য।
তখন মনে হয় হেমন্ত নাকি বর্ষাই ছিলো। ঠিক ঠাক মনেও নেই আর আজ আমার। অনেক দিনের কথা তো তাই আর তেমন মনে থাকে না। তবে আমাদের ভৈরব নদীতে সে সময় বর্ষাতেই কিছুটা জল জমত নইলে আগের দিনের সেই প্রমত্তা ভৈরব শুধু শুনেছিই আর ভূগোল বই এ পড়েছি কিন্তু সে তখন প্রায় মরা নদী। তবুও সেই যে আমরা কলেজ পালালাম। সেদিন আমরা ভৈরব নদী পার হয়ে চলে গেছিলাম ওপারের একটা গ্রামে। খোকাভাই সাইকেল নিয়ে কলেজ থেকে দূরে অপেক্ষা করছিলো আর আমি রিকশা করে কলেজ থেকে পালিয়ে দূরে গিয়ে সেই সাইকেলে চাপলাম।
রাজপথ থেকে কিছুদূরে গিয়ে সাইকেল গিয়ে নামলো এবড়ো খেবড়ো এক মাটির সরু পথে। ইচ্ছা করেই আমরা ওমন একটি রোড বেছে নিয়েছিলাম যেন চেনা মানুষের চোখে না পড়ি। হা হা আমার এ লেখার পাঠকেরা নিশ্চয় ভাবছেন সেদিন ছিলো বাইকে পথ চলা আর আজ আবার শুরু হলো সাইকেলে চলা! এরপর কি জাহাজ উড়োজাহাজেও চড়বেন নাকি? হা হা সে যে যতই হাসুক না কেনো। আসলেই এই পথ চলা সে ট্রেনে হোক বাসে হোক আর বাইক সাইকেলেই হোক আমার চোখে গেঁথে থাকে সে সব দৃশ্য বহুদিন বা সারাজীবন! যেন নিমিষে বদলে যাওয়া এক একটি সেলুলয়েডের ফিতা। যখন সেই দিনটিকে মনে পড়ে আমার আমি হারিয়ে যাই সেই পথগুলির মায়ায় মায়ায়।
আর সত্যিই সেই সকাল সাড়ে আট বা নয় বা সাড়ে নয়টার দিকের ঐ হিম হিম ছায়া ঢাকা ঐ সরু পথটাতে কি যে মায়া ছিলো সে আমি কখনই বলে বা লিখেও বুঝাতে পারবোনা। সরু গলির দুপাশে একটু নীচে নেমে যাওয়া ঢালময় জমি জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো শত শত বাঁশগাছ। সেই চিরল চিরল পাতার লম্বা সুঠাম শরীরের বাঁশের গাছগুলো এক আশ্চর্য্য জলরঙ ছবির সৃষ্টি করেছিলো আমাদের চারপাশ জুড়ে। কোনো শিল্পী যদি সেদিন সেই ছবিটা আঁকতেন তবেই আঁকা হত আলো ছায়া ঢাকা ঝিকিমিকি এক সরু গ্রাম্য গলির পথ বেয়ে দুচাকার সাইকেলে ছুটে চলেছে কৈশোর পেরুনো দুটি ছেলে মেয়ে। আকাশী নীল জলছাপ কামিজ আর সাদা জর্জেটের ওড়না উড়ছে বাতাসে আর ছেলেটার গাঁয়ে সাদা মলিন শার্ট আর চারপাশ জুড়ে সবুজ সজীব বাঁশপাতার ব্যাকগ্রাউন্ড। পথের পরে মা মুরগী তার ছানাদের আগলে নিয়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিলো। হাসের দল প্যাক প্যাক করে চলছিলো দলবল নিয়ে। বাঁশপাতার ফাক ফোকড় গলে তাদের গায়ের উপর পড়ছিলো জাফরি কাটা নক্সার ঝিলমিলে রোদের আলো। মাঝে মাঝেই দেখা যা্চ্ছিলো মাটি বা খড়ের ছাউনীর ঘর, নিকানো উঠোন, উঠোনের দড়িতে মেলে দেওয়া শাড়ি কাপড় কাঁথা কানি। গরুকে খেতে দেওয়া হয় যে মাটির বড় একটা চাকার মত পাত্রে সেসব ঘিরে খাচ্ছিলো গৃহস্ত বাড়ির গরুগুলো। গরুগুলোের মাঝে কেউ কেউ ঐ সাত সকালেই খেয়ে দেয়ে টায়ার্ড হয়ে জাবর কাটছিলো পাশে বসেই। আমরা কোনো কথা বলছিলাম না। খোকাভাই চুপচাপ সাইকেল চালাচ্ছিলো আর আমি তখন কলেজ পালানো বিষম মনোযোগী ছাত্রী ঐ চারপাশের দৃশ্যে।
ঐ সরু পথে হেঁটে যাওয়া কিছু কিছু লোকজন ছেলেমেয়েরা আমাদেরকে দেখছিলো। কাঁধে বাক নিয়ে যাচ্ছিলো এক ভ্রাম্যমান দোকানী আর বিকট স্বরে হাঁকছিলো মাঠা নেবেন মাঠা! ঐ সরু মেঠোপথের পাশ দিয়ে বুকে বই খাতা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো স্কুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা। কেউ কেউ হা করে চেয়ে দেখছিলো আমাদেরকে হাঁটা থামিয়ে। আমি তখন সেই সব দিনে এমনই কাল্পনিক রুপকথার রাজ্যে বাস করতাম যে ঐ পথে যেতে যেতেই স্বপ্ন দেখছিলাম যে একদিন ঐ রকম একটা খড় বা মাটির নিকোনো উঠোনের বাড়িতে পালিয়ে আসবো আমি আর খোকাভাই। আমি ওমন টিউবওয়েল চেপে পানি তুলবো আর খোকাভাই খাওয়াবে গরু ছাগল আর গাধাদের। হা হা হা নাহ লিখতে গিয়েও আমার মাথার দুষ্টামী বুদ্ধি কন্ট্রোল হয়না। যাইহোক এমন সব স্বপ্ন বিভোর কল্পনায় কেটেছিলো আমার ঐ পথের সময়টুকু।
ঐ পথটুকু পেরিয়ে সাইকেল এসে পড়লো সেই এককালীন প্রমত্তা ভৈরব নদীর শুস্ক তীরে। ঐ তীরের অনেকটা দূরে জল চিকচিক করছিলো প্রায় শুকিয়ে আসা নদীটির জল টলটলে শুস্ক চোখ আর বড় অবহেলা আর আলস্যে সেই ক্ষীন নদীর তীরে ভীড়ে দাঁড়িয়েছিলো দু এক খানা ছোট ছোট নৌকা। খোকাভাই সেই শুস্ক নদী তীরে গজিয়ে ওঠা চা বিড়ি সিগারেটের ছোট ছোট টং ঘরের একটায় গিয়ে সাইকেল রেখে আসলো। তারপর আমার হাত ধরে বললো, চল... আমরা দুজন দুটি খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যাওয়া পাখি হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম শুস্ক বালিয়াড়ি ভেঙ্গে নদীটার ঐ জলের কাছে। ( জানিনা ঐ বালিগুলিকে বালিয়াড়ী বলে কিনা কিন্তু লিখতে ইচ্ছা হলো)
ওখানে বাঁধা ছিলো কয়েকটা নৌকা। মাঝিরা অবশ্য বসে বসে চা পান সিগারেট ফুকছিলো। খোকাভাই সোজা গিয়ে উঠলো একটাতে। বুঝাই গেলো আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো নৌকাটা। মাঝি হাতে বৈঠা ঠেলেই জিগাসা করলো। ওপারে জাবেন তো সারাদিনের জন্যি নাকি দুফরের মধ্যি ফেরবেন? খোকাভাই বললো বিকালে ফিরবো। আমি চমকালাম! ফিসফিস করে বললাম, খোকাভাই এত দেরী! মা যদি জেনে যায়! এত ফিস ফিস করে বলার পরেও মাঝিটা শুনে ফেলললো বোধ হয়। হো হো করে হেসে বললো,
বাড়িত্তে পলাইছো মনি? আমার রাগ লাগলো। বললাম পালাবো কেনো? আমরা এমনি বেড়াতে যাচ্ছি। মাঝি আর কথা বাড়ালো না-
কলৎ ছলৎ করে শব্দ উঠছিলো। আমাদের নৌকা ভেসে চললো শুস্ক ঢেউহীন ক্ষীন জলধারার এককালের সেই প্রমত্তা ভৈরবের বুকে।
(মাঝে মাঝে লিখতে বসলে আমি আর থামতেই পারিনা। ভেবেছিলাম এইবার বাইক ভ্রমন, সাইকেল ভ্রমন শেষে জাহাজ উড়োজাহাজ না হোক আমি নৌকা ভ্রমনের বর্ননা দেবো। এখন তাকিয়ে দেখি ইয়া বড় এক লেখা হয়ে গেলো। সবাই আমাকে পিটাবে নিশ্চয়। বলবে তোর না হয় কাজ করে করেও অকাজের সময় আছে... আমাদেরও কি আছে!!! থাক নেক্সট পর্বে লিখবো এই নৌকা ভ্রমন ও ওপারের সেই গ্রামের ঘটনা অবশ্য গ্রামের সব ঘটনা নাও লিখতে পারি। আমি তো জাঁতে মাতাল তালে ঠিক। তবে পরের পর্বের জন্য তোলা থাকলো সেই নৌভ্রমনের গল্প এবং সাথে বক্কুমিয়ার জীবনের ট্রাজেডীর গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৪৭