আমার অতি প্রিয় জিনিয়াসভাইয়া২০১৫ গেমু ওরফে গেম চেঞ্জার যখন আয়নাবাজি দেখে এসে আমাকে কথায় কথায় বললো,আয়নাবাজি সিনেমায় নাকি আমারই অভিনয় করা উচিৎ ছিলো। কথাটা যদিও ফান করে বলা তাই বলে পুরোটাই ফান যেমন তারও কাছে না আমারও কাছে তো নাই ই কারণ সে তো আমাকে অনেকটাই চেনে অথবা আসলে চেনেই না। কাজেই অনেক হাসলাম তার কথা শুনে তবে সিদ্ধান্ত নিলাম কালই আমাকেও দেখতে হবে সিনেমাটা।
সিনেমার রিভিউ গত কয়েকদিনে পড়েই যাচ্ছিলাম। যদিও রিভিউতে জেনেছি সিনেমার নায়ক আয়না একজন টিচার, অভিনয় শিল্পী এবং জাহাজের কুকও নাকি সে তবুও সিনেমার শুরুতেই যখন দেখলাম সে ছোট ছোট পিচ্চিদের টিচার মানে পড়ালেখা টিচার না, অভিনয় শেখানোর টিচার তখন তো গেমুর কথা মনেই পড়ে গেলো আমার। আসলেই তো, আমিও তো এমনই বাচ্চাদেরকে অভিনয় শেখাই। ঠিক এমনি করে। হাত ঘুরাও, এতটুকু হাঁটো, মনে করো তুমি এক রাজকন্যা, তোমার পৃথিবী আকাশের উপরে। তুমি মেঘের উপরে উড়ে যাচ্ছো, তুমি এক পরীর দেশের পরীরাণী। আয়নাবাজ আয়নাও তেমনি একজন টিচার। যাই হোক, সিনেমায় মন দিলাম।
আয়না ও আয়নাবাজি-
সিনেমার শুরুতেই একজন বৃদ্ধা মহিলার লাশ দেখে একটু চমকালাম তবে খুব দ্রুতই তা ভুলেও গেলাম একজন সহজ সরল এবং খুবই অসাধারণ অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলা একজন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের রুপায়ন দেখে। পুরান ঢাকার মহা জনবহুল, কোলাহলপূর্ন প্রানচঞ্চল একটি কাঁচাবাজারে লোকটি বাজার করে। খুব সাধারণ একটি রংচটা চুলোয় সে মায়ের বলে দেওয়া রেসিপিতে রান্না করে, পরিতৃপ্তি করে খায় দায়, ফোনে মায়ের সাথে কথাও বলে এবং বকাও খায়। সেটাও সে বেশ পরিতৃপ্তি সহকারেই খেয়ে দেয়ে আনন্দে থাকে। এক কথায় লোকটিকে খুব সহজ সরল খায় দায় গান গায় একা কাটায় টাইপ মানুষ বলেই মনে হলো। কিন্তু ক্রমেই বুঝা গেল, যতটা সিম্পল গোবেচারা মনে হয়েছিলো বেচারাকে, সে মোটেও তা নয় মানে এত সাধারণ কোনো মানুষ না সে। খুব অসাধারণ কিন্তু ভয়ংকর একটি গুন আছে তার মাঝে, সেটি তার অভিনয় দক্ষতা। লোকটি যখন যাকে ইচ্ছা তাকেই হুবুহু অনুকরন করে ফেলতে পারে। তার মত সাজ-সজ্জা চাল-চলন আচার-ব্যাবহার আয়ত্ব করে ফেলা তার এক সহজাত প্রতিভা। আর এই প্রতিভা দিয়ে সে খেলে ফেলে কিছু ভয়ংকর খেলা।
এই খেলাটি তার নেশা ও পেশা। সমাজের বড় বড় মানুষ বা টাকাওয়ালা মানুষদের জেইল খাটা শাস্তির প্রক্সি দেয় সে আর তাই সমাজের এইসব ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা ভাড়া করে তাকে। সে এসব মানুষের চালচলন, বেশভুষা নকল করে আইনের চোখে ধুলা দিয়ে যার দিনের পর দিন। সাধারন অভিনেতারা অভিনয় করে মঞ্চে। আর আয়নার অভিনয় মঞ্চ এই পুরো পৃথিবীটাই তবে তার এই নিখুঁত অভিনয়ের সহযোগী সঙ্গী আছে আরও কিছু মানুষ।
আয়না মাঝে মাঝেই তার আবাসস্থল থেকে হারিয়ে যায় তবে সাধারণ এলাকাবাসীরা জানে সে জাহাজে যায় কুকের জব করতে। কখনও ২ বা ৩ মাস কখনও বা ৬ মাসের জন্যও। তবে তার আশেপাশের মানুষজনগুলো অদ্ভুত এক মমতা ও ভালোবাসায় আঁকড়ে রাখে তাকে। আয়নার নিজেরও কি আছে ওদের জন্য কম ভালোবাসা? শুধু অভিনয়টাই তার নেশা এবং পেশা এবং বেশ ব্যাতিক্রমী রোমাঞ্চকর। আর সেজন্যই তাকে নিয়ে এই সিনেমা।
এই সিনেমাতে আয়নাকে দেখা যায় বেশ কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করে দক্ষতার সাথে সফল হয়ে আসতে তবে শেষ মেষ এই অভিনয়ের পরিনতিই তাকে নিয়ে যায় ফাঁসির মঞ্চে। তাই বলে ফাঁসিকাষ্ঠের দড়িও বিচলিত করতে পারে না এই দক্ষ অভিনেতাকে। তাকে নিরুদ্বেগ ও নিশ্চিন্তই লাগে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। এই পৃথিবীটা আসলে সত্যিকারের অভিনেতার হাতের মুঠোয় বন্দী। পৃথিবীর এই রঙ্গ মঞ্চে সেই ততখানি সফল যে যত ভালো অভিনয় করতে পারে। আর তাই শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় এই দক্ষ অভিনেতার অভিনয়ের শেষটুকুও দেখতে।
অভিনয়ের অসাধারনত্বে আয়নাবাজরুপী চঞ্চল চৌধুরী ও আরও কিছু চরিত্র-
আয়নাবাজি সিনেমাটাই অভিনয়কে কেন্দ্র করে কিন্তু তাতে যে কজন অভিনয় করেছেন সবার অভিনয়ই প্রশংসা পাবার যোগ্য। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে চঞ্চল চৌধুরী আসলেই শ্রেষ্ঠ। তাকে নিয়ে, তার অভিনয় নিয়ে বলাটাই ধৃষ্টতা। আমি তার অভিনয় জীবনের সর্বোচ্চ সন্মান প্রাপ্তির কামনা করি।
হৃদি চরিত্রে নাবিলাকেই যেন দরকার ছিলো। তার চেহারা, খুব সাধারণ কিন্তু অসম্ভব মার্জিত ড্রেসআপ, গেট আপ, রুচিশীল ও প্রগতিশীল মনোভাব সাথে বাবা ও মেয়ের যে মডার্ণ মুক্তমনের জীবন যাপনের মার্জিত রুপ ফুটে উঠেছে তার জন্য বোধ হয় ইনাদের থেকে কেউ যোগ্য হত না। আমি তার বারান্দায় সাজিয়ে রাখা ক্যাকটাসগুলি আর কেক বানানোর শখ দেখে আরও আরও বেশি মুগ্ধ হয়েছি। ফ্রিজে স্টিকারে বসিয়ে দেওয়া প্রজাপতিগুলিও খেয়াল করতে ভুলিনি।
রিপোর্টার সাবেররূপী পার্থ বড়ুয়া অসাধারণ অভিনয় করেছেন। শুধু মুখের তেলতেলে মেকআপটা ভালো লাগেনি আমার। আর তার বয়সটা আর একটু কম হলেই বুঝি বেশি মানাতো কারণ ৫০ বছরের একটা মানুষের নিশ্চয় এত ছোট বেবি থাকে না। তবে মদ খেয়ে তার ফোনের উপর রাগ করা খুবই মজা লেগেছে। সবচেয়ে যেটা দেখে একই সাথে কষ্ট এবং ভালো লেগেছে তা তার মাঝে একজন খাঁটি মানুষ জিন্তু জীবনযুদ্ধে ব্যার্থ হবার পরেও সব শেষে আসল ক্রিমিনালের ধরা পড়ায় তার আত্নতৃপ্তিমূলক হাসি দেখে। তার কাজের লোক হিসাবে যিনি অভিনয় করেছেন তিনিও ভীষন ভীষন মজার ছিলেন।
এছাড়াও হলিউড স্টুডিও এর মালিকের অসাধারণ অভিনয়, হলিউড স্টুডিও এর মোটুসটু লাল মোজা জুতা পরা ফুটফুটে পিচ্চিটা, আলুপুরীওয়ালা, মোটুসটু গেমখেলা পাগলু ছেলেটা সবাই যেন যে যার জায়গায় ছিলো একেবারেই পারফেক্ট এবং পারফেক্ট।
ফোটোগ্রাফী ও নানা বিষয়ে ভালো লাগাগুলি
আমি কখনও ম্যুভি রিভিউ লিখিনি। কিন্তু আজ এই আয়নাবাজির ভেলকি লেগে আয়নাকথন লিখতে গিয়ে দেখলাম আয়নাবাজি সিনেমায় কাঁচা বাজারের ন্যাচারাল দৃশ্য, ঢাকার রাস্তায় অঝর বৃষ্টি বা হৃদির বাসার ফ্রিজ স্টিকার, পুরোনো ওভেন সবই যেন ঠিক ঠিক যথার্থ স্থানেই এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এইসব দেখে আমার বার বার কেনো যেন সত্যজিৎ রায়কেই মনে পড়েছিলো। এছাড়াও নাবিলা বা হৃদির অতি সাধারণ সাদা ঝকঝকে ওড়না পায়জামার সাথে স্নিগ্ধ রং এর নানা বর্ণময় বর্ণীল পোষাকগুলিও দৃষ্টিনন্দন ও রুচিসন্মত ছিলো।
এই ম্যুভিতে ব্যাক্তিত্বময়ী এ নায়িকাটিকে বিশেষ ভালো লেগেছে।
কিছু মনে গেঁথে যাওয়া শব্দাবলী
এই সিনেমায় আমার আরেক ভালোলাগা আয়নার বাসস্থান দুটি। প্রথমটির নাম হাওয়া ঘর। হাওয়াঘর, আয়না এসব শব্দগুলো যেন এই দুদিনের পৃথিবীতে জীবনের কটা দিন কাটিয়ে যাওয়া মানুষের ফানুশ জীবনের সাথে বড় সামঞ্জস্যপূর্ন। এই সব শব্দ, ভাবনা দর্শনে মানে পুরো ম্যুভিতেই যেন জীবনবোধের দিক থেকে লালন দর্শনেরও ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই নামগুলি, এই শব্দগুলি দেখে আমার মনে হয়েছে কি অসাধারণ চিন্তাশক্তিতে এগিয়েছে এই সিনেমা।
এই সিনেমার অর্থবহ গানগুলি
সিনেমার গান যেন আমাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে আয়নাবাজি সিনেমায় গানগুলি একটু বেশিই যেন অর্থবহ ছিলো। শারমিন সুলতানা সুমির কথা ও সুরে চিরকুটের কন্ঠে জেইলে বসে গাওয়া কয়েদীদের গানটা খুবই ভালোলাগাময়।
না বুঝি দুনিয়া, না বুঝি তোমায় আমার কি দোষ খালি পাপ জমাই
আরও ভালো লাগা ছিলো,
লাগ ভেলকি লাগ ভেলকি
অসম্ভব ভালো লাগা ছিলো
ধীরে ধীরে যাওনা সময়
আরও একটি গান যেন আমার দেখাই এই শহরের ছবি উঠে এসেছে গানের কথায় কথায়,
এ শহর আমার
আয়না ও আয়নাবাজি নামের সার্থকতা
আয়নায় মানুষ দেখে নিজের প্রতিফলন আর এই আয়না নিজের মাঝে আয়ত্ব করে নিয়েছিলো অন্যের প্রতিফলনটি। যদিও আমরা প্রতিটি মানুষই এই জীবননাট্যের এক একজন অভিনেতা অভিনেত্রী। কিন্তু আয়নার অভিনয়টি দখল করে নিত অন্যের অস্তিত্বতুকুও। আয়না তার জীবনের সকল দুঃখ, বেদনা বা হতাশাকেই ভুলে থাকতো অন্য মানুষের অস্তিত্ব হয়ে।
অভিনেতারা সবসময় মিথ্যা কথা বলে, আমাদের যাপিত জীবনেও এমন মিথ্যা বলা অজস্র অভিনেতা রয়েছে। প্রতি নিয়ত ন্যায় অন্যায়, স্বার্থ বিদ্বেষ ভেদে অভিনয় করে চলেছি আমরাও। এসবই আয়নাবাজীর ভেলকী বা ধোকা। এ চলচিত্রে নায়কের নাম ও ম্যুভিটির নাম যেন শতভাগ সার্থক এমনটাই মনে হয়েছে আমার।
সিনেমাটি সম্পর্কে যা জেনেছি
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় শুটিং হয়েছে হাওয়াঘর ও নানা দৃশ্যগুলির অনেকখানিই। ‘আয়নাবাজি’ ছবির মাধ্যমে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটছে জনপ্রিয় উপস্থাপিকা নাবিলার। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে প্রথমবারের মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সঙ্গীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়া।
ছবিতে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন গাউসুল আলম শাওন, হীরা চৌধুরী, সোহেলসহ আরও অনেকে। কনটেন্ট ম্যাটারস লিমিটেড প্রযোজিত ও হাফ স্টপ ডাউন লিমিটেডের ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন গাউসুল আলম শাওন। সংলাপ লিখেছেন অনম বিশ্বাস ও আদনান আদীব খান। চিত্রগ্রহণে ছিলেন রাশেদ জামান। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক জিয়াউদ্দীন আদিল ও নির্বাহী প্রযোজক এষা ইউসুফ।
সব শেষে আয়নাবাজি ও একজন অমিতাভ রেজা
যে কোনো সফলতা একা একা অর্জন করা যায় না বটে। পুরো টিমটাই যদি যোগ্য না হয় বা যোগ্যতা না দেখাতে পারে তো একজন অতি যোগ্য পরিচালকও ব্যার্থ হতে বাধ্য। ঠিক তেমনই একজন পরিচালকের পরিচালনা দক্ষতাও অনেকগুলি যোগ্য মানুষকে কিভাবে অতি যোগ্য করে তুলতে পারে তা বোধ হয় অমিতাভ রেজাই দেখাতে পেরেছেন। তিনি প্রায় হাজার খানেক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন বা টিভিসি নির্মান করেছেন। এছাড়া তিনি প্রচুর টিভি নাটকও নির্মান করেছেন। তবে আয়নাবাজি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে যে আত্মপ্রকাশ করেছেন আমি তার সর্বোচ্চ সফলতা কামনা করছি । উনার জন্য আমার প্রান থেকে শুভকামনা। অভিনন্দন রইলো এত মানুষের মন জয় করে ফেলবার মত একটি অসাধারণ কাজ দেখাবার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৫৮