শৈশবের আমার জীবনের ঠিক কোন ঈদটা প্রথম ঈদ ছিলো তা আমি কিছুতেই মনে করতে পারিনা না। শুধু ফ্যামিলী এ্যালবামে কিছু ছবি আছে , লাল টুকটুক সার্টিন টাইপ জরিদার দারুন ঝকমকে সুন্দর ফ্রক পরে মায়ের কোলে বসে আছি। সেই ছবির বিশেষত্ব পা থেকে খুলে খুলে যাওয়া সাইজে বড় লাল টুকটুক মখমলের জামার সাথে ম্যাচিং জুতোগুলো। একটু বড় হবার পরে কতবার যে ছবিগুলি নিয়ে মাকে প্রশ্ন করে করে তার জীবন ঝালাপালা করে তুলেছি। তখন নাকি আমার বয়স ছিলো তিনমাস।
সে যাইহোক, প্রথম ঈদের স্মৃতি হাতড়ে দেখতে গিয়ে মনে পড়লো সেই ঈদটির কথা তখন আমি মনে হয় নার্সারীতেই পড়ি অথবা কেজি ক্লাসে। আমরা তখন ধানমন্ডিতে ছিলাম। আমাদের এখনকার ধানমন্ডি ১৪ নাম্বার রোডের বাড়িগুলি তখন ছিলো ঠিক সেই কবিতাটার মত।
আমাদের ছোট গায়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
ঠিক এই কবিতাটার মতই তখন আশে পাশের সব বড় মানুষদেরকে আমরা চাচু বা চাচা ডাকতাম, আন্টি ডাকটার চাইতেও প্রচলিত ছিলো খালাম্মা বা চাচী ডাকগুলো। আর এক স্কুলের বাচ্চারা একসাথেই স্কুলে যেতাম, একই সাথে গান শিখতাম, নাচের ক্লাসে যেতাম। এই সুবাদেই সেবারে সব মায়েদের ইচ্ছে হলো পুরো লেইন জুড়ে বা আরও আশেপাশে যত মেয়ে বাচ্চা আছে তাদের জন্য শার্ট প্যান্ট বানানো হবে একই কাপড়ে, একই ডিজাইনে। সবাই মিলে একদিন বিকালে চললো নিউমার্কেট (তখনকার সবে ধন নীলমনি মার্কেট) কাপড় কিনতে, অর্ডার দিতে। অবশ্য এলিফ্যান্ট রোডের ঐ দিকে কিছু সুন্দর নতুন বিদেশী কাপড়ের ফ্যাশন হাউজ তখন শুরু হয়েছিলো, মনে পড়ে পিয়ারসনস এর দোকানটা ছিলো আমার কাছে বিশেষ আকর্ষনীয়।
কিন্তু আমার মায়ের একটা সমস্যা বা শখ ছিলো আমাকে তিনি যথার্থ কলাবরিষ্ঠা (ফারিহান ভাইয়ার দেওয়া উপাধি) কন্যা রূপেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আর তাই এই পুতুল পুতুল কন্যাগুলিকে ছেলেদের মত কাঠখোট্টা পোষাক পরানো হবে ব্যাপারটা তার তেমন পছন্দ হলো না। শুধু সোসাইটির খাতিরে তিনি তেমনি একটি বানিয়ে দিলেন বটে তবে নিজের হাতে মেশিনে সেলাই করে বানালেন আরেক অপূর্ব সুন্দর আশ্চর্য্য এক ঈদের জামা। মা কোনো ট্রেন্ড বা ফ্যাশন মানতেন না তিনি আমার ভেতরে ঠিক তার রুপকথা রাজ্যের রাজকন্যাদেরকে বা তার নিজের শৈশবকেই দেখতে চাইতেন এমনটাই মনে হয়েছে আমার আর তাই কুঁচিহীন কিন্তু বিশাল ঘের ওয়ালা নীল জমিনে লাল নীল ছোট বড় বল প্রিন্টের এক সত্যিকারের রাজকুমারীদের মত জামা বানালেন তিনি।সেই জামার নাম নাকি আমব্রেলা কাট জামা। জামাটা ট্রায়াল দিতে গিয়ে আর খুলতেই ইচ্ছে হচ্ছিলো না আমার। আয়নার সামনে শুধু ঘুরে ঘুরে দেখি, একটু ঘুরে দাঁড়ালেই কি আশ্চর্য্য সুন্দর ছাতার মত ফুলে ওঠে জামাটা! মুগ্ধ হওয়া সে আমার ছেলেবেলার অভ্যাস! অতি অল্পেই এই জীবনে যেমনই মুগ্ধ হয়েছি আমি ঠিক তেমনি খুব তুচ্ছ কারণেই সেই মুগ্ধতা নিমিষে নাই হয়েও গেছে আমার।( একজন কবি, গল্পকার, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক প্রিয়বন্ধুর অতি সত্য উক্তি আমার সম্পর্কে এটা, যেটার যথার্থতা পরে বুঝতে পেরেছি আমি) সে যাইহোক সেই মুহুর্তে আমি সেই জামা কিছুতেই খুলবোনা, আমাকে জামাটা খোলাতে মা বললেন এক মজার কথা। হায় হায় সব জামা ঈদের আগেই সবাইকে দেখিয়ে দিলে ঈদের মজাই থাকেনা জানো? এটা তোমার সারপ্রাইজ জামা !!! মুগ্ধতার মত হঠাৎ মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবার মজাটাও আমার সেই তখন থেকেই শেখা।
সারামাস জুড়ে বিকেলবেলার ইফতার সে ছিলো আরেক আকর্ষন।কাঁচা বুট একটু খানি ছোট্ট প্লেটে ভিজিয়ে রাখতেন মা। সাথে আদা কুচি (ভয়ংকর স্বাদ ছিলো আমার কাছে সেটা ) আবার তেঁতুল পানিতে ভিজিয়ে রেখে চিপে পানিটা লবন দিয়ে খাওয়া (মাইগড!) টক আমি তেমন খেতে পারিনা আর আমার শৈশবের সেই ইফতার টেবিলের টক তেতুল ভিজানো পানির স্বাদ মনে পড়লেই চোখে পানি আসে এখনও ভয়ে। সেসব নাকি শরীরের জন্য খুব উপকারী। এত বিদঘুটে স্বাদের একটা খাবার খাওয়ার কি মানে আমি জানতাম না, এখনও বুঝিনা। তবুও শৈশবের ইফতার টেবিল মনে পড়লেই আমার মনে পড়ে ছোট্ট সেই সাদা প্লাসটিকের প্লেটে ভেজানো বুট সাথে আদা কুচি ইত্যাদি ই্ত্যাদি। বেগুনী, পেয়াজু, ছোলা সেসব ছিলো অমৃত। আলু চপও থাকত মাঝে মাঝে কিন্তু হালিম বা ফ্রায়েড চিকেন এসব আমার শৈশবে কেউ ইফতারে খেত কিনা আমার জানা নেই। তবে ফল ও খেঁজুর ছিলো সেসব দিনেও। লেবুর শরবৎ এখনকার মত তখনও পানীয় হিসাবে ছিলো এক নাম্বার।
সে যাইহোক ঈদের আগে ২৭ রোজাতে নাকি হাতে মেহেদী লাগাতেই হবে, তাতে নাকি অনেক সোওয়াব হয়। এমন কথাই বলাবলি করছিলো আমাদের বয়সী বা আমাদের চাইতে বড় বড় আপু ভাইয়ারা। সেই সুবাদেই ২৭ রোজার দিন মেহেদী লাগানোর ধুম পড়ে গেলো বিকালবেলা। আমাদের বাসার ছাদেই হয়েছিলো সেই আয়োজন সে আমার বেশ মনে পড়ে। ছোট ছোট বাটি বা থালায় করে মেহেদী বাটা হলো। মেহেদী বাটতে আবার শিলপাটার নরমাল সাইডটা ইউজ করা যাবেনা নাকি, পাটাটাকে অবশ্য অবশ্য উলটে নিতেই হবে, এমনই নাকি নিয়ম। যেনো মরিচ-হলুদ বাটা পাশটায় মেহেদী পিশে সেই মেহেদী আবার হাতে লেগে হাত জ্বালাপোড়া না করে। মেহেদী বাটা হলো, এবার মেহেদী লাগাতে বসলো বড় বড় আপুরা। তাদের নিজেদের হাতে মেহেদী লাগানোর আগে তাদের গুরু দায়িত্ব ছিলো ছোটদের হাতে লাগিয়ে দেওয়া। কাঁঠি দিয়ে সুক্ষ কারুকার্য্যে হাতের তালু ভরিয়ে ফেলতে তাদের জুড়ি ছিলোনা। কেউ কেউ সেসবের ধার ধারতোনা। একটা বিশাল গোল্লা করে হাতের তালুর মাঝে চ্যাপটা করে বসিয়ে দেওয়া আর আঙ্গুলের নখে গাবদা গোবদা করে মেহেদি লাগিয়ে বসে থাকাই ছিলো তাদের কাজ।আমি আবার শিল্প মনোভাবাপন্ন মানুষ হওয়ায় ছোট থেকেই এমন ভোতা কাজকারবারের মানুষদেরকে একদম পছন্দ করতাম না কাজেই তাদের ধারেকাছেও ঘেসিনি। যদি আবার তারা নিজেদের হাতে ওমন বিদঘুটে মেহেদী লাগানোর আগে ধরে আমার হাতেই ওমন গাবদা গোবদা মেহেদি ডিজাইন বসিয়ে দেয়!!! যাইহোক, ছোট ছোট ছেলেগুলা আবার বড় বড় আপুদেরকে তাদের হাতের তালুতে লিখে দিতে বলছিলো তাদের নাম বা ঈদ মুবারাক। আর বড় কিছু টাংকিবাজ ভাইয়া আপুদের সান্নিধ্য পেতে ছাঁদে উঁকিঝুকির পাশাপাশি তাদের হাতের নখের কড়ে আঙ্গুলে মেহেদী লাগাতে একটু বাটা মেহেদি চাইতে আসছিলো। সে এক উৎসব মুখর বিকেল ছিলো যা আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। আজ স্মৃতির দরজা খুলে ঈদের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে মনের দূয়ারে ভেসে উঠলো সেই অপূর্ব মধুময় ছেলেবেলা বিকেলের স্মৃতি।
ছোট্ট একরত্তি শক্ত কাগজে কার্টুন আঁকা এক কার্ড দিলো আমাকে পাশের বাসার রুনি। ও মা্ই গড!!! পৃথিবীতে এত সুন্দর জিনিসও তাহলে হয়!! এমনটাই মনে হলো আমার। দিনরাত তাকিয়ে থাকি কার্ডটার দিকে। একটা সাদা গোলাপী বিড়ালছানা আরেক নীলাভ সাদা বিড়ালবাচ্চাকে এক গোছা গোলাপ দিচ্ছে আর তাতে লেখা ঈদ মুবারাক। সেই কার্ড আমার স্মৃতির মনিকোঠায় সপ্তম আশ্চর্য্যের যে কোনো আশ্চর্য্যের চাইতেও বেশী আশ্চর্য্য হয়ে রইলো। এর পর বড় বেলায় তখন আমি কলেজ ফার্স্ট ইয়ার সেসময় পাওয়া আরও একটি বিশেষ কার্ড আমার স্মৃতিতে উজ্বল হয়ে আছে সেই কার্ড খুললেই মিউজিক বেজে উঠতো। তবে সেই কার্ডে ঈদ মুবারাক লেখা ছিলো না । লেখা ছিলো অন্য কিছু। থাক সব কিছু বলতে চাইনা। যারা পড়বে তারাই গেজ করে নিক।অবশ্য উপরের ছবিটা দেখেও যে কেউ গেজ করে নিতে পারে।
চাঁদ দেখার দিনটা ছিলো ছিলো আরও এক মহোৎসব! তাড়াতাড়ি ২৯ রোজার ইফতারের পরেই নাকি চাঁদ উঠে যেতে পারে সেই ভয়ে সব্বাই ছুটলো ছাদে বা বাড়ির পাশে পরে থাকা জমিগুলির মাঠে। কিন্তু চাঁদ উঠলোনা সবাইকে হতাশ করে দুষ্টু চাঁদটা লুকিয়ে রইলো তার আকাশের বাড়িতে। কি আর করা! আমার দুখু দুখু মুখ দেখে দাদীমা বললো, কাল চাঁদ উঠুক না উঠুক কাল ঈদ। দাদীমার উপর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো। কি হত আজকের আগেই চাঁদের বুড়িকে এই অর্ডারটা দিয়ে দিলে।
এল ঈদের আগের দিনের রাত। যদিও দাদীমা তার ভবিষ্যৎ বাণী করেই দিয়েছিলো চাঁদ উঠুক না উঠুক কাল ঈদ হবেই। তবুও সবাই ছুটলো আবারও চাঁদ দেখতে ছাদে, মাঠে আর সত্যিই দেখা দিলো আকাশের কোনে কিষাণের বাঁকা কাস্তের মত এক ফালি সরু চাঁদ। সবাই হই হই শুরু করলো ছেলেরা পটকা ফুটাচ্ছিলো, আকাশে উড়ছিলো আরও এক অদ্ভুত সুন্দর জিনিস! নাম তার তারাবাজী। অন্ধকার আকাশে ঝলমল করে হেসে উঠছিলো ফুলের মতন আলোকচ্ছটা আর তার পর ছড়িয়ে পড়ছিলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে চারিধারে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!!!
বাসায় ফিরতেই টিভিতে শুরু হলো সেই শৈশব থেকে কৈশর, কৈশর থেকে এই বুড়ি হওয়া হওয়া কাল পর্যন্ত অমর সেই প্রিয় ঈদ সঙ্গীত। সবাই নিশ্চয় নিশ্চিৎ বুঝে ফেলেছে কোন সে সঙ্গীতের কথা বলছি আমি। ঈদের আগের সন্ধ্যায় যে গান না শুনলে আমার ঈদ কখনই ঈদ হবেনা বলেই আমার ধারণা। মৃত্যু আগের ঈদের দিনটি পর্যন্ত শুনতে চাই আমার প্রিয় সেই সঙ্গীত। "ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ"।
এরপর এলো ঈদের দিন। আগের রাতেই ডিসিশন হয়েছিলো খুব ভোরে উঠতে হবে যত ভোরে পারা যায়। ঈদের দিনটার একমুহুর্তও যেন নষ্ট না হয় ঈদ আনন্দ থেকে আর তারই কারণে ছিলো বুঝি সেই ডিসিশান। এত ভোরে উঠতে চাইলাম কিন্তু উঠে দেখলাম আমার আগেই বাসার লোকজন সব্বাই উঠে গেছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছিলো সেমাই ফিরনীর এলাচ, তেজপাতা দেওয়া সেই প্রথম বুঝতে শেখা ঈদ ঈদ সুঘ্রাণ। লাফ দিয়ে উঠলাম বিছানা থেকে। হায় হায় ভোরে ওঠার প্রতিযোগিতায় এবার বুঝি হেরেই গেলাম। বারান্দায়, জানালায় উঁকি দিয়ে বুঝার চে্ষ্টা করলাম কে কে উঠে গেছে আমার আগেই। ইশ ছোট থেকেই কি যে প্রতিযোগীতা মূলক মনোভাব ছিলো আমার!!! সব কিছুতে ফার্স্ট হতেই হবে!
যাইহোক দেখলাম বাবা ও বাসার অন্যান্য ছেলেমানুষেরা যাচ্ছে পায়জামা পান্জাবী পরে ঈদ গাহে। আজ হঠাৎ উপলদ্ধি করলাম তখনকার দিনে বুঝি বাবাদের ঈদে নতুন পান্জাবী বা জামা কেনার প্রচলন ছিলোনা কারণ আমার বাবাকে আমি দেখিনি কখনও নতুন কিছু পরতে ঈদে। তোলা পান্জাবী পরে নিয়েই চলতেন ঈদগাহে। মা কিন্তু ঠিকই কিনতেন বেশ কয়েকটা শাড়ি ও বাসার বিছানার চাদর, পর্দা, টেবল ক্লথ থেকে শুরু করে ঈদের দিনের খাবার পরিবেশনের জন্য নতুন সব তৈজসপত্র! মায়ের এই গুণাবলী বা বদভ্যাস যাই বলা হোক না কেনো আমার গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে গেঁথে আছে আজও এই বড়বেলাতে এসেও।
সেই ছোটবেলার ঈদ শুরু হত গোসল করে নতুন জামা পরে। ততক্ষনে ঈদ গা থেকে ফিরে আসতেন বাবা সাথে পাড়ার সব চাচ্চুরা। তারা সবার আগে বসতেন টেবিলে। সেমাই, ফিরনী, পায়েস, লাচ্ছা নানা রকম মিষ্টিজাত খাবারই থাকতো তখন সকালের টেবিলে। সবাই একটু করে খেতেন কারণ এক বাসাতে খেলে তো চলবেনা, যেতে হবে পাড়ার প্রতিটা বাড়িতেই। মুখে দিতে হবে প্রত্যকের বাড়ির খাবার এক চামচ করে হলেও।
এরপর মা চুল বেঁধে দিতেন নতুন ফিতে বা ক্লিপে। মুখে লাগিয়ে দিতেন ফেস পাউডার। এই সব ফেস পাউডার বা বড়দের প্রসাধনীগুলি সারা বছর ড্রেসিং টেবিলে সাজানো থাকলেও ছোটদের ধরার পারমিশন ছিলোনা। শুধু ঈদ বা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠামে মায়ের পারমিশন এর সাথে তারই হাত থেকে গোলাপী ফেস পাউডারের (বড়দের পাউডার) তুলিটা একটু বুলিয়ে দেওয়া হত ছোটদের গালে। তারপর চোখে একটু কাজল আর ঠোঁটে লিপ গ্লস, লিপস্টিক!! নো ওয়ে!!!! তবে গলায় মালা বা হাতে চুড়ি টাইপ গয়নাগাটি পরাতে কোনো বাঁধা ছিলোনা। নতুন জুতো থাকতোই এখনকার মতই আমাদের শৈশবের ঈদেও।
সেসব পরে কখনও নিজের বাসায় খেতাম না আমরা, দলবেঁধে বের হতাম লাইন ধরে সব্বার বাড়ি বাড়ি। প্রথমে বাবা চাচাদের দল, তারপর ছোট মেয়েদের দল, তারপর ছোট ছেলেদের দল আর তারপর একদম বিকেলে বড় ভাইয়ারা বের হত দল বেঁধে এর ওর বাড়ি। যে বাড়িতে তাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা থাকতোনা তবুও সে বাড়িতে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, সেলামী বা ঈদের খাবার খেতে কোনো বাঁধা ছিলোনা। বড় আপুরা কখনও রাতে আসতো কখনও বা পরদিন। মায়েদের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় বা বাড়ি বাড়ি বেড়ানোর নিয়মটা ছিলো পরদিন বা ঈদের তৃয় দিনে।
যাইহোক ফিরে আসি ঈদের রাতে-
সারাদিন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রোদে পুড়ে, চুল আলুঝালু করে বাসায় ফিরতাম সন্ধ্যায়। জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে সোজা টিভির সামনে। ছোটদের বিশেষ অনুষ্ঠান হত। মজার মজার ঈদের গান, আনন্দের নাচ, নাটিকা অবশ্যই নাটিকার বিষয়বস্তু ছিলো ঈদ আনন্দের সাথে দুস্থ বন্ধু বা প্রতিবেশীদেরকে ভুলে না যাওয়া। এর পর হত কোনো বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান। রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমিনদের একক সঙ্গীত সন্ধ্যাও হত সেসব দিনে। তারপর ঈদের বিশেষ নাটক। অবশ্য অবশ্য হাসির নাটক ছিলো সেটা। আমার ধারনা সবারই মনে আছে আমজাদ হোসেনের সেই বিখ্যাত নাটক, যে নাটকে দেখা যেত জব্বার আলীর প্রতি ঈদে দূর্নীতির কারণে হাজতে বসে সেমাই খাবার কথা। আর একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিলো ঈদ আনন্দমেলা। সেই অনুষ্ঠানের শেষ হত অনেক রাতে। সারাদিনের ক্লান্তিতে তখন চোখ জুড়ে নেমে আসতো ঘুমপরীরা তবুও জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা অব্যাহত থাকতো ঈদের দিনের শেষ আনন্দটুকু উপভোগ করতেই হবে এই ভাবনায় কারন ঘুমিয়ে গেলেই তো শেষ হয়ে যাবে এত প্রতীক্ষিত আনন্দের ঈদের দিনটি!!!
আজও ঈদ আসে। একই আনন্দে ভাসি আমি আজও। সেই রোজা, ইফতার, কেনাকাটা, ঈদের কার্ড, ঈদের গিফট, চাঁদরাত বা ঈদের রাত সবই আসে আগের মত শুধু সেই আমার মহা মজার শৈশব আর ফিরে আসেনা। তবুও ঈদ তো ঈদই। জানিনা এখনকার দিনের সারাবছর এত এত পাওয়া, ঘরের কোনে টিভি বা ডিজিটাল গেমে একাকী মত্ত শিশুগুলি আমাদের মত করে ঈদকে উপভোগ করে কিনা তবে সব শৈশবের আনন্দেরই এক মহানন্দ অনুভুতি আছে, থাকবেই। যুগে যুগে বদলাবে মানুষ, বদলাবে ঈদ। তবুও ঈদের আনন্দ একই ভাবে অব্যাহত থাকবে প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে।
এই ব্লগে আসার পর থেকে আমার ঈদ পোস্টগুলো--
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
গতবছর কেনো যেনো ঈদে কোনো পোস্ট লেখা হয়নি। ব্লগীয় জীবনটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেছে। আগের মত আর সময় পাওয়া যাচ্ছে না বা দূরে কোথাও দূরে দূরে আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে........
তাই বলে গত বছরও খানাপিনা আর খানাটেবিলের ছবি তুলতে ভুলিনি আমি। পুংখানুপুঙ্খভাবে প্রতিটা জিনিসের বিশদ বর্ণনা না থাকুক অন্তত একটা ছবি দেওয়া যাক আমার গত ঈদের।
নাহ দুইটা ছবিই দেই...........
লেখাটা উৎসর্গ করছি জাফরুল মবীন ভাইয়াকে। তার ভেতরে দেখা যাচ্ছে প্রবল ব্লগীয় সম্ভাবনা। ছোট মুখে বড় কথা কিনা জানিনা তবে আমি তার ফ্যান হয়ে গেছি কয়েকটা লেখা পড়েই, যদিও তাকে বলা হয়নি সে কথা।
আর সারাহমনি- রিমঝিমবর্ষার পুতুলকন্যা
সোহামনি- রেজওয়ানার সোনামনি
মিতিনসোনা- সমুদ্রকন্যা তিথীর কন্যা
আদিত্যবাবু- স্বপ্নজয় ভাইয়ার রাজপুত্তুর
রায়নামনি- রাহীর কন্যা ( আমার নাতনী)
লাবিবসোনা- সোনাবীজ ভাইয়ার পুত্র
আয়ানামনি- ঘুড্ডিভাইয়ার কন্যা
পার্লিনবাবু- শিপুভাইয়ার রাজপুত্র
আরহাম- শান্তির দেবদূত ভাইয়ার জুনিয়র দেবদূত
তানহামনি- জহিরুল ভাইয়ার রাজকন্যা
সকালসোনামনি- সবাক ভাইয়ার রাজপুত্র
সিঁথিমনি- শিপন মোল্লা ভাইয়ার পরীকন্যা
আনিন্দিতামনি-অরুনাভ ভাইয়ার রাজকন্যা
তাহমিদবাবু- বৃষ্টিভাইয়ার রাজকুমার
জাফনামনি- শ্রাবন আপুর রাজকন্যা
জাহরা, মানহা, পারিসামনি- সুরঞ্জনা আপুর পরীরা
অতন্দ্রিলামনি আর চন্দ্রশীলাপরী- সাবরিনা আপুর রাজকন্যার
মাহীমনি আর অহীমনি- মামুন ভাইয়ার রাজকন্যারা
কিন্নরীমনি- জানা আপুর রাজকন্যা
এই পুতুল পুতুল বাবুগুলোকে জানাই অপ্সরা খালামনির পক্ষ থেকে ঈদের অনেক অনেক ভালোবাসা! তাদের আজকের দিনের ঈদগুলো অবশ্যই আমার শৈশবের ঈদগুলো থেকে অনেক অনেক আলাদা সে আমি জানি। তবুও সব শিশুর মাঝেই ঈদ এক বিশেষ আনন্দ বয়ে আনে হয়তো যার সাথে সবার শৈশবের আনন্দেরই এক বিশেষ মিল থেকে যায়।
সবাইকে ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা!!!!!!!!!!!!!