তিরিশ দিনের রোজার শেষে
ঈদ হবেরে ভাই-
এখন থেকে খুশীতে মোর ঘুম আসেনা তাই,
ঈদ হবেরে ভাই, ঘুম আসেনা তাই।
বিটিভির 'এসো গান শিখি' অনুষ্ঠানে রমজানের সারা মাস জুড়ে ফেরদৌসী রাহমানের শেখানো এই গানটি ঈদের খুশীর আমেজ ছড়াতো হয়তো আমার মত আরো অনেকেরই মনে আমাদের ছেলেবেলায়। এই গানটা এখনও যখন মনে পড়ে দমফাঁটা সেই খুশীটাই, সেই আনন্দটাই এক পলকের জন্য হলেও মনে জেগে ওঠে। তক্ষনি আমি ঠিক ঠিক চলে যেতে পারি আমার সেই ছেলেবেলার ক্ষণটিতে।
আমাদের ছোটবেলায় একটা শিশু কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতার অনুষ্ঠান ছিলো।" নতুন কুঁড়ি" ছিলো তার নাম। সেখানে নজরুল গীতি পর্যায়ে একবার আমি গেয়েছিলাম একটা গান।
নাই হলো মা, বসন ভুষন এই ঈদে আমার
আল্লাহ আমার মাথার মুকুট
রাসুল গলার হার.......
এই গানটাই আমাকে খুব ছোট থেকে ভাবিয়েছিলো গরীব বাচ্চাদের ঈদ নিয়ে। আমার ঈদের আনন্দের সাথে তাদের ঈদের নিরানন্দটাও আমার মন কষ্টে ভরিয়ে তুলেছিলো। সেই থেকেই প্রতিজ্ঞা ছিলো যখন বড় হবো আমি ওদের সাথে এই ঈদের আনন্দটা একটু হলেও ভাগ করে নেবো।
তাই রমজানের প্রতিটা সপ্তাহে আমি একটাবার করে হলেও তাদেরকে ভুলিনি। জানি এটা একফোটা দুঃখ লাঘব করতে পারবেনা হয়তো তাদের কিন্তু শিশুদের নিয়েই তো আমার কাজ নাহয় দুচারদিন তা হলো এই দুখী শিশুগুলোর সাথেই।
যাইহোক শেষ পর্যন্ত ঈদের চাঁদ দেখা গেলো। যথারীতি ছেলেবেলার মত বিটিভি গাইলো, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ। এই গান ছাড়া আমার ঈদ হবেনা। আমি আমার মরণ পর্যন্ত এই গান শুনতে চাই, ঠিক ঠিক ঈদের আগের দিনের সন্ধ্যাটায়। এই গান শুনতে শুনতেই মেহেদি লাগালাম নিজের হাতে।(অবশ্য শুরু করেছিলাম ভর দুপুর হতে)যাইহোক সবাই বিউটি পার্লার যায় হাতে পায়ে সুন্দর করে নক্সাদার মেহেদী লাগাতে কিন্তু আমার নিজের মেহেদী পঁচা ঘঁচা যাই হোক আমি নিজেই লাগাবো সেটাই আমার মজা।
ডানহাত দিয়ে বামহাতে মেহেদী লাগানো সোজা
কিন্তু বাম হাত দিয়ে ডানহাতে । উফ কি যে কষ্ট!!
তারপর দুহাতে মেহেদী লাগানো শেষে
অন্যান্যবারের মত আমি কিন্তু পরীরাজ্যে বসেও ভুলিনি ঈদের জন্য নানা রকম মেনু বানাতে। আমি একজন ভালো কুক একথা আমার পাড়াপড়শী আত্নীয় স্বজন সবাই জানে। অবশ্য এই ব্লগের বিখ্যাত পাচক কালপুরুষ ভাইয়া, স্বপ্নজয় ভাইয়া, মনজুরুল ভাইয়া, পেটুক কৌশিক ভাইয়া ও সুরন্জনা আপুনি, শ্রাবনসন্ধ্যা আপুনি, নির্ঝরিণী আপুনি, সহেলী মনি ও আরো অন্যান্য পুরোনো আপুনি ভাইয়ারা যারা আছেন তারাও জানেন সেসব।
আমার ঈদের দিনের নিজ হাতে বানানো সব মেন্যু
ফিরনি, সেমাই ও জর্দার সাথে সাথে ..........
আমার স্পেশাল দইবড়া
চিকেন বল ও শাশলিক
মোগলাই পরোটা
গোলাপ ফুল সাদা পোলাও
কক কক আস্ত মুরগীর রোস্ট
প্যাকপ্যাক হাসের ছানা আলুর কিমার চপ
স্মোকড জাতীয় হিলসার মজা
মোরোগ পোলাও
ইলিশ পোলাও
ব্রাউনী
পুডিং
যাইহোক এবার আসি ঈদ শপিং এ। আমি কেনো যেন প্রতি ঈদে অন্যদের জন্য যেমন উপহার দিয়ে মজা পাই আবার নানু দাদু মামা খালা ফুপিদের উপহার নিয়েও তেমনি মজা পাই কিন্তু সবচাইতে মজা করে আমি নিজে একটা ঈদের জামা বা শাড়ি কিনি যেটা একদম নিজের টাকায়। সেটা আমি খুবই এনজয় করি।
এবারে সেটার গল্পই বলি।অনেক অনেকদিন আমার ভাইয়া আপুনিদের সাথে আমার গল্প হয়না । আমি আমার পুরোনো দিনগুলো খুব খুব মিস করি।
যাইহোক ফুপির জন্য একটা স্পেশাল শাড়ি কিনতে গেছিলাম। উনার স্টার ওয়ার্ল্ডের ডিসকাউন্ট কার্ড আছে সেই সুবাদে। নিজের জন্য কিছু কেনার জন্য না কিন্তু । তবুও দোকানী আমাকে যখন বললো,
: আপা আপনার জন্য একটা শাড়ী দেখাই?
আমি বললাম : না না আমি পরে কিনবো।
কিন্তু দোকানী কোথা থেকে যেন টেনে বের করলো এমন একটা শাড়ী যেটা দেখে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম দোকানী এত বড় মনোবিজ্ঞানী হলো কবে থেকে যে ঠিক আমার মনের মত একটা ময়ুরকন্ঠী রঙের ঝলমলে শাড়ি বের করে দিলো!
শাড়িটার রঙটা এমন যেনো ময়ুরের পেখম। শাড়িটা দেখেই আমি মনে মনে গুন গুন....ময়ুরকন্ঠী রাতের নীলে .. আকাশে তারাদের ঐ মিছিলে.. তুমি আমি আজ চলো চলে যাই ...শুধু দুজনে মিলে......
একটু নাড়া দিলেই বেগুনি , নীল, সবুজ গোলাপি আভা। আমি মুগ্ধ হলাম, আমি মুগ্ধ হলাম! । নেটের শাড়ি হওয়ায় একটু ট্রান্সপারেন্ট ভাব থাকায় চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু আফটার অল আমি একজন ক্রিয়েটিভ পারসন , একথা আমার সব ভাইয়া আপুনিরা এক বাক্যে নিশ্চয় স্বীকার করবেন কাজেই আমি খুব সুন্দর ভাবেই ম্যনেজ করে ফেললাম সব কিছু । সব ভুলে নিয়ে ফেললাম ঐ ময়ুরের পেখম এর মত ময়ুরকন্ঠি রঙ শাড়িটা।
শাড়িটা নিয়ে ফিরে আসার সময় চোখে পড়লো এমন একটা ব্যাগ যা শুধু ঐ শাড়িটার জন্যই তৈরী। যেন শাড়িটার পাড় দিয়েই বানানো হয়েছে সেটা আমার জন্যই।
তারপর চুড়ির দোকানে গিয়ে বেছে বেছে বের করলাম সব ময়ুরকন্ঠি রঙ চুড়ি।
যাইহোক এসব কেনাকাটা শেষ হবার পর সবশেষে সুগন্ধি. অনেক বেছে বেছে এই সুগন্ধিটাই পছন্দ হলো আমার। অবশ্য ময়ুর ময়ুর এই বোতলটার জন্য।
এই আনন্দের ঈদে সুগন্ধি না হলে কি চলে বলো ভাইয়া আপুনিরা?
চুড়ি মালা দুল ব্যাগ সব হয়ে যাবার পর মনে পড়লো আমার রাজকুমারের কথা। সামনেই মুন বুটিকের দোতলায় রেমন্ডে ঢু মারলাম ।কিন্তু আমি কই পাই এমন ময়ুরকন্ঠি রঙ শাড়ির যোগ্য জুড়ি? তাই ভাবলাম আরো দু একদিন সময় নিয়ে ভেবে দেখি ।
তারপর ঘুরে ঘুরে রাজ কুমারের যোগ্য একটা পোষাকও মনে ধরলোনা আমার। শেষে আবার সেই স্টার ওয়ার্ল্ড। ওখানেই পেলাম মনের মত শার্ট প্যান্ট ফতুয়া স্যান্ডেল।
রাজকুমারের জন্য রাজকীয় ফতুয়া।
এবারে আমাকে স্টার ওয়ার্ল্ডের ভুতে পেয়েছিলো .....
তবে সবকিছু কেনাকাটির পর আমার রাজকুমার বললো
-তোমার ঐ অদৃশ্য ভুত, অদৃশ্যে আমার গলাটা কেঁটে নিয়েছে। এখন কাঁটা গলায় এসব পরি কি করে?
আমার এত কষ্ট করে শাড়ি গয়না, পোষাক খুঁজে খুঁজে বের করার পরে এমন কথা কি সহ্য হয় কারো? :
যাইহোক এই সব পাত্তা দিলে কি আর পরী হওয়া যায় ? নাকি সেই ছোট্ট বেলার মত আনন্দে মাতা যায়?
তাই সব ভুলে মেতে উঠলাম ঈদের আনন্দে।
তবে মিস করেছি গত বছরের ইফতারী পোস্ট গুলো, মাসজুড়ে নানারকম ভার্চুয়াল ঈদ গিফট পোস্টগুলো তবুও রক্ষা নীল দর্পন আপুনিটা আর রেজোয়ানামনি আর সুরন্জনা আপুনি ঈদ গিফট পোস্ট আর ইফতারী পোস্ট দিয়ে এই ব্লগের ঐতিহ্য রক্ষা করেছে।
আমার নতুন ভাইয়া আপুনিদেরকে সবশেষে বলতে চাই, সবখানেই কিছু ঐতিহ্য থাকে তা নতুনেরা টেনে নিয়ে যায় তেমনি আমার মনে হয় রমজান মাসে এই ব্লগে ইফতার আর ঈদ গিফট পোস্টও মজাদার এক ঐতিহ্য।
যাইহোক নতুন পুরোনো সবাইকে পরীরাজ্য হতে ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
আজকাল ৩টা ভাইয়া তাদের বিভিন্ন নিক থেকে আমাকে মাইনাস দিয়ে যায়। একটু একটু রাগ লাগে তবুও ঈদের আনন্দে সব ভুলে সব্বার জন্য রইলো ঈদের একরাশ শুভেচ্ছা।