কিছুদিন আগে ব্লগার আনোয়ার সাদীর একটা কমেন্ট থেকে ভাবছিলাম "আমি ও আমার নাচ" নিয়ে কিছু লিখবো।ভাবতে ভাবতে আর রোযা, সপিং আর তার চাইতেও বেশী ঘুরাঘুরি নিয়ে সময়টা বেশী কাটিয়ে ফেল্লাম। তাই এই বিষয়ে লিখতে একটু দেরী হয়ে গেলো।
খুব ছোটোবেলায় স্কুলে যাবার আগে থেকেই আমার নাচে হাতেখড়ি।আচ্ছা লেখাপড়া শেখার শুরুকে হাতেখড়ি বলা যায় আর নাচ শেখার শুরুকে কি বলা যায়?নিশ্চয়ই পায়ে খড়ি বা পায়ে নুপুর না। যাই হোক আমার মা টিভিতে একটা পিচ্ছি মেয়ের নাচ দেখে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে ঐ মুহুর্তে নাকি সিদ্ধান্ত নিলেন, উনার মেয়েকে নাচ শেখাবেন ই শেখাবেন।
তো সেই অনুযায়ী পরদিন থেকেই আমাকে বাসার পাশেই এক নাচ শিক্ষিকার বাসায় পাঠানো হল। সপ্তাহে ৩ দিন উনি আমাকে নাচের তালিম দিতে লাগলেন।তখন আমার বয়স চার বছর।প্লে গ্রুপেও ভর্তি হইনি। আজকাল অবশ্য সাড়ে তিন বছরেই বাচ্চারা স্কুলে যায়। আমি গিয়েছিলাম সাড়ে চারে।
এই ভাবে নাচের তালিমের এক মাসের মাথায় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা অরুণাদিদি এক অনুস্ঠানে আমাকে নাচ করাবার জন্য নিয়ে গেলেন। অনুস্ঠান টা কোনো এক প্রতিস্ঠানের প্রতিস্ঠাবার্ষিকী ছিলো।
আমি তখনো স্টেজে নাচের কিছুই জানতাম না। তার আগে মনে হয় কাউকে স্টেজে নাচতেও দেখেছি কিনা সন্দেহ।
যাইহোক মা আমাকে কুচি কুচি করে ঘাগরীর মত করে মায়ের নিজের একখানা শাড়ী পরিয়ে দিলেন। মায়ের সবথেকে লোভনীয়(আমার কাছে) দামী লিপস্টিক(যে লিপস্টিক মায়ের অগোচরে সুযোগ পেলেই নাড়াচাড়া করতাম।চুপিচুপি ঠোটে লাগিয়ে তাড়াতাড়ি মুছে ফেলতাম) লাগিয়ে দিলেন। ঐ লিপস্টিক দিয়েই টিপ পরিয়ে দিলেন।(পরে প্রতিবার নাচের সাজের সময়ই আমার ঐ দিনটির কথা মনে পড়ে।এখন কত ধরণের টিপ কাজল চোখের সাজ মুখের সাজ করি। অথচ সেই সাজের আনন্দটুকু মনে হয় কোনোটার সাথেই তুলনা করা যায়না।)গলায় পরিয়ে দিলেন মায়ের সাতনরী হার, কানে টিপদুল। কারণ তখনও আমার কান ফোঁড়ানো হয়নি। এইভাবে হাতে চুড়ী , পায়ে আলতা দিয়ে সেজে গুজে মহাসমারোহে আমি নাচ করতে গেলাম।
যথারীতি আমার সময় এলো। অডিয়েন্সের প্রথম সারিতে মা বসে। আমি স্টেজে উঠে ভুলে গেলাম আমাকে এই খানে চুপ থাকতে হবে। পাকা অভিনেত্রীর মত মাকেও না চেনার ভান করতে হবে।সব ভুলে আমি মাকে দেখে খুশীতে "মা" বলে চিল্লিয়ে উঠলাম । হাত নেড়ে মায়ের দৃস্টি আকর্ষনের চেস্টা করতে লাগলাম।মা আমার ভাব সাবে অন্যদিকে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কিন্তু আমি মা কেনো দেখছেনা এই দুঃখে আরো বেশী জোর গলায় মাকে ডাকতে শুরু করলাম। শেষে মা চোখ পাকিয়ে ঠোটে তর্জনী দেখিয়ে ইশারা করতে আমার মনে পড়ে গেলো স্টেজে উঠে এই সব বাচ্চামী করা নিষেধ।আমি সাবধান হয়ে গেলাম।
তারপর মিউজিকের সাথে নাচ শুরু হলো। নাচটা ছিলো "নাচময়ুরী নাচরে, রুমঝুমাঝুম বাজরে।" তো নাচের প্রথম প্যারা ভালো ই হল কিন্তু সেকেন্ড প্যারা শুরু হতেই আমার খুব কান চুলকোতে লাগলো। আমি নাচ থামিয়ে কান চুলকাতে শুরু করলাম। এই দিকে হাসির রোল উঠলো। আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই।কান চুলকানো থামলে, আবার ইচ্ছে মত নাচ শুরু করলাম।
কিছুক্ষন পরে আবার মনে হল ঘাগরীর গিট টা ঠিক আছে কিনা দেখে নেই। তো সেটাও নাচ থামিয়ে পরখ করে নিলাম।এইভাবে দর্শক শ্রোতাদের কে নাচ দেখিয়ে আনন্দ দেবার বদলে বলতে গেলে এক রকম কৌতুক দেখিয়ে আমি সেদিন আনন্দ দিলাম।
এর পরে বাড়ী ফিরতে সবাই যখন আমার নাচ নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো তখনই শুধু বুঝে গেলাম নাচের সময় যতই কান নাক গলা চুলকাক , চুলের খোপা কানের দুল, নুপুর খুলে পড়ে যাক কিছুতেই নাচ থামানো চলবেনা।
এই হল আমার জীবনের স্টেজে প্রথম নাচের অভিজ্ঞতা ।
এর পরে আর জীবনে কখনও এমন ভুল হয়নি। তবে আজকাল দেখি আমার থেকেও কতত পিচ্চি বাচ্চারা একটুও বাচ্চামী না করে নির্ভুল ভাবে নাচ করে যায়।তখন আমার পুরানো সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। খুব দুঃখ হয়। ভাবি আমি এত গাধা ছিলাম কেনো?
ইদানিং কালের একটা পিচ্চির নাচের লিন্ক দিলাম । পিচ্চিটা একটুও ভুল করেনি।এদেরকে দেখে আমার পুরানো দিনের দুঃখ মাঝে মাঝে উথলে ওঠে।আবারও ভাবি আমি এত গাধা ছিলাম কেনো?
http://www.youtube.com/watch?v=2Nd-CoGRuqw