এক্সট্রাঅরডিনারি ও সুপারলেটিভ ব্রিলিয়ান্স বোঝাতে ইংরেজি শব্দভান্ডারে একটি সুন্দর শব্দ আছে 'প্রডিজি'। অথচ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বিবেচনায় পৃথিবীর ছয় নম্বর ভাষা বাংলায় এমন কোন যুতসই প্রতিশব্দই নেই যা এই প্রডিজি শব্দের ঠিক অনুবাদ করতে পারে। বেশিরভাগ অভিধানে এই শব্দের বাংলা দেয়া দৈত্য, দানব ইত্যাদি। তবে পৃথিবীতে ক্ষণজন্মা কিছু মানুষ আছেন যাদের প্রতিভা সত্যিকার অর্থেই দানবসুলভ। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, বেথভেন কিংবা জোহান স্যাবেস্টিয়ান বাখ, এই ক্ষণজন্মা লিস্টিতে আছে এরকম অনেক নাম। হয় আমাদের বঙ্গ দেশে প্রডিজি কম ছিল অথবা প্রতিভাবানদের কদর এতটাই কম ছিল যে এরকম কোনো শব্দের প্রয়োজনীয়তাই কখনো তৈরি হয়নি। আমার মনে হয় কদর কম ছিল, কারণ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং এই বিশেষ ক্যাটাগরিতে পড়েন। শুধু কবিতা বা গানের জন্যই নয় তিনি তার এক জীবনে যত কাজ করেছেন, যত ধরনের কাজ করেছেন ইতিহাসে তা সত্যি বিরল। প্রথম জীবনের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন তাঁর গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন, বলতে গেলে এটি ছিল তার প্রথম পেশা। নিম্ন মাধ্যমিকের পর হলেন মক্তবের শিক্ষক। হাজী পালোয়ানের মাজারের খাদেম হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
এরপর চলে গেলেন লেটো গানের দলে। গান লিখতেন, নাচতেন, পথে প্রান্তরে হই হই করে চলতেন। সেখান থেকে আবার যোগ দিলেন বাসুদেবের কবিগানের দলে কবিয়াল হিসাবে। কিছুদিন কাজ করেছেন খানসামা হিসাবে এক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের ওখানে। যে হাত দিয়ে কবিতা লিখেছেন সেই হাত দিয়ে বানিয়েছেন রুটি, আসানসোলে এক ছোট্ট চা-রুটির হোটেলে। ছাত্রজীবন শেষ না করেই হুট করে যোগদান করেছেন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক হিসাবে। সৈনিক জীবন শেষে কাজ করেছেন সাংবাদিকতার, লিখেছেন গান, কবিতা, গল্প। এমনকি রাজনৈতিক নেতা হিসাবে অংশ নিয়েছেন নির্বাচনে। বিপ্লবী হিসাবে খেটেছেন জেল। চলচ্চিত্রে ব্যাপক আগ্রহ ছিল কাজী সাহেবের। চলচ্চিত্রে অভিনয়, পরিচালনা, স্ক্রিপ্ট রাইটিং, সঙ্গীত পরিচালনা কি করেন নি!
একজন মানুষ মাত্র ৩৪ বছরের কর্ম জীবনে এতকিছু কিভাবে করতে পেরেছেন?
শেষ করি একটি ছোট্ট গল্প দিয়ে। আঠারশ শতকের দিকে তুরস্কের ইশকাদার শহরের মহিলারা পুরুষ সচিব রাখতে পারতেন। মহিলারা তাদের পুরুষ সচিবদের সাথে যেখানে ইচ্ছা ঘুরতে যেতে পারতেন। ১৮৫৩ সালে ক্রিমিয়া যুদ্ধ লেগে গেলে সুলতান আবদেল মেচিদ ঘোষণা করলেন, পুরুষ সচিবদের পোশাক ফ্রকের মতো করতে হবে। যাতে তাদের পেছনে বাহুল্য খরচ কমানো যায়। ফ্রকপরিহিত এই পুরুষ সচিবদের সৌন্দর্য নিয়ে একটি বিখ্যাত তুর্কী লোকগীতি আছে। গানটির নাম 'কাটিবিম'। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজী নজরুলের ক্যাম্প পড়ে তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের কাছে ইশকাদার শহরে। পুরো তুরস্ক তখন মাতোয়ারা 'কাটিবিম' নামের এই গানে। ধারণা করা হয় আমাদের কাজী নজরুল কোনো এক সময় এই গানটি শুনে ছিলেন এবং গানটির সুর তাঁর যথেষ্ট মনে ধরেছিল।
বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরার পর পরই তিনি এই সুরেই লিখে ফেলেন তাঁর বিখ্যাত দু'টি গান ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ এবং ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’।
২৪ মে ছিল কাজী সাহেবের ১২৪ তম জন্মদিন, এক দিন পর হলেও গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্বরণ করছি বাংলার এই মহান 'প্রডিজি'-কে।
পুনশ্চঃ আমার কল্পনায় কাজী নজরুল যেমন একজন তরুন যোদ্ধা, যিঁনি মানে না কো কোন আইন--- যিঁনি ভীম ভাসমান মাইন! তেমনি একজন প্রবল প্রেমিক কবি, যিঁনি তাঁর প্রিয়তমার খোঁপার বাঁধনে মন আটকিয়ে ফেলেছেন।
কাজী নজরুলের অবয়বে এ দু'টি কাল্পনিক ছবি আমি তৈরি করেছি এআই দিয়ে। বলাবাহুল্য, শতভাগ এক্যুরেসি কোনভাবেই দাবী করছি না।
— নভেল #নিক্স ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
ধানমন্ডি, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২৩ রাত ২:২৮