কয়েক বছর আগের কথা। এক কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে খেতে গিয়েছি। চমৎকার ব্যবস্থা। অতিথির সংখ্যা কম। প্রচুর আয়োজন। থালা-বাসনগুলো পরিচ্ছন্ন। যারা পোলাও খাবেন না তাঁদের জন্য সরু চালের ভাতের ব্যবস্থা। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু বিদেশি মানুষও আছেন। তাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী। দেখাবার মত কোনও অনুষ্ঠান নেই বলে কন্যা-কর্তা খানিকটা বিব্রত। এটা যে শুধু খাওয়ার অনুষ্ঠান তা বলতে বোধহয় কন্যা-কর্তার খারাপ লাগছে। বিদেশিরা যতবারই জানতে চাচ্ছে, মূল অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে? তত বারই তাঁদের বলা হচ্ছে, হবে হবে।
আসলে আমদের উৎসব গুলোই এমন। সবাই চাই মহা উৎসাহে উদযাপন করতে। ভাবি অনেক অনেক মজা করব। কিন্তু উৎসবের নির্দিষ্ট অনেকগুলো অনুষ্ঠানমালা না থাকায় মজার এক্সপেকটেশন খুব কম সময়ই পূরণ হয়। যেমন, ঈদ এর দিন যাবতীয় মজা ঈদ নামাজ কে কেন্দ্র করে ঈদগাহ পর্যন্তই। ঈদগাহ থেকে বাসায় এসে ঈদ সেলামী তোলার পর ঈদ ঈদ ভাবটা কেমন জানি কমতে থাকে। বাসার মুরুব্বিরা হয়ত প্রতি দিনের মতই আড্ডা দিচ্ছে। পার্থক্য শুধু ঈদের দিন পায়জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি (গরমে পাঞ্জাবী গায়ে রাখা দুষ্কর, তাই মনে হয়) পরে বাড়ির সামনে যেখানে নরমালি কখনো বসা হয় না সেখানে চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসে টুকটাক কথা বার্তা চালানো হচ্ছে। খানিক বাদে বাদে একটু সেমাই বা চা চাখা হচ্ছে। সিগারেট জ্বালানো হচ্ছে। একজন আরেকজন কে প্যাকেট খুলে সিগারেট সাধছেন, কিন্তু অন্যান্য দিনের মত কেউ প্যাকেটে হাত দিচ্ছে না, সবার পকেটে সিগারেটের ইনটেক প্যাকেট। 'চাঁনরাত' এ গ্যাস ভরানো লাইটার।
বাসার গৃহিনী-সমাজ হয়ত মাত্রই রান্না-বান্না মোটামুটি কমপ্লিট করে গোসলে ঢুকেছেন কিংবা নতুন শাড়ি পড়ে অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কেউ আসছে না দেখে ফোনে মায়ের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। কী কী রান্না করেছেন এবং কোনটা এবারের ঈদে তাঁর রান্না করা হিট আইটেম হবে তা জানাচ্ছেন।
বাসার পিচ্চি-পাচ্চির ঈদ নামাজের পরক্ষনে একটাই আনন্দ, একটাই লক্ষ্য 'ঈদী কালেকশান'। বাচ্চা-সমাজে ঈদের দিনের মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি নির্ভর করে নতুন নোটের সংখ্যার উপর মোট টাকার পরিমাণের উপরে না।
যহুরের নামাজের আগ পর্যন্ত ঈদী আদায় 'অধিকার' পর্যায়ে থাকে তারপর ধীরে ধীরে তা মুরুব্বিদের মুডের উপর নির্ভর করা শুরু করে। তাই বাচ্চা সমাজে ঈদের দিনের মান সম্মান রক্ষার্থে পিচ্চি-পাচ্চির টার্গেট থাকে যহুর নামাযের আগেই কার্য সমাধা করা।
একটি প্রচলিত কথা আছে, ঈদে ছোটরা সব থেকে বেশি আনন্দ করে। বাস্তবে এমনটা না, বস্তুত ঈদে সবাই ছুটি কাটালেও পিচ্চি-পাচ্চিরা এদিন কঠোর সংগ্রাম করে, এ সংগ্রাম মান-সম্মান বাঁচানোর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম ঈদী কালেকশানের।
আরেকটু 'নেদা' বয়সের বাচ্চাদের সব আনন্দ ঠিকরে পড়ে মোড়ের আইসক্রিমের দোকানটায়। যেখানে কখনো একলা যাওয়া হয়নি এর আগে। দোকানে গিয়ে দোকানদার আংকেলকে যে কয়টি আইসক্রিম পছন্দ তা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ায় হলো তাঁদের ঈদ আনন্দ যেখানে কিঞ্চিৎ মিশে থাকে প্রথম স্বাধীনতা লাভের সুখানন্দ।
অবশ্য আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে একটু লজ্জা লজ্জাও লাগে। মনে হয়, লাস্ট টাইম আব্বু বা আম্মুর সাথে যখন এসেছিলাম তখন একটু খেয়াল করে আইসক্রিমের নামগুলো মনে রাখা উচিত ছিল। এখন হয়ত আইসক্রিম আঙ্কেল ভাববে আমি এই প্রথম আইসক্রিম খাচ্ছি তাই নাম বলতে পারছি না। ধুর আগে আইসক্রিম খাই,, গলে যাচ্ছে। আহা ঈদ!
ঈদের দিন তরুণ সমাজ খুবই কনফিউজড থাকে। তাঁরা চায় ঈদের দিনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে তাঁরা কড়ায় গণ্ডায় মজা উসুল করবে। কিন্তু কিভাবে করবে তা বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত মোড়ের চায়ের দোকানটার কাছে ডেক সেট (বড় স্পিকার যুক্ত মিউজিক প্লেয়ার) বের করে ইমরান হাশমীর 'কাহো না কাহো' শোনে আর ভাবে ঈদ টা শেষ হয়ে যাচ্ছে আরও দু'একদিন থাকলে জমতো।
এই ভাবা ভাবির মধ্যেই হয়ত মহল্লার কোনও এক সুন্দরী তরুণী বান্ধবীদের নিয়ে হেঁটে যায়। ঈদের দিন দুপুরে প্রায় ঘুমিয়ে পড়া তরুণ সমাজের মনে হঠাৎ ঈদের অনাবিল আনন্দ উকি দেয়। তরুণদের কেও হয়ত স্টাইল করে বাইক নিয়ে তরুণীদের পথ আটকায়।
বন্ধুদের চাপে পড়ে বলে দেয় বহুদিনের জমানো কথাটি।
ঈদের দিনের নখ, দন্তহীন কিঞ্চিৎ ইভ টিজিং আবার জানান দেয় আজ ঈদ।
সকলের ঈদ অনেক মজার এবং আনন্দময় হোক। ঈদ মোবারক।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২০ রাত ১১:১৭