শান্তিপ্রিয় মানুষটি মরে গিয়েও আর শান্তি পাচ্ছেন না। ১৬ হাজার মাইল থেকে উড়ে এসেও খুব সহজে ঠাঁই পাননি মাটির আশ্রয়ে। এত টানাহেঁচড়ার পর সব যখন শান্ত হবে, সবাই যখন বলতে শুরু করবে ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি মহৎ/ তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার, বারংবার’—তখন শুরু হলো নতুন নাটক।
প্রথমে এক ঘণ্টার, তারপর দীর্ঘ ধারাবাহিক, এখন শুরু হয়েছে ডেইলি সোপ। প্রতিদিনের নাটক। নতুন নতুন নাটকের কাহিনি তৈরি হচ্ছে আর উদ্ধার করা হচ্ছে নতুন করে তাঁর মৃত্যুরহস্য। কথা উঠছে, তাঁর একান্ত স্বজনেরাই নাকি তাঁকে অবহেলায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুল হাসপাতাল থেকে সাশ্রয়ী হাসপাতালে লেখক সুস্থ অবস্থায় স্বেচ্ছায় কেন স্থানান্তরিত হলেন, সেটা নিয়েও এসব মায়াকান্নাকারীর বিলাপের শেষ নেই। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন চিকিৎসা-ছুটিতে লেখক যখন দেশে আসেন, তখন তো নিজের মুখেই হাসপাতাল স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়টিকে যথাযথ সিদ্ধান্ত বলেই বহুবার তাঁর বন্ধুমহলে বলেছিলেন।
স্লোয়ান-ক্যাটারিং মেমোরিয়াল নামের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই ক্যানসার হাসপাতালে এই লেখককে যদি সম্পূর্ণ চিকিৎসা নিতে হতো, তাহলে পুরো সময়ের জন্য এর বিল আসত বাংলাদেশি টাকায় ২০ থেকে ৩০ কোটি। এ তথ্য জানা গেছে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের কাছ থেকে, সেখানে বাংলাদেশের একজন লেখকের পক্ষে তাঁর সমূহ সঞ্চয় খরচ করেও এর চিকিৎসা ব্যয় মেটানো সম্ভব হতো না। আর যেহেতু তিনি মানুষের কাছে হাত পাতার মতো কেউ ছিলেন না, এমনকি সরকারি সাহায্যও ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেখানে যদি হাসপাতালের কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় তিনি সাশ্রয়ী চিকিৎসাসেবা নিয়েও থাকেন, সে জন্য কেন তাঁকে অভিযুক্ত করা হবে? ছোটখাটো রাগ-অভিমান-অনুযোগ নিয়ে কেউ কেউ বিষোদ্গার করেছেন ফেসবুক-ব্লগে। প্রিয় মানুষের হারিয়ে যাওয়ার এই শোক ভুলতে গিয়ে একে অন্যকে দোষারোপও হয়তো করেছেন, কিন্তু তাঁর একান্ত প্রিয়জনেরা ‘ষড়যন্ত্র করে’ তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে এবং এ কথা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে—এমন কেন?
একজন লেখক, তিনি যতটা না তাঁর পরিবারের, তার চেয়ে বেশি পাঠকের। কিন্তু আমরা কয়েক দিন ধরে এই লেখককে একটি পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে ফেলে সেই লেখকের মহান সত্তাকে অনেক বেশি খেলনা বানিয়ে ফেলছি। আমরা আর কত ফেলনা হতে দেব এই মহান লেখককে?
এই ডিজিটাল বিশ্বপাড়ায় নাগরিকেরা এখন কেউ কারও চেয়ে কোনো দূরত্বেই অবস্থান করেন না। সামান্য আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ হয়তো নিজের অজান্তেই এমন ধূম্রজাল সৃষ্টি করে থাকেন, সেটা কী পরিমাণ ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে, তা হয়তো চিন্তাও করেন না।
প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মৃত্যুচিন্তার কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক উপন্যাসের শুরুতে ‘আলেকজান্ডার পোপ’-এর কয়েক ছত্র ব্যবহার করেছিলেন। লাইনগুলো ছিল এমন—
‘When I am dead, dearest
Sing no song for me,
Plant thou no roses at my head
Nor shady cypress tree.’
বোঝাই যাচ্ছে, খুব নীরবে, নিভৃতে, একান্তে শুয়ে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি।
তাঁর শেষের দিকে আত্মজৈবনিক গ্রন্থ কাঠপেন্সিল—এও ‘অসুখ’ নামক একটা অধ্যায়েও তাঁর এই চিন্তার প্রকাশ ঘটেছিল। (পৃষ্ঠা-৭৫)
‘...আমার উচিত, কাগজ-কলম নিয়ে এপিটাফ লিখে ফেলা। কল্পনায় দেখছি, নুহাশপল্লীর সবুজের মধ্যে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবর। তার গায়ে লেখা—
‘চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে
নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।’
আসুন, লোকটিকে আমরা শান্তিতে ঘুমাতে দিই।
শাকুর মজিদ: স্থপতি ও লেখক।
View this link