[থিম্পু শহর]
এখন আমর থান্ডার ড্রাগনের দেশ ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে। ঢাকা থেকে প্রায় ৫৭৫ কিলোমিটার দূরে স্নিগ্ধ সকালে থিম্পু শহরের ওয়াংচুক রিসোর্টে বসে সকালের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছি। রোহদুহডেনড্রান আর জাকারানদাহ ফুলের সমারোহ জানান দিচ্ছে শীতের শেষে বসন্তের আগমনী বার্তা। বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো শীত শেষে এখন নবযুবা। সকালের সূর্যের আলোকচ্ছটায় পাহাড়গুলো দীপ্তি ছড়ায়, আহ্ কী অপূর্ব দৃশ্য ! শুধু থিম্পু নয়, সমগ্র ভুটান জুড়েই পাহাড়কণ্যা তার রুপের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আসুন ঘুরে আসা যাক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত ভুটান থেকে।
ভুপৃষ্ট থেকে ৭৩৭৫ ফুট উচ্চতায় এই ছোট্ট থিম্পু শহরটি ছবির মতোই সাজানো গোছানো। ঠিক শহরের মাঝে পাহাড়ী নদী থিম্পু চু। এই নদীকে ঘিরেই থিম্পু জনপদ। রাজধানী শহর অথচ বিশাল অট্টলিকা নেই, ট্রাফিক জ্যাম নেই, জনসংখ্যার আধিক্য নেই। কোলাহলমূখর ঢাকার তুলনায় এই থিম্পু শান্ত স্নিগ্ধ একটা শহর। শহরের বাড়ী-ঘর, বৌদ্ধমঠ, ঝকঝকে রাস্তা-ঘাট সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ থিম্পু শহরটিই পর্যটকদের জন্য বেশ আকর্ষণীয়। এখানে বাড়ীগুলো ইট-কাঠের তৈরি, দুই তলা অথবা তিন তলা বাড়ীগুলোতে টিনের ছাদ আর প্রতি বাড়ীতেই Zorig Chosum চিত্রকর্মের ছোঁয়া। সারা ভুটান জুড়েই এই Zorig Chosum চিত্রকর্মের দেখা মেলে। Zorig Chosum আসলে পাহাড়কণ্যা হিমালয়ের প্রতিকৃতি। ভুটানে স্থাপনা মানেই একেকটা শিল্পকর্ম। শিল্পের ভাবনায় ড্রাগন, ড্রুক, আধতিক চিহ্নে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভুটানের অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের গল্প। ভুটানের প্রবেশদ্বার, বৌদ্ধমঠ, জং, রেস্তোরা, সরকারী ভবন- সব স্থাপনায় শৈল্পিক ছোঁয়া। এরা এদের পোশাকে, বাড়ীর আঙ্গিনায়, জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখেছে। ভুটানিদের ছেলেদের জাতীয় পোশাককে বলা হয় ঘো, হাটু পর্যন্ত লম্বা মোজা আর গাউনের সংমিশ্রণ। ভুটানিদের মেয়েদের জাতীয় পোশাক কিরা, অনেকটা গাউন আর স্কার্টের সংমিশ্রণ। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হাল ফ্যাশানের জিন্স, টি-শার্ট, স্নিকার পরে তরুন-তরুনীদের ভুটানের রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়। এই বসন্তের সকালে ভুটানের তাপমাত্রা আনুমানিক ৫-৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস অথচ এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ট্রাউজার আর টি-শার্টে তরুন ভুটানিদের থিম্পুর রাস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে দেখা যায়। শীতটা উপভোগ করতে পারলে থিম্পু শহরে ঘুরে বেড়ানো দারুন উপভোগ্য।
শহরতো নয় যেন অনেক বড় একটা ইকো পার্ক। থিম্পু চু নদীর তীরে সবুজ গালিচার অ্যাথলেটিক ট্রাক 'চ্যাংলিংকথ্যাঙ্ক স্টেডিয়াম' তো স্বপ্নের মতো সুন্দর একটি স্টেডিয়াম। ঠিক শহরের মাঝখানে টাইম স্কয়ার, টাইম স্কয়ারকে ঘিরে মুক্ত মঞ্চ, ভুপৃষ্ট থেকে ১০২০০ ফুট উচ্চতায় বিবিএস টাওয়ার থেকে একপলকে সম্পূর্ণ থিম্পু শহর, থিম্পু শহরে ঢোকার মুখে সবার উপর দূর পাহাড়ের মাথায় স্থাপিত সুবিশাল আর্শিবাদ ভঙ্গিতে বসে থাকা বৌদ্ধমূর্তি; সবমিলিয়ে থিম্পু অনিন্দ্য সুন্দর একটা শহর।
আমরা এখন যাচ্ছি ভুটানের পুনাখা শহরে। থিম্পু শহরে থেকে পুনাখার দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার। পুনাখার যাওয়ার পথে আমরা যাত্রাবিরতি করি দোচুলায়। দোচুলা ভুটানিদের পূণ্য ভূমি। অসংখ্য ধর্মীয় নকশাখচিত ছোট ছোট ধর্মীয় পতাকায় দোচুলা ছেয়ে আছে। দোচুলায় মূল আকর্ষণ এখানকার বৌদ্ধমঠ। খাড়া পাহাড়ের উপর বিশাল বৌদ্ধমঠ; বৌদ্ধমঠটি স্থাপত্যশৈলী আর শিল্পশৈলীর নজরকারা স্থাপনা। ভ্রমণার্থী আর পূণ্যার্থীদের ভিড়ে বৌদ্ধমঠটি বেশ জনসমাগম। ভুপৃষ্ট থেকে ১০০৩১ ফুট উচ্চতায় এই দোচুলায় এসে দেখা মিলল ঐ দূরে হিমালয় পবর্তশৃঙ্গের রেখা। দোচুলায় সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে দেয় ১০৮টি chorten। ২০০৪ সালে ভুটানের জ্যোষ্টতম রাণীমাতা আশী দরযী ওয়াংমো ওয়াংচুক দক্ষিণ ভুটানে আসাম বিদ্রোহে মারা যাওয়া শহীদের স্মরণে এই ১০৮টি chorten স্তম্ভ তৈরী করেন। কাঠের তৈরী এই chorten গুলোতে বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, ভুটানের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের পরম স্পর্শ। দোচুলায় দেখা মিলল আমাদের মতো অসংখ্য সৌন্দর্য্য পিপাসু অনেক বিদেশী পর্যটক। কথা হচ্ছিল ব্রাজিলের দুই মধ্যবয়স্ক মহিলা পর্যটকের সাথে। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তারা বলল, 'ওহ, আমি তো বাংলাদেশকে চিনি। তোমরা ক্রিকেটে অনেক ভালো..।' ব্রাজিলের মহিলা পর্যটকের কথাশুনে তো আমি থ। মনে মনে ধণ্যবাদ দিই সাকিব বাহিনীকে। তাদের সাফল্যের খবর ফুটবল পাগল ব্রাজিলেও পৌঁছে গেছে। সাকিব বাহিনীর সাফল্য বিশ্বকে চিনিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু হতাশ করলো, এক ফরাসী পর্যটক, 'তিনি বলেন, বাংলাদেশ? বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কি?'
অল্প সময়ে দোচুলার স্মৃতি ডিজিটাল ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে আমরা ট্যুরিস্ট কোস্টারে উঠে পড়লাম। দোচুলা থেকে পুনাখার দূরত্ব মাত্র ৪১ কিলোমিটার। কিন্তু এই অল্প দূরত্ব অতিক্রম করতেই প্রায় তিনঘন্টা লেগে গেল। পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করতে করতে ক্লান্ত মন পুনাখা জং-এ এসে চঞ্চল হয়ে উঠলো। সহদর নদী মো চু আর ফো চু। নদী দুটি যেখান এসে মিশেছে ঠিক সেইখানে দুই নদীকে ঘিরে পুনাখা জং। দূর থেকে নদীর সঙ্গমস্থল আর পুনাখা জং-এর প্যানারোমা দৃশ্য অসাধারণ। এই পুনাখা জং-কে বলা আনন্দপ্রম প্রাসাদ। এটি আসলে পুনাখার প্রশাসনিক ভবন। ৬০০ ফুট সুদীর্ঘ এই জংটি তৈরী হয় সেই ১৬৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ভুটানের প্রথম রাজা উজেন ওয়াংচুক এই পুনাখা জং থেকেই তার রাজত্ব পরিচালনা শুরু করেন। বর্তমানে ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ এই পুনাখা জং-টি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শীতকালীন বাসস্থান। ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা দানের সবচেয়ে বড় আশ্রম।
[পুনাখা জং]
প্রায় তিন তলা সমান পাথর আর কাঠের পাটাতনের সিড়ি বেয়ে আমরা পুনাখা জং এর মূল স্থাপনায় প্রবেশ করলাম। মূল ভবনটিও কাঠের। ভবনের দেয়াল জুড়েই বিশ্বাস আর ধর্মীয় অনুভুতির চিত্রকর্ম। পুনাখা জং-এ প্রবেশমাত্র দেয়ালের ডান দিকে চোখে পড়ে বিখ্যাত বৌদ্ধজ্যোতিষ চিত্র। ভারত আর চীনা শিল্পের সংমিশ্রণ এই জ্যোতিষচিত্রটি মানুষের জীবন ছবি। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বেঁচে থাকার গুর রহস্যই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই চিত্রটিতে। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই একটি খোলা করিডোর। করিডোরকে ঘিরে চারিদিকে দুইতলা সমান স্থাপনা, ছোট ছোট অসংখ্য ঘর আর ঘরের প্রতিটি স্থান জুড়েই শিল্পের পরম ছোঁয়া।
[The Kuenrey মন্দির]
জং-এর শেষপ্রান্তে রয়েছে The Kuenrey মন্দিরে ঘ্যানমগ্ন বুদ্ধর সুবিশাল মূর্তি। বুদ্ধর একপাশে দ্বিতীয় বৌদ্ধ শিষ্য গুরু আর অন্য পাশে ভুটানের প্রতিষ্ঠাতা ঝাবদরাং এর মূর্তি। দর্শনার্থিরা ভক্তিভরে বুদ্ধকে প্রণাম করছে। আর প্রণাম শেষে বুদ্ধর পায়ের কাছে পাত্রে রাখা তৈল নিয়ে মাথায় ছোয়ায়। বাহ, ভালো তো; প্রণাম শেষেই বুদ্ধর আর্শিবাদ কপাল স্পর্শ করা। মন্দিরের মূল আকর্ষণ বুদ্ধের জীবনচিত্র। মন্দিরের দেয়াল জুড়ে চিত্রকর্মগুলো ১২টি পর্বে বুদ্ধের জীবন আর বৌদ্ধধর্মের বুৎপত্তির ইতিহাস তুলে ধরে হয়েছে। যারা ফটোগ্রাফি ভালো বাসেন, ফটোগ্রাফির প্রতি আলাদা ঝোঁক আমি নিশ্চিত পুনাখা জং-এ এসে তাদের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠবে। এখানে ফটোগ্রাফির বিষয়বস্তুর অভাব নেই। রোদের আলো যখন পুনাখা জং-এর উপর পড়ে তখন জংটি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সারা জং জুড়েই কেমন লালচে-কমলা আভা। লাল কাপড় আর ন্যাড়া মাথার যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও হতে পারে অন্যরকম আকর্ষণ। এরা মিতভাষী কিন্তু যথেষ্টই অতিথিপরায়ন। ভিক্ষুদের সাথে ছবি তোলার অনুরোধ করতেই তারা সানন্দে রাজি হয়ে যায়। পুনাখার জং-এর শৈল্পিকতা, স্বচ্ছ জলের বহতা পাহাড়ী নদী, নদীর উপরে কাঠের ঝুলন্ত সেতু, সব মিলিয়ে পুনাখা জং আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করলো।
বিকালবেলা গোধুলির ঠিক আগমূহুর্তে আমরা আবারো থিম্পু শহরে ফিরে এলাম। বিদেশে এসেছি। প্রিয়জনদের জন্য সুভ্যেনুর হিসাবে কিছুতো কেনাকাটা করতে হয়। কিন্তু বিধিবাম। জিনিসের এত্তো দাম। ভুটানের নিজস্ব সুতি কাপর, কাঠের তৈজস, কাজের তৈরী নকশী পণ্য, চিত্রকর্ম, মুখোশগুলো বেশ প্রসিদ্ধ কিন্তু এতো দাম যে খালি হাতেই ফিরতে হলো। একটু মনখারাপ তো হলোই, রাগও হলো। কিছুই করার নাই। শুন্য হাতেই ওয়াংচুক রিসোর্টে ফিরে এলাম।
দেখে এলাম থান্ডার ড্রাগনের দেশ-২