'মূল' শব্দের বিশেষণ হলো 'মৌল'। মূল মানে শেকড়, আসল কারণ, উৎস, ভিত্তি। আর মৌল অর্থ মূল সংক্রান্ত, মূলোৎপন্ন। কাজেই মৌলবাদ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উৎসলগ্ন চিন্তা। একটা উদাহরণ দিই। আমি যুক্তি দিয়ে বলেছিলাম যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। একজন পাঠক আপত্তি করলেন। বললেন, ধর্মনিরপেক্ষ না হলে তো সাম্প্রদায়িক হতে হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন নি। পারার কথাও নয়, কারণ তিনি বাইরের প্রথা আর পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন নি।
চিন্তার জগতে বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করার নামই মৌলবাদ। অমৌল প্রভাব-বৃত্ত থেকে বের করে আনবার উদ্দেশ্যে আমি তাঁকে বলি -- দেখুন, মানুষ এ কারণেই নিরপেক্ষ হতে পারে না যে সে মানুষ। কিন্তু একটা পিস্তল নিরপেক্ষ। পুলিশ অপরাধীকে লক্ষ্য করে ট্রিগার চাপলে সে যেমন কাজ করে, তেমনি কাজ করে দস্যু কোনো শিল্পপতিকে গুলি ছুঁড়লেও। এ নিরপেক্ষতার কারণ চিন্তার অনুপস্থিতি। কিন্তু মানুষ চিন্তা করে এবং এই প্রক্রিয়ায় সে ভালো ও মন্দ দু'টোর একটিকে বেছে নেয়। সচেতন সিদ্ধান্ত ছাড়াও এ পক্ষাবলম্বন ঘটতে পারে। আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেন, কিংবা অবিশ্বাস, নতুবা সন্দেহ -- এ তিনের বাইরে যেতে পারবেন না। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা খুবই অবান্তর। কাজেই আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে নিতান্ত উন্মাদ না হলে কোনো মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না।
আসলে মৌলবাদ পরিচ্ছন্ন ও গভীর অর্থদ্যোতক একটি শব্দ। ভুল জায়গায় ব্যবহার করে করে একে আমরা কলুষিত করে ফেলেছি। সাহিত্যিকদের কাছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচে' মূল্যবান সম্পদ শব্দমালা। স্থূল লেখকদের ভুলে শব্দের ওপর এই অত্যাচারে তাঁরা ব্যথিত হন। রবীন্দ্রনাথ শব্দপ্রয়োগে কৃপণের মতো হিসেবি ছিলেন, অথচ সেই তিনিই লিখেছেন সবচে' বেশি। কাজেই সতর্ক শব্দবোধ লেখালেখির কোনও বাধা নয়। এখানে রবীন্দ্রালোচনার প্রাসঙ্গিকতা হলো, তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচে' মৌলবাদী লেখক এবং সে কারণেই সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল।
অনেকদিন আগে আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারটি পড়েছিলাম, আমার মনে পড়ছে যে সেখানে তাঁরা দু'জন বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতের মৌল তত্ত্ব আলোচনা করেছিলেন। মৌলবাদী বিজ্ঞানী ছিলেন বলেই আইনস্টাইন সৃজনশীল বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন। তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব হলো পরম মৌলবাদী বিজ্ঞান-তত্ত্ব। একইভাবে সক্রেটিস, গাযালী, ইবনে সীনা -- সবাই ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে মৌলবাদী এবং এ কারণেই তাঁদের আমরা পেয়েছি কীর্তিমান মহাপুরুষ হিসেবে।