সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের সময় রামপুরা বিলে পাকিস্তানিদের ব্রাশফায়ারে ডান হাতের ৩টা আঙ্গুল ভেঙ্গে গর্ত হয়ে যায় তার। পচন থেকে হাত থেকে বাঁচাতে আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে। ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে ছেলেটা বলল-
"দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ…"
ডানহাতি স্টাইলিশ ওপেনার আর উইকেটকিপার হিসেবে আজাদ বয়েজ, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনসিয়াল দলের হয়ে আক্রমনাত্মক ব্যাটিংয়ে নিয়মিত মাঠ মাতাতো সে। পূর্ব পাকিস্তান তথা সমগ্র পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান। সে সময় তার মত ভাল “স্লগ সুইপ” আর কেউ খেলতে পারত না। ঢাকা, ইষ্ট পাকিস্তান ও ইষ্ট পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে প্রথম শ্রেণীর সাতটি ম্যাচ খেলে ২১ দশমিক ৫৮ গড়ে ২৫৯ রান করে সে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ক্রিকেটারদের পক্ষে এই রান ছিল উল্লেখযোগ্য কিন্তু যোগ্যতা থাকলেও পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলার সুযোগ ছিল না সেই সময়ের বাঙালি ক্রিকেটারদের। পাকিস্তান নামক দেশটায় বাঙালিদের অবস্থান গোলামের সমতুল্য বা তারও নিচে, তাই দেশের হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা থাকা সত্বেও ছেলেটা সুযোগ পায়নি। অথচ ছেলেটার স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলার ন্যাশনাল টিমে ওপেনিং করার। সেসময় ক্রিকেট নিবেদিত প্রাণ মুশতাক আহমেদ এর হাতে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান এর ক্রিকেট অঙ্গনের জনপ্রিয় 'আজাদ বয়েজ ক্লাব'। এই আজাদ বয়েজ ক্লাবের আক্রমণাত্মক ওপেনার ছেলেটা। মুশতাক আহমেদের প্রতি তার ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ।
ছেলেটা জাতীয় অনূর্ধ-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলেছে। ১৯৭০ সালের ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা ষ্টেডিয়ামে ইষ্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের হয়ে ঢাকা এডুকেশন বোর্ডের বিপক্ষে খেলে। ৩ দিনের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২৫ রান করে। ম্যাচটি ড্র হয়। ১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা ষ্টেডিয়ামে লাহোর দলের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচ খেলে। ৩ দিনের ফাইনালে প্রথম ম্যাচে ২৩ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ রান করে। ম্যাচটি ড্র হয়। এসে যায় উত্তাল ৭১। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা টেস্টে রকিবুল হাসান তার ব্যাট এ “জয় বাংলা” লেখা স্টিকার লাগিয়ে ক্রিকেট ময়দানে প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্থানি হানাদাররা এদেশে শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। এই গণহত্যা থেকে রেহাই পাননি ক্রিকেট সংগঠক মুশতাক আহমেদও। পাকিস্তানিদের বুলেট ঝাঝড়া করে দেয় তার শরীর। ক্লাব অন্ত:প্রান মানুষটির মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় ঢাকা ডিভিশন স্পোর্টস এসোসিয়েশন এর প্যাভিলিয়নের একটি ঘরে। দুদিন এভাবেই অবহেলায় হয়ে পড়ে ছিল তার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ মুশতাক আহমেদের লাশ দেখার পর ছেলেটার বুকের ভিতর অনুভূত হয় দেশের জন্য লড়ার তাগিদ। ব্যাট-প্যাড তুলে রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হাতে নেয় স্টেনগান। শুরুতে মায়ের কাছ থেকে বাঁধা এলেও ঠিকই ৩১ মে বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রশিক্ষনের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে পাড়ি জমায়। যাওয়ার আগে নিজের ফ্রেমে বাঁধানো এক ছবির সাথে মাকে চিঠি লিখে যায় - ‘আমি যখন থাকব না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।’
২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে ১৭ জন তরুনকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে গঠন করা হয় "ক্র্যাক প্লাটুন"। ছেলেটা এই ১৭ জনেরই একজন ছিল। ঢাকার ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী সহ একাধিক এলাকায় অতর্কিত হামলায় অংশ নেয় সে।
আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ধ্বংসের অপারেশনে অংশ নেয় ছেলেটা, পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হাতের আঙুলে গুলিবিদ্ধ হয়। আহত হয়ে ছেলেটা বড় মগবাজারে আজাদ এর বাসায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রাজাকার মারফত খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তান হানাদারদের কাছে। ২৯ আগস্ট ধরা পড়ে যায় সে। ছেলেটার ভাঙ্গা ৩টা আঙ্গুল ধরে মোচড়াতে মোচড়াতে নিয়ে যায় পাকিরা। টর্চার সেলে অমানষিক অত্যাচার করা হয়, প্লায়ার্স দিয়ে মুচড়ে দেওয়া হয় ভাঙ্গা আঙ্গুল, বুটের নিচে আঙ্গুল পিষে প্রশ্ন করা হয় কোথায় থেকে মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং নেয়, কোথায় থেকে আর্মস আসে। তবুও মুখ খোলেনা সে, ভাঙ্গা আঙ্গুলে হাতুড়ির বাড়ি সহ্য করে, উত্তর না পেয়ে যখন হানাদার বাহিনী বেয়নেট দিয়ে আঙ্গুল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফালা ফালা করে তখনও প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করে, কখনো চিৎকার করে মাকে ডাকে, কখনো জ্ঞান হারায় তবুও বলেনা সহযোদ্ধাদের পরিচয়, ঘাটি। বেঈমানী করেনি দলের সাথে, দেশের সাথে। ছেলেটার বুক ফাটা আর্তনাদে ভারী হতে থাকে ঢাকার আকাশ, সেই আর্তনাদে মিলিয়ে যেতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে চাওয়া এক ক্রিকেটারের স্বপ্ন।
হ্যাঁ বলছি শহীদ বীর বিক্রম আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল (শহীদ জুয়েল) এর কথা। আজ এই ছেলেটার জন্মদিন। ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার ওয়াজেদ চৌধুরী-ফিরোজা বেগম এর ২য় সন্তান হিসেবে জন্ম নেয় সে। ১৯৭১ এর ৩১ আগষ্টের পর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি জুয়েলের। ধারণা করা হয় ৩১ আগষ্টেই তাকে মেরে ফেলা হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু স্বাধীন দেশের ন্যাশনাল টিমে আর ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে নামার সুযোগ হল না জুয়েলের, ফিরল না সে মাঠের ২২ গজের পিচে।
মুক্তিযুদ্ধে জুয়েলের বীরত্বের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরনোত্তর “বীর বিক্রম” খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারী গেজেটে জুয়েলের বীরত্বভূষন সনদ নম্বর ১৪৮। শহীদ জুয়েল আর শহীদ মুশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৭০ দশক থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর শহীদ মুশতাক একাদশ vs শহীদ জুয়েল একাদশ নামে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে। ক্রিকেট বিশ্বে স্বাধীন বাংলাদেশের পদচারনা, বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া, ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ আয়োজন কিংবা ক্রিকেটকে ঘিরে সারা দেশের মানুষের একেই ছাদের নীচে আসা, কিছুই দেখা হয়নি শহীদ জুয়েল-মুশতাকদের। এই দুই শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম-এ দুটি স্ট্যান্ড এর নাম রাখা হয় শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড এবং শহীদ মুশতাক স্ট্যান্ড।
আজকে শহীদ জুয়েলের জন্মদিনে আমি এই লেখাটা উৎসর্গ করতে চাই তাদের যারা পাকি পতাকা নিয়ে স্টেডিয়ামে যেয়ে পাকিস্তান, পাকিস্তান বলে চিল্লায় কিংবা পাকিস্তান সমর্থনের জন্য যারা লজিক দেয় 'খেলার সাথে রাজনীতি না মেশাই'।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৪১