আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে বাংলাদেশে মেগালিথিক সংস্কৃতির প্রত্নস্থান রয়েছে। আবার অনেকই হয়তো বিদেশের মেগালিথিক গুলো দেখে একটু অবাকই হই, আর মনে মনে ভাবি কি ভাবে এই বড় বড় পাথর খন্ড গুলো খাড়া করে মাটিতে পুতে এই ধরণের সৌধ নির্মান করা হয়েছিল এবং কি কারণে এই সৌধগুলো নির্মান করা হয়েছিল?
মেগালিথিক সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তাদের ধারণা দেয়ার জন্য সুপরিচিত একটি মেগালিথিক এর উদাহরণ দেই।
এটি একটি মেগালিথিক প্রত্নস্থান... আশা করি এই ছবিটি অনেকেই দেখেছেন।
সমাধি সৌধ বা স্মারক সৌধ হিসেবে প্রাচীন কালে মেগালিথিক নির্মান করা হতো। অর্থাৎ কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কবরকে চিহ্নত করে রাখার জন্য অথবা কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য মেগালিথিক সৌধগুলো নির্মান করা হতো।
মেগালিথিক বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে, যেমন- মেনহির, ডলমেন, স্টোন সারকেল, মাল্টিপল হুডস্টোন ইত্যাদি। বাংলাদেশে মাত্র দুই ধরণের মেগালিথিক দেখা যায়- ডলমেন ও মেনহির ।
এটি একটি মেনহির
এটি একটি ডলমেন
এটি স্টোন সারকেল
মাল্টিপল হুড স্টোন সারকেল
এই বার নিশ্চয় মেগালিথিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হয়েছে।
বাংলাদেশের মেগালিথিক:
বাংলাদেশের একমাত্র সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় এই মেগালিথিক সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যায়। জৈন্তাপুর উপজেলায় তিনটি মেগালিথিক প্রত্নস্থান রয়েছে। যারা ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য এই প্রত্নস্থান গুলোর অবস্থান বলে দিচ্ছি।
১. জয়ন্তশ্বরী মন্দির অঞ্চল=
জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে উপজেলা হেডকোয়ার্টারের দিকে দুই মিনিট হাটলেই ববে মেগালিথিকের দেখা পাওয়া যাবে। অথবা বাস থেকে নেমে যে কাউকেই জিজ্ঞাসা করলেই বলে দিবে এর অবস্থান। এই মেগালিথিক প্রত্নস্থানটি জয়ন্তশ্বরী মন্দিরের সামনেই অবস্থিত। এখানে একটি রাস্তা রয়েছে এই রাস্তার দুই পাশে আরো দুইটি মেগালিথিক প্রত্নস্থান রয়েছে। বর্তমানে এখানে ২০টি মেনহির ও ২৬ টি ডলমেন রয়েছে। তবে এগুলোর অবস্থা খুব একটা ভাল না।
জয়ন্তশ্বরী মন্দিরের সামনের মেনহির ও ডলমেন
জয়ন্তশ্বরী মন্দিরের সামনের রাস্তার পশ্চিম পাশে অবস্থিত মেগালিথিক প্রত্নস্থান। এখানে ডলমেন ও মেনহির রয়েছে
একটি বিশালাকৃতির ডলমেন
এখানে অবস্থিত বিশালাকৃত্রির একটি মেনহির
২. মুক্তার পুর অঞ্চল=
জয়ন্তশ্বরী মন্দিরের আনুমানিক দেড় কিলোমিটার উত্তরে নয়াগাঙের উত্তর পারে এই সৌধ গুলো অবস্থিত। বর্তমানে এখানে তিনটি মেনহির ও চারটি ডলমেন রয়েছে। স্থানী লোকেদের মুখে শোনা যায় এখানে কোন এক রাজকুমারীর সমাধি রয়েছে।
মুক্তারপুরের ডলমেন ও মেনহির
৩. খাসিয়া পল্লী অঞ্চল=
জয়ন্তশ্বরী মন্দির হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে নিজপাটে এই সৌধ গুলো অবস্থিত। এক কথায় বলতে গেলে জৈন্তাপুর উপজেলার অফিস থেকে মাত্র ২ মিনিট পশ্চিম দিকে হাটলেই এই প্রত্নস্থানের দেখা পাওয়া যাবে।
খাসিয়া পল্লীতে অবস্থিত মেগালিথ
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে , পূর্বে এই অঞ্চলে খাশিয়া রাজাদের শাসন বিদ্যমান ছিল। খাসিয়া ধর্মমতে যদি কেউ মারা যেত তাদের কবর দেয়ার জন্য এই ধরণের পাথরের সমাধি সৌধ নির্মান করা হতো। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা বড় বড় পাথর দিয়ে সমাধি সৌধ তৈরি করতে পারত না। তাই তারা সমাধি সৌধ তৈরি করতে ছোট ছোট পাথর ব্যবহার করত। কিন্তু যাদের অবস্থা ভাল ছিল তারা বড় বড় পাথর ব্যবহার করত সমাধি সৌধ তৈরি করতে। বর্তমানে এই অঞ্চলে আদি খাসিয়া ধর্ম আর নেই , অধিকাংশ খাসিয়াই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাই এখন আর এই ধরণের সমাধি সৌধ নির্মান করতে দেখা যায় না। তবে আসামের খাসিয়ারা এখনো এই ধরণের সমাধি সৌধ নির্মান করে থাকেন । আর এ থেকেই ধারণা করা হয় যে - এই সৌধ গুলো খাসিয়া নির্মিত সমাধি সৌধৈ।
জনশ্রুতি:
প্রত্যেকটি প্রাচীন স্থাপনার পিছনেই স্থানীয় মানুষের কিছু কথা থাকে, এখানেও আছে। স্থানীয়দের মতে এটি রাজার রাজকার্যের জন্য ব্যবহার করা হতো। সবচেয়ে বড় ডলমেনটিতে রাজা বসতেন এবং অপেক্ষাকৃত ছোট গুলোতে আঞ্চলিক প্রধানরা বসতেন।
আবার অন্য মতে, বলা হয় যে- এখানে বসে রাজ কর্মচারীরা খাজনা আদায় করতেন।
তবে মুক্তারপুর অঞ্চলের সৌধ সম্পর্কে স্থানীয় লোকেদের মুখে শোনা যায় যে- এখানে কোন এক রাজ কুমারীর সমাধি রয়েছে।
বর্তমান অবস্থা:
বাংলাদেশের একমাত্র মেগালিথিক প্রত্স্থান সকলের কাছে পরিচিত নয়। অধিকাংশ মেগালিথিকের অবস্থায় খুবই শোচনীয়। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শুধু মাত্র একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। এমনও মেগালিথি স্থান রয়েছে যেখানে পশ্রাব ও পায়খানার জন্য যাওয়াই দুষ্কর। সরকার যদি এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে তবে সিলেট অঞ্চলে ভ্রমণ কারী অনেক লোকই এই মেগালিথিক গুলো দেখে বিষ্মিতই হবে।
কি ভাবে যাবেন?
প্রথমে সিলেট যাবেন , সেখান থেকে জাফলং যে বাসগুলো যায় সেগুলো যে কোন একটি তে উঠে যাবেন। হেলপার কে বলে রাখবেন যে জৈন্তাপুর নামব। জৈন্তাপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে যে কাউকেই জিজ্ঞাসা করলে বলে দিবে কোন দিকে যেত হবে।