খাজুরাহো মন্দিরকে ভারতের অন্যতম সৌন্দর্য্যমন্ডিত মন্দির হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিল্পের দিক থেকে বিবেচনা করলে এই ধরনের মন্দির ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই অঞ্চলে অনেক গুলো মন্দির রয়েছে তাই এই মন্দিরকে গুচ্ছ খাজুরাহো মন্দির বলা হয়। এই মন্দিরকে Temple of Love বলা হয়, কারণ এখানে দেবতাদের ভালবাসার প্রতিকৃতি কারুকার্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বনাথ মন্দির , খাজুরাহোর অন্যতম মন্দির
বিশ্বনাথ মন্দির উৎকীর্ণ দেবতাদের উল্লাসের প্রতিকৃতি
খাজুরাহো মন্দিরটি ভারতের মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত এবং এটি ইনেষ্কোর এর অন্যতম হেরিটেজ সাইট। খাজুরাহোর মন্দির গুলো নির্মিত হয়েছিল চান্দেলা রাজবংশের সময়। এই মন্দির গুলো নির্মিত হয়েছিল ৯৫০-১০৫০ সালের মধ্যে। ঐতিহাসিক সূত্রমতে জানা যায়,- এই মন্দির গুলো ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৮৫ টি মন্দির বিস্তৃত ছিল।কিন্তু বর্তমানে ২০টি মন্দির টিকে আছে।মুসলিম শাসনের সূচনার দিকে এই মন্দির গুলোর অধিকাংশই ধ্বংশ করা হয়। এখানে যে মন্দির গুলো রয়েছে সেগুলো মূলত হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির।
লক্ষী মন্দির
লক্ষী মন্দিরে উৎকীর্ণ প্যানেল শিল্প
ইতিহাসঃ
খাজুরাহো মন্দিরের নির্মানের ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। ঐতিহাসিক আবু রিহান আল-বেরুনী ও ইবনে বতুতার বর্ণনা তেকে এই মন্দির সম্পর্কে কিছু মাত্র ধারণা পাওয়া যায়। ১০২২ সালে আল বেরুনী মাহামুদ গজনীর সাথে ভারত বর্ষে এসে ছিলেন মন্দির লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয় নি। এই অঞ্চলের রাজা তাদের সাথে শান্তি চুক্তি করেন। আল বেরুনী তার এই অভিযানের বিবরনীতে এই মন্দির গুলোর কথা উল্লেখ করেন। ধারণা করা হয় ১২ শতাব্দী পর্যন্ত এই মন্দির গুলো অক্ষত ছিল। ১৩ শতকে চান্দেল রাজ্য কুতুব উদ্দিন আইবেকের অধীনে আসে। ঠিক এর ১০০ বছর পর ইবনে বতুতা এই অঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং তার ভ্রমণ বিবরণীতে বলেছেন- এই মন্দির গুলোতে যোগ গুরু থাকত এবং সাধারণ মানুষ তাদের কাছ থেকে যোগ শিক্ষা নিত।
কান্দারী মহাদেব মন্দির
জগদম্বী মন্দির
ঐতিহাসিক তেমন কোন নথি না থাকায় এই মন্দির নির্মানের উদ্দেশ্য কি ছিল সে সম্পর্কে জানা যায় না। তবে এই মন্দির গুলো নির্মান প্রসঙ্গে বিভিন্ন মিথ প্রচলিত আছে। যদি এই মিথ গুলোকে সত্য ধরা হয় তবে এর উদ্দেশ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে অল্প ধারণা পাওয়া যায়।
পর্শ্বনাথ মন্দির
মিথঃ
বলা হয়ে থাকে বারানসীর এক ব্রহ্মণের এক অনিন্দ্য সুন্দরী কন্যা ছিল। তার নাম হেম্বতী। কিন্তু ব্রাহ্মণের এই কন্য খুব অল্প বয়সেই বিধবা হয়। জ্যোস্নাশোভিত গ্রীষ্মের রাতে এই বিধবা কন্যা পদ্মপুকুরে স্নান করতে গেলে চন্দ্র দেবতা তার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়েন। পরে চন্দ দেবতা মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন, এবং তারা দুই জনে একে অন্যের সাথে মিলিত হন। যখন তাদের মোহ কাটে তখন চন্দ্র দেবতা নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং নিজে নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকেন একজন বিধবার সাথে এই ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য। সেই সাথে চন্দ্রদেবতা হেম্বতীতে অর্শিবাদ করেন যে, তার গর্ভে যে সন্তান জন্ম হবে সেই সন্তান হবে সিংহ পুরুষ এবং বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। এই ঘটনার পর হেম্বতী নিজ গৃহ ত্যগ করে খাজুরপুর (খাজুরাহো) তে আসেন এবং এখানে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এই পুত্র সন্তানের নাম রাখেন চন্দ্রবর্মন। চন্দ্রবর্মন এর সাহস ও শক্তি সম্পর্কে বলা হয় যে,- মাত্র ১৬ বছর বয়সে সে খালি হাতে বাঘ ও সিংহ শিকার করতে পারতেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্র দেবতার আর্শিবাদের কারনে এই অঞ্চলের রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তার মায়ের ইচ্চায় এই অঞ্চলে ৮৫টি মন্দির নির্মান করেন। এই মন্দির গুলো লেক ও বাগান দ্বার পরিপূর্ণ ছিল। তিনি খাজুরাহোতে একটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন যাতে তার মায়ের পাপ মোচন হয়।
আদি নাথের জৈন মন্দির
এই মিথটি অন্য এক উৎস থেকে একটু ভিন্ন ভাবে পাওয়া যায, সেটি হলো- হেম্বতী কালিঞ্জার রাজ্যের রাজ ব্রাহ্মণ মনি রামের বিধবা কন্যা। একদিন মনিরাম ভুলবশত আমাবশ্যাকে পূর্ণিমা রাত হিসেবে রাজার সামনে উপস্থাপন করে। এই বিষয়টি হেম্বতী জানার পর অত্যান্ত চিন্তিত হয়ে পাড়েন। বাবার এই ভুলের কারণে বাবার সম্মান যদি নষ্ট হয় তবে হেম্বতী তা সহ্য করতে পারবেন না। তাই তিনি চন্দ্র দেবতার নিকট প্রার্থনা করতে থাকেন। চন্দ্রদেবতা এই রূপ সুন্দরী কিশোরীর রূপে অভিভুত এবং তার প্রেমে পড়ে মনের ইচ্চা পুরণ করেন, এবং তারা একে অন্যের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে যখন মনি রাম এই বিষয়টি জানতে পারেন তখন নিজে নিজেকে অভিশাপ দেন এবং পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়। এরপর হেম্বতী গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, তার নাম রাখেন চন্দ্রতেয় এবং ধারণা করা হয় এই পুত্র সন্তাই পরবর্তীতে চান্দেলা রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা । চান্দেলারা মনিরামের পাথরের মুর্তিটিতে মুনিয়া দেবে নামে পূজা করে থাকেন।
জাবারী মন্দির
বামুন মন্দির
এই অনিন্দ সুন্দর মন্দিরটির অধিকাংশ স্থাপনা, মূর্তি ও টেরাকোটা বেল পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে। এই মন্দির মূলত শিব, বিষ্ণু ও জৈনদের মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাজুরাহো মন্দিরে বিভিন্ন ধরনের মূর্তির প্রতীকৃতি রয়েছে এবং এই মূর্তি বা প্রতীকৃতিরগুলোর মধ্যে মাত্র ১০% যৌনতা নির্ভর। এই মন্দিরকে অনেক পন্ডিতই দেবতাদের প্লে-গ্রাউন্ড বা দেবতাদের যৌন উল্লাসের কেন্দ্র হিসেবে অভিমত দিয়েছেন। তাদের মতে এই মন্দির গুলোতে দেবতাদের সেক্স লাইফ কে তুলে ধরা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন , এই মন্দিরে তান্ত্রিক যৌনতাকে প্রধান্য দেয়া হয়েছে এবং তার প্রতিলিপিই এই মন্দিরে প্রতিফলিত হয়েছে। আবার আরেক দল বিশেষজ্ঞ মনে করেন , হিন্দু ধর্মে ও মানব জীবনে ‘কাম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই ‘কামের’ প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন মন্দিরে এই বিষয় গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
জীবের জীবনে 'কামের' বিষয়টিকে মাথায় রেখেই হয়তো এই মন্দির গুলো নির্মান করা হয়েছিল
অনেকেই মনে করেন , ‘কামসূত্রের’ বিষয়গুলো এখানে প্রতীকী আকারে দেখানো হয়েছে। আবার এটাও বলাহয় যে, চন্দ্রদেবতা ও হেম্বতীর যৌন মিলনকে স্বর্গীয় বিবেচনা করে স্বর্গের দেবতাদের যৌন আকাঙ্খাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মন্দিরের শিল্পকলা যে কামসূত্রদ্বারা প্রভাবিত ছিল তা সহজেই বুঝা যায় এই চিত্রের মাধ্যমে
এই মন্দির গুলোতে যে সকল erotic art কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার মধ্যে- হালকা মেদ যুক্ত কোমর ও উন্নত বক্ষের নারী, যৌন ক্রীড়ারত অবস্থায় বিভিন্ন প্যানেল চিত্র। বিভিন্ন ধরনের যৌন আসন সহ বিভিন্ন প্রতিলিপি। এছাড়া পশুর সাথে যৌনরত অবস্থায় বিভিন্ন মূর্তি। এই মন্দিরে উৎকীর্ণ নারী চরিত্রের কেউ যৌনরত অবস্থায় আবার কেউ চুল ধোয়া অস্থায় আবার কেউ নৃত্যরত অবস্থায় আবার কেউ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা ব্যস্ত। এখানে যে সকল প্যানেল মূর্তি রয়েছে তার মধ্যে নগ্নাবস্থায় নারীরা তাদের সখীদের সাথে আলাপরত, একধিক নারী একজন পুরুষের সাথে যৌন মিলন রত অবস্থায় রয়েছে।
এই চিত্রের মাধ্যমে নারীদের শারীরিক গঠনের বিষয়টি বুঝা যায়।
এই চিত্রেও নারীদের শারীরিক বিষয়টি ফুটে উঠেছে
এছাড়াও এই প্যানেলে বিভিন্ন মিথকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেমন, শিব ও পার্বতীর বিয়ের অনুষ্ঠান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। খাজুরাহো মন্দিরে রাজপুতদের বিভিন্ন ঘটনাকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এছাড়াও সাধারণ মানুষ, কৃষক, বাদকদল, কুমারেরও প্রতিচিত্র রয়েছে। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন পশুপাখি যেমন-সিংহ, বাঘ, ঘোড়া ও পাখির চিত্রও রয়েছে।
মন্দিরে উৎকীর্ণ বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে অন্যতম হাতির প্রতিকৃতি
একটি গরুর মূর্তি
এবং সর্বশেষ....
দেবতাদের স্বর্গীয় উল্লাস ও ভালবাসার একটি ক্লোজ ভিউ যেটি কামসূোত্রর কয়েকটি আসনের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।
সহায়ক তথ্যসূত্র
Khajuraho: Temples, Sculptures, Faith or Erotism
Khajuraho Group of Monuments
History of Khajuraho
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:৪০