আমি গল্পের মানুষ না, আমি প্রত্নতত্ত্বের মানুষ। গল্প ভাল না লাগলে আমি কোন প্রকার দ্বায়িত্ব নিতে রাজী নই। তাই নিজ দ্বায়িত্বে পড়ুন।
আফিসের একটা বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে সিরাজগঞ্জ যেতে হচ্ছে। সেখানে আমার দিন দুয়েক থাকতে হবে। সিরাজগঞ্জ গিয়ে কোথায় থাকব, সেটা নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলম। হঠাৎ আমার মনে পড়েগেল অর্ক’র কথা। ওর বাড়িও সিরাজগঞ্জ। আর আমি যেখানে যেতে চাই সেটাও ওর থানায়। তাই অর্ক’কে ফোন দিলাম, সব কিছু জানার জন্য। আমি যখন ওকে সব কিছু জানালাম তখন অর্ক আমাকে বলল, আরে এটা তো আমার গ্রাম থেকে মাত্র এক গ্রাম পরেই। তুই ইচ্ছে করলে আমার বাড়িতে থাকতে পারিস। তাছাড়া আমার বিশাল বাড়িতে শুধু মাত্র আমার বাবা আর মা থাকে। তুই যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারিস, আমি বলে দিচ্ছি। আমি বললাম, ঠিক আছে তুই বলে দিস আঙ্কেল-আন্টি কে। অর্ক আবার জিজ্ঞাসা করল, কবে যাবি ? আমি জবাবে বললাম- আগামী পরশু, দুই তিন দিন থাকতে হতে পারে। অর্ক আমাকে বলল, আরে কোন সমস্যা নেই,যত দিন ইচ্ছে থাকতে পারিস। আমি বললাম-ঠিক আছে।
আমি ঢাকা থেকে সকাল নয়টার দিকে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অর্ক আগেই আমাকে ফোন করে তার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল। আর বলেছিল, আমাদের গ্রামটা একটু ভিতরের দিকে একটু আগেই রওনা দিস, না হলে কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমি বিকেল সাতে তিনটার দিকে আর্ক’র বাড়ি পৌছালাম। সত্যি অর্ক’র বাড়ি একটু ভিতরের দিকে, যাকে বলে একেবারে বাংলার গ্রাম। অর্কর গ্রামটা অনেক সুন্দর, রাস্তার চারিদিকে কখনো ছোট ছোট বাড়ি, আবার কখনো দিগন্তজুরা ফসলী খেত, আবার রাস্তার দুই ধারে ছোট বড় গাছ।
অর্ক’র বাড়িতে দুইটি ঘর, একটি আধ পাকা, অর্থাৎ ইটের গাঁথুনির সাথে, টিনের চালা, আরেকটি সম্পূর্ণই টিনের ঘর। বাড়িতে বিশাল এক উঠান, উঠানের একপাশে কয়েকটি আম আর কাঠালগাছ। এক কথায় অনেক সুন্দর একটি বাড়ি।
আমি বাড়ির উঠানে পৌছানো মাত্রই ঘর থেকে অর্ক’র মা বেরিয়ে এল, আমাকে দেখেই হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল, বাবা তুমি অর্ক’র বন্ধু? আমি প্রতিউত্তর করলাম, হ্যা,। অর্ক’র মায়ের বয়স হয়েছে, সে খুব একটা চলাফেরা করতে পারে না। তবুও ধীর পায়ে সে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। সে বলল, তুমি আর অর্ক এক সাথে পড়তে, অর্ক তোমার আসার কথা আমাদের ফোনে জানিয়ে দিয়ে ছিল। বাড়িতে খুব একটা মানুষ জন নেই, তাই তোমাকে আনতে যেতে পারিনাই। তা বাবা তোমার আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো। আমি উত্তরে বললাম, না কোন সমস্যা হয় নি।
অর্ক’র মা, আব্দুল কাদের নামে কাউকে ডাকলেন। কাদের এসে সামনে হজির হলো সাথে সাথেই। কাদের কে বলল, তুই এই ব্যাগ গুলো ঘরে নিয়ে যা। কাদের আমার ব্যাগগুলো নিয়ে ঘরের দিকে হাটতে শুরু করল, অর্ক’র মা বলল, যাও বাবা কাদের তোমার ঘর দেখিয়ে দিবে। আমি কাদেরের পিছু পিছু হাটা শুরু করলাম।
ঘরে পৌছে বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লাম, বিশাল এক জার্নি দিতে হয়েছে আজ আমাকে, আর এখানে আসার পথটাও অত সুবিধার না। বাস থেকে নামার পরে একটা লেগুনায় প্রথমে দবীরপুর বাজারে আসতে হয়, সেখান থেকে অর্কদের গ্রাম এই শ্যমপুরে ভ্যান নিয়ে আসতে হয়েছে। রাস্তা ভাল না, ভ্যানে ঝাকি খেতে খেতে শরীর ব্যথা হয়েগেছে। হঠাৎ কাদের বলল, আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন। আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি। কাদের আরো বলল, যদি কিছু লাগে তবে আমাকে ডাকবেন।
কাদের চলে যাওয়ার পর, আমি আমার ব্যগ খুলে কিছু কাপর ও প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে নিলাম। আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথমরুমে ঢুকলাম। হাত-মুখু ধোতে গিয়ে আমি গোসল করেই ফিরলাম, যে পরিমান ধুলা-বালি শরীরে লেগেছে তাতে গোসল না করলে শরীরের মাঝে অলসতা ভর করত।
বাথ রুম থেকে বেরিয়ে দেখি আমার টেবিলের উপর খাবার রাখা আছে। আর কাদের তার পাশে দাড়িয়ে আছে, সে আমাকে বলল, খেয়ে নিন। খাওয়া শুরুর মূহুর্তে আর্ক’র মা, ঘরে ঢুকে, বললেন, বাবা তোমার জন্য বিশেষ কিছু রান্না করতে পারি নাই। আমাদের এই গ্রামে ভাল জিনিস খুব একটা পাওয়া যায় না। তাই তোমার খেতে কষ্ট হতে পারে। আমি টেবিলের উপর চোখ বুলিয়ে বললা, আপনি বলছেন কষ্ট হবে ? আমিও তাই বলি, এতো ধরনের খাবার তো আমি আর একা খেতে পারব না। খেতে গেলে আমারও কষ্ট হবে। আর্ক’র মা আমার কথা শুনে হেসে দিলেন। তিনি আমাকে বললেন, খাও বাবা, আর যদি কিছু লাগে তুমি আমাকেও বলতে পার আবার কাদেরকেও বলতে পার। আমি যতক্ষণ খাচ্ছিলাম, অর্কর মা ততক্ষণ আমার পাশে বসে ছিল, সে আমার প্লেটে এটা দেয়, ওটা দেয়, আমি খাচ্ছি না কেন, লাজ্জা পাচ্ছি কিনা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করছিলেন।
আমার খাওয়া শেষে আর্কর মা বললেন, অনেক দূরে থেকে এসেছ, একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। না হয় শরীর খারপ করবে। আমি বললাম, হ্যা আন্টি আমি একটু বিশ্রাম নিতে হবে।অর্ক’র মা ঘর থেকে বাইরে চলে গেলেন।
আমি বিছানায় গেলাম বিশ্রামের জন্য। চিন্তা ছিল কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব মাত্র, কিন্তু কোন ফাকে যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝলাম না। ঘুম থেকে উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরুলাম। উঠানে দেখি অর্ক’র বাবা দাড়ানো, আমি কিছু বললার আগেই সে বলল,- আমি তোমার ঘরে গিয়ে ছিলাম, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমাকে ডাকি নি। আমি এগিয়ে যেয়ে তাকে ছালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিয়ে আমার খবরাখবর নিতে শুরু করলেন। আমার নাম, কোথায় থাকি, কি করি, কেন এসেছি সবই তিনি এক এক করে জেনে নিলেন।
অর্ক’র বাবা বললেন- তুমি যে গ্রামে কাজে এসেছ সে গ্রাম এখান থেকে এক গ্রাম পরেই। ইচ্ছে করলে তুমি হেটেও যেতে পার, আবার ভ্যানে চড়েও যেতে পার। বাড়িতে কাদের আছে, সেই তোমাকে সব কিছু চিনিয়ে দেবে, তোমার সাথে যাবে।
এর পর অর্ক’র বাবা বলল, তোমার যদি এখন কোন কাজ না থাকে তবে, চল আমরা গ্রামটা একটু ঘুরে আসি, রাতে গ্রাম গুলো আরো অনেক সুন্দর হয়ে যায়। আমি না করতে পারলাম না, তাই রাজী হয়ে গেলাম।
গ্রামের মাঝ খানে একটা চায়ের দোকান আছে। সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে গ্রামবাসী এখানে এসে মিলিত হয়, গল্পে গল্পে মুখরিত হয়ে উঠে এই চায়ের দোকান। এখান দেশ-বিদেশ,রাজনীতি, এমন কিছু নেই যা নিয়ে আলোচনা হয় না এখানে। গ্রামের মানুষগুলো সরল, তাদের সকল ধরণের বিশ্লেষণও সরল। গ্রামের মানুষগুলো এটা সেটা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করল। শহরের কি অবস্থা, শহরের রাজনীতির কি খবর ইত্যাদি ইত্যাদি জেনি নিচ্ছিল গ্রামের মানুষ গুলো।
আমরা ঘুরাঘুরি শেষে-রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাড়িতে এসে পৌছালাম। বাড়িতে এসে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। খেতে বসেও আমরা গল্প করলাম। সন্ধ্যার পর থেকে এ পর্যন্ত অর্ক’র বাবাকে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে লোকটি অত্যান্ত রসির প্রকৃতির। আমি লোকটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, খাওয়া শেষেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। আরো কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছিল তার সাথে। কিন্তু কিছুই করার নেই, আগামীকাল সকালে উঠে আবার কাজে যেতে হবে। তাই আজকের মতে আড্ডার সমাপ্তি দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সাকালের সোনা আলোয় চারিদিক ভরে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সকলটা গ্রামের মতো নয়, শান্ত সুন্দর একটা সকাল। এই সুন্দর সকালটা কে কোন ভাবেই মিস্ করতে চাইছিলাম না, তাই একটু হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে বেরুলাম, গ্রামের রাস্তা হাটব বলে। হাঁটা শেষে ঘরে এসে দেখি আমার টেবিলে খাবার রাখা আছে। আমি বাথ রুমে গেলাম গোসল করার জন্য, গোসল শেষে সকালের নাস্তা খেলাম। তারপর কাজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম এমন সময়, কাদের ঘরে ঢুকে বলে কখন বেরুবেন? আমি জবাবে বললাম, এই তো এক্ষুনি। রেডি হয়ে আমার ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ পত্র নিয়ে ছোট একটা ব্যাগে ঢুকালাম। কাদের বলল, এই ছোট ব্যাগটাই কি নিয়ে যাবেন। আমি উত্তর করলাম-হ্যাঁ। কাদের আমার ব্যগটা হাতে নিয়ে বলল তাহলে চলেন যাত্রা শুরু করি। আমি বললাম- ঠিক আছে চল শুরু করা যাক।
আমি আর কাদের বাইরে বেরুলাম, উঠানে দেখি অর্ক’র মা দাড়িয়ে আছে। তার সাথে দু’একটা কথা বলে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। আমি কাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে থেকে আমাদের যেতে কত সময় লাগবে। কাদের বলল, হেটে গেলে ৩০ মিনিটের মতো লাগবে আর ভ্যানে গেলে লাগবে ১৫ মিনিট। আমি কাদেরকে বললাম- চল হেটেই যাই। গ্রামটাও দেখা যাবে আবার তোমাদের ভ্যানের ঝাকির হাত থেকেও বাচা যাবে। কাদের আমার কথায় সায় দিল।
আমি আর কাদের গ্রাম দেখতে দেখতে হাটছিলম। গ্রামের দৃশ্য গুলো অনেক সুন্দর। মাটির রাস্তা, চারপাশে ছোট বড় গাছ, মাঝে মাঝে দু’ একটা বাড়ি, আবাদী জমি সব মিলিয়ে এক কথায় অনিন্দ্য সুন্দর। হাটছিলাম আর কাদের সাথে দু’ একটা কথাও বলছিলমা। কাদের আমাকে জিজ্ঞাসা করল আপনি কি করেন? আমি বলালাম আমি একটা এজিওতে চাকুরী করি। কাদের আবার জিজ্ঞাসা করল, কি কাজে এসেছেন, আমি বললাম- তোমাদের শ্যওরাপাড়া গ্রামে আমাদের এজিও কিছু ঋণ দিয়েছে সাধারণ মানুষকে যাতে তারা তাদের ভাগ্য ফেরাতে পারে। আমি এসেছি সেটার অগ্রগতি দেখার জন্য। তারা কি এখান থেকে কোন উপকার পাচ্ছে কি না? সেটা দেখার জন্য।
আমার কথা শুনে কাদের কেমন যেন মন মরা হয়েগেল। আমি লক্ষ্য করলাম কাদের আর কোন কথা বলছে না। আমি কাদেরকে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, কিন্তু কাদের উত্তরের জন্য যে কয়টি শব্দ লাগে তার চাইতে আর একটি শব্দও বেশি বলছে না। আমার উত্তর দিয়েই চুপ হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় তার উত্তর হ্যা-না এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল।
কাদেরের সাথে কথা বলতে বলতে আমরা শ্যাওরাপাড়া গ্রামে এসে পৌছালাম। এখানে আমার জন্য আমাদের এনজিওর এরিয়া ম্যানেজার অপেক্ষা করছিল। তার নাম সেলিম। সেলিম আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমার আসতে কোন কষ্ট হয়েছে কি না। সবকিছুই তাকে বললাম, তারপর তাকে বললাম চলেন তাহলে কাজ শুরু করা যাক। তিনি বললেন, হ্যা স্যার, শুরু করা যাক। আমি তাকে বললাম, কোথা থেকে শুরু করব ? তিনি আমাকে বললনে, এই তো সামনেই আমাদের এক সুবিধা ভোগী আছে, সেখান থেকেই শুরু করি।
দুপুরের আগ পর্যন্ত আমার বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোজ খবর নিতে লাগলাম। দু’একটি ছাড়া সবাই ভালই উন্নতি করেছে ঋণের টাকা নিয়ে। দুপুর বেলা সেলিম বলল- স্যার চলুন খাওয়া দাওয়া সেরে নিই। আমি তাকে বললাম- কোথায় খাব? সেলিম বলল- আমার বাড়িতে স্যার। আমি বললাম তাহলে চলুন ক্ষুধাও লেগেছে। আমি, সেলিম আর কাদের সেলিমের বাড়িতে পৌছালাম। খাবার খেতে যেয়ে দেখি- সেলিম সাহেব বিশাল আয়োজন করেছে আমার আগমন উপলক্ষে।
দুপুরের খাওয়া শেষে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজে নেমে পড়লাম। বিকেল বেলা কাজ শেষে আবার গ্রামের রাস্তা ধরে বড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কাদেররে সাথে খুব একটা কথা হয় নি। এই বিকেলেও দেখলাম কাদের কেমন যেন একটু মনমরা। সে আমার সাথে কোনভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না।
বাড়িতে পৌছে হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চলে গেলাম। সারাদিন অনেক হাটার কারণে শরীরটা কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই একটু ঘুমিয়ে নিলাম। রাত আটার দিকে ঘুম থেকে উঠতেই রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। খেয়ে-দেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কাগজ পত্রগুলো বের করে, একটু চোখ ভুলিয়ে নিলাম কোথাও কোন ভুল আছে কিনা সেটাও দেখে নিলাম
রাত এগারটার দিকে ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন সকালে আবার কাদেরকে সাথে নিয়ে শ্যাওড়াপাড়া গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। আমি কাদেরের সাথে খুব একটা কথা বললাম না, যেহেতু কাদের চাচ্ছে না আমার সাথে কথা বলতে, তাই আমিও ওকে আর বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিলাম।সারা দিনের কাজের শেষে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম।
হাটার সময় খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কেন কাদের আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে? তাই কাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম - কি কাদের তুমি মনে হয় আমাকে পছন্দ করছ না? কাদের জবাব দিল কই ? না তো। আমি আবার তাকে বললাম- তাহলে তুমি কেন এতো কম কথা বলছ? মনে হচ্ছে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছ। শুধু যা জিজ্ঞাসা করছি তারই উত্তর দিচ্ছ। কাদের বলল- কোন কারণ নেই, এমনিতেই। আমি বললাম- কারণতো অবশ্যই একটা আছে। একজন মানুষ আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝবে, সেটাতো হয় না। কাদের বল তুমি কেন আমাকে পছন্দ করছ না।
এইবার মনে হলো কাদের একটু নরম হল। কিছুক্ষণ থেমে সে বলল- শুনবেন? আমি বললাম- হ্যা, বল-
কাদের আমাকে বলছিল-- আমি একজন গরীব মানুষ। দিন আনি দিন খাই টাইপের। আবার যদি বলি আমি একটু অলস টাইপেরও। খুব একটা কাজ করতাম না। বউ বাড়ি বাড়ি কাজ করে যা আনত তাই দিয়ে বলা যায় চালিয়ে নিতাম। আমি কাজ না কররা কারণে বউ আমাকে খুব একটা ভালও বাসত না। তারপরও বউ আমাকে বাচিয়ে রেখেছিল। আমার বউ যে বাড়িতে কাজ করত সেই বাড়ির বড় বউ একদিন আমার বউ কে বলল- তোর জামাইরে আর কত দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবি? একটা কাজে লাগিয়ে দে,। বউ বলল, আরে ওরে দিয়া কোন কাজ হইব না। সারাদিন বইসা বইসা ঝিমাইব আর খাইব। বড় বউ তখন বলল, এক কাজ কর, ‘সজাগ’ থেকে কিছু টাকা তুলে একটা গরু কি না দে তোর জামাইরে। হেতো সারা দিন এমনিতে বসে থাকে, তারে একটা গরু দিয়ে বসিয়ে রাখ। বউ কি ভাবে টাকা তুলতে হয় আর কিভাবে ফেরত দিতে হয় সবকিছু জেনে এসে আমাকে বলল, আমিও রাজী হয়ে গেলাম। কিস্তিতে টাকা তুলে একটা গরু কিনলাম। কয়েক মাস পরেই গরুটা বাচ্চা দিত, কিন্তু সবার কপালে কি আর সুখ সয়? আমার গরুটা হঠাৎ একদিন মারা গেল, কিন্তু কি কারণে মারা গেল জানতেও পারলাম না। শুধু যে গরু মরল তা নয় আমাকেও মেরে গেল।
সপ্তাহ শেষে আমাক ২০০টাকা কিস্তি দিতে হতো। এই সংসারে এমনিতেই পেট চলে না, আবার তারপর ২০০টাকার কিস্তি। এযেন মরার উপর খাড়ার ঘা। এক সপ্তাহে কিস্তি দিতে পারত তো দুই সপ্তাহ বাদ যেত। এই ভাবেই চলছিল। মাঝে মাঝে আবার বাড়ি থেকে পালিয়েও থাকতাম। একবার টানা চার সপ্তাহ কিস্তি দিতে পারি নি, পঞ্চম সপ্তাহের কিস্তিও জোগার করতে পারি নি। তাই পঞ্চম সপ্তাহের যেদিন কিস্তি সে দিন আমি আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য বাজারে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসি। বাজারে যাওয়ার সময় পথে কিছু টাকা কুড়িয়ে পেলাম। আমি সাথে সাথে টাকা গুলো লুঙ্গির গিটে ঢুকিয়ে দিলাম।
বাজারের কাছা কাছি আসতেই দেখি আমাদের গ্রামের হযরত আলীর নাতি কাঁদছে আর রাস্তায় কি যেন খুজছে। হযরত আলীর নাতির বয়স বেশি না, ৮-৯ বছর হবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? কি খোজস ? সে আমাকে বলল, আমি টাকা হারাইছি। সে আরো জিজ্ঞাসা করল- আমি কোন টাকা পেয়েছি কি না? আমি কোন কিছু চিন্তা না করেই বললা- না পাই নাই। হযরত আলীর নাতি রাস্তা ধরে হেটে হেটে টাকা খোজতে লাগল। হযরত আলীও আমার মতো গরীব একজন মানুষ। তার ছেলেই তার একমাত্র ভরসা। বারমাস অসুস্থ থাকে সে।
আমি বাজারে সারা দুপুর কাটিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গ্রামে পৌছানো মাত্রই শুনি হযরত আলী মারা গেছে। কিভাবে মারা গেছে জানার পরে খারাপ লাগছিল। হযরত আলীর হাপানী ব্যারাম ছিল। যখন তার হাপানীর টান উঠত তখন মনে হতো এই বুঝি হযরত আলী মারা যাবে। হাপানীর কারণে হযরত আলী যেখানেই যেত, সেখানেই সে তার সাথে ইনহেলার নিয়ে যেত। কিন্তু এই বার হযরত আলীর ইনহেলার শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই তার ছেলের বউ হযরত আলীর নাতিকে দিয়ে ইনহেলার কেনার জন্য বাজারের পাঠায়। কিন্তু ছোট এই ছেলেটা টাকা হারিয়ে ফেলে, টাকা খুজতে খুজতে সে অনেক দেরি করে ফেলে। ইনহেলার না নিয়েই সে বাড়ি যায়। বাড়ি গিয়ে দেখ হযরত আলী মারা গেছে।
এইকথা শুনে আমার নিজেকে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমার কারণেই হযরত আলী মারা গেছে। আমি যদি টাকা গুলো ফিরিয়ে দিতাম, তাহলে হয়তো হযরত আলীকে এভাবে মরতে হতো না।
আমি এতক্ষণ চুপ করে কাদেরের কথা শুনছিলাম। কাদের একটু থেকে বলে, আপনাদের এই এনজিও গুলো মানুষের উপকার করার নাম নিয়ে অনেকেরই অপকার করেছে। আর সেই অপকারিতার শিকার আমি, হযরত আলী।
কাদের আবার বলল, আমার একটা কথা রাখবেন? আমি উত্তরে বললাম- বল রাখার চেষ্টা করব। কাদের বলল- এই কথা শুধু এতো দিন আমি জানতাম, আজ আপনি জানলেন। কথা গুলো কাউকে বলে দিয়েন না। আমি আপনাকে বললাম কারণ আপনি একটা এনজিওর বড় কর্মকর্তা, হয়তো আপনি এটা নিয়ে কিছু একটা করতে পারবেন।
কাদেরের কথা শুনতে শুনতে আমার বাড়ি পৌছে গেলাম। কাদের আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। আমি হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রামের জন্য বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাতে খাবার খেয়ে, কাগজ পত্র নিয়ে বসলাম। দেখলম, কেউ কেউ ভালই উন্নতি করেছে, আবার কেউ কেউ উন্নতি করতে পারে নি। দুই শ্রেণীর লোকই আছে। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম, এই বার ফিরে এটা নিয়ে একটা প্রস্তাব পেশ করব।
পরের দিন সকালে উঠে, আমি রেডি হয়ে গেলাম ঢাকা ফেরার জন্য। বাইরে সবাই অপেক্ষায় আছে বিদায় জানানোর জন্য। সকাল ১০টার দিকে আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাকে এগিয়ে দিতে কাদের আমার সাথে আসল। আমি কাদেরকে বললাম, তোমার কথা গুলো আমি মনে রাখব, দেখি তোমার মতো মানুষের জন্য কিছু করতে পারি কি না। কাদের কিছু বলল না। কাদের আমার সাতে দবীরপুর বাজার পর্যন্ত আসল। আমি কাদর কে ৫০০টাকার একটা নোট দিলাম। কাদের নিতে চাই ছিল না। তবুও জোর করে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। আমি কাদেরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লেগুনায় উঠলাম।
আমি কাদের কে কথা দিয়েছিলাম, তাদের মতো মানুষের জন্য কিছূ একটা করার, কিন্তু করতে পারি নি। আমাদের এনজিও কোম্পানীর মালিক গুলো রক্তচোষার মতো। তারা দরিদ্র মানুষের রক্তচুষে বড় লোক হতে চায়। সমাজের কল্যানের চেয়ে তাদের নিজেদের কল্যানই বড় বিষয় এখানে।