চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ভালোবেসে ফেলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত সুন্দর এই ক্যাম্পাস টিকে।সেই ভালোবাসার তালিকায় যুক্ত
হয়েছে কাম্পাসের অপরিহার্য অঙ্গ শাটল ট্রেন।এই শাটল কে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ বলা যায়।শাটল কে ঘিরে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কত যে সুখ
দুঃখের গল্প জড়িয়ে আছে,তার কোন ইয়াত্তা নেই।তবে এটি যে সবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে,সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল আকর্ষণ হল এই শাটল ট্রেন।১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও কোন শাটল ট্রেন ছিলনা।তখন শিক্ষার্থীদের
যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ছিল বাস,যা বর্তমানে তরী নামে পরিচিত।তবে সেই তরীর সংখ্যা ছিল অপ্রতুল।ফলে দূর দুরান্ত থেকে দৈনন্দিন যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীদের সমস্যার
সম্মুখীন হতে হতো।অবশেষে ১৯৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেন চালু করেন। এই শাটল ট্রেন সমৃদ্ধ
করেছে ইতিহাসের পাতা।কারণ
বর্তমানে বিশ্বের মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শাটল ট্রেন
ব্যবস্থা আছে।একটি হল যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়,এবং অপরটি হল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।এর
আগে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের
সানফ্রানসিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন ব্যবস্থা চালু ছিল।তবে বেশ কিছু সময় আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রতিদিন সকাল ৭.৩০ এবং ৮.০০টায় বটতলী স্টেশন থেকে দুটি শাটল ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে যাত্রা করে।শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সুবিধার জন্য
পথে বিভিন্ন স্টেশনে থামে।প্রতিদিনই সিট ধরার প্রতিযোগিতা চলে।বন্ধুরা মিলে একসাথে মজা করতে করতে ক্যাম্পাসে যাওয়ার
উদ্দেশে একজন একাই অনেক গুলা সিট ধরে রাখে।সেই সাথে গান
বাজনা তো আছেই!শাটলে অন্যান্য গানের পাশাপাশি প্যারোডি গান বেশ জনপ্রিয়।বিভিন্ন জানা অজানা অখ্যাত খ্যাত
বিখ্যাত গানওয়ালারা ট্রেনের দেয়াল চাপড়িয়ে গান করেন।সেই সাথে গলা মেলান বাকি বন্ধুরা।সেই কণ্ঠ সুরেলা হোক
কিংবা বেসুরো,সেটা কোন ব্যাপার না।আনন্দটাই হল মুখ্য।তবে এদের মধ্যে থেকে অনেকেই
হয়তো পরবর্তীতে বিখ্যাত
শিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত
করে তোলেন।সঙ্গীতশিল্পী এস আই
টুটুল,চন্দন সিনহা,পার্থ বড়ুয়া,নাসিম আলী খান,আহমেদ রাজিব প্রমুখ তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এছাড়া শাটলের আরেকটি আকর্ষণ হল এর বগি গুলোর বিচিত্র সব নাম।ফ্যামিলি,সিক্সটি
নাইন,এপিটাফ,অলওয়েজ,খাইটা খা,সি এফ সি,সাম্পান,একাকার ইত্যাদি আরও কত
নাম!!!তবে এই সুন্দর নাম গুলোর অন্তরায় হল বগি ভিত্তিক রাজনীতি।একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা ছাত্রদের বিভিন্ন
দল বগিভিত্তিক রাজনীতির
সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত।এক বগির সমর্থকদের সাথে অন্য বগির সমর্থকদের বিরোধ হরহামেশাই লেগে থাকে।এবং সেই বিরোধ ধ্বংসযজ্ঞে রূপ নিতেও সময় নেয় না।এর মধ্যে গত ২৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন চত্বরে বগিভিত্তিক সংগঠন সিক্সটি নাইন এবং একাকার এর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষের চারজন গুরুতর আহত হয়।বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রমতে,এর আগে গত বছরের ২৯ ও ৩০ এপ্রিল ছাত্রলীগ সমর্থিত শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।এই সব অপ্রীতিকর ঘটনা যে শুধু বিশৃঙ্খলার
সৃষ্টি করে,তা নয়।এর জন্য সৃষ্টি হয় সেশান জট,যা সকল শিক্ষার্থীদের কাছেই অনাকাঙ্খিত।ঘটনা শুধু এখানেই
থেমে নয়,এই সহিংসতা গড়িয়েছে হত্যা পর্যন্ত।তন্মদ্ধে মহিউদ্দিন মাসুম এবং হারুনুর
রশিদ কায়সার হত্যা উল্লেখযোগ্য
এবং চাঞ্চল্যকর।বিবিএ মার্কেটিং ১৬ তম ব্যাচের কায়সার কে হত্যার পর তার লাশ শাটল থেকে ফেলে দেয়া হয়।অপর দিকে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শেষ
বর্ষের ছাত্র মাসুম কে গলা কেটে হত্যার পর তার লাশ ষোলশহর
স্টেশনে ফেলে দেয়া হয়।দুই মাসের ব্যবধানে এ হত্যাকাণ্ড
দুটি ঘটে ২০১০ সালে।সূত্রমতে,নিহত দুইজনই ছিলেন ছাত্রশিবির কর্মী।যে সকল মেধাবী ছাত্রদের হাতের স্পর্শে কলম গর্জে ওঠার কথা,তাদের
হাতেই গর্জে উঠছে ভয়ংকর সব
আগ্নেয়াস্ত্র।কালির বদলে ঝরছে রক্ত।
তবুও অপূর্ব সুন্দর ফুলের মাঝে যেমন কীট থাকে,তেমনি এই সকল অসুন্দর কে বাদ দিলে পরিপূর্ণ দেখায় শাটলের
সৌন্দর্য।আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে যেন ওতপ্রোত
ভাবে জড়িয়ে গেছে এই শাটল ট্রেন।আনন্দ,বেদনা,হাসি,কান্না,ভালোবাসার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বয়ে চলেছে এই
শাটল ট্রেন।এই ইতিহাস দীর্ঘজীবী হোক।
শাটল ট্রেন,তোমায় বড় ভালোবাসি...।।