মাঝে মাঝে যখন কিছু করার থাকেনা তখন চোখ বন্ধ করে সেই ছোটবেলায় ফিরে যাই। আমি কখনই খুব দুরন্ত না, খুব চুপচাপ ধরনের ছিলাম। একা একা বসে খেলতাম, নিজের সাথে নিজেই কথা বলতাম, গল্প করতাম, এই অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে। হয়ত কেউ খেয়াল করলে আমাকে পাগল ভাববে।
ছোটবেলার কিছু ছবি এখনো চোখে ভাসে, কিন্তু এর মধ্যে কিছু ছবি মনে হয় মনের কল্পনা। যেমন, তখন হয়ত ৪বছর বয়স। আমরা কাপ্তাই থাকি। আমার বাবা সরকারি অফিসার থাকায় ওখানে পোস্টিং। আমাদের বাসার ঠিক সামনেই হাইওয়ে আর পিছনে কাপ্তাই লেক, লেকের পরেই পাহাড়। একদিন বিকেলের কথা মনে আছে। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, ঘরে লাল বাতি জ্বালানো। আমি পিছনের জানালার সামনে বসে বৃষ্টি দেখছি। তুমুল বৃষ্টি, সামনের সব ঝাপসা। চোখ বন্ধ করে এই স্মৃতি মনে করলে এর সাথে সাথে আরেকটা ছবি ভেসে উঠে, এই বৃষ্টির মধ্যে দুরের পাহাড়ের গায়ে চিত্রল হরিন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এই দৃশ্য শুধুই কল্পনা, এত দুরে বসে পাহাড়ের হরিণকে স্পষ্ট দেখা অসম্ভব। মন নিজের মত করে কত ছবি না বানায়, কল্পনা আর সত্যি কে একসময় আলাদা করাটাই কষ্ট হয়ে দাড়ায়।
আরেকটা বৃষ্টির দিনের কথা মনে আছে। আমরা যে বাসাটায় থাকতাম, বিশাল একটা বাসা। এটার ভিতরে একটা জেলখানাও ছিল, যেটা আম্মা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করত। আমি কোনদিন ভয়ে ওই রুমে ঢুকিনি, কোন এক অজানা ভয় কাজ করত। আমাদের বাসার বাইরে দিকের একটা রুমে আমার বাবার অফিস। তাই আমি আমার ভাই সারাদিন পারলে বাবার অফিসে যেয়ে বসে থাকতাম। আমাদের বাসার খুব কাছে একটা স্কুল ছিল, সামনে বিশাল মাঠ। এই স্কুলে "ছুটির ঘন্টা" নামের একটা ছবির শুটিং হয়েছিল। স্কুলটার পাশেই একটা সিনেমা হল। আমার মা আর অন্য অফিসারদের ওয়াইফদের একটাই তখন এন্টারটেইনমেন্ট ছিল, নতুন কোন ছবি আসলেই দল বেধেঁ সিনেমা দেখতে যাওয়া। সাথে মাঝে মাঝে আমাকেও নিয়ে যেত। আর আমি মোটামোটি পুরা সময়টা জুড়ে আম্মার কোলে মাথা রেখে কাঁদতাম। কাঁদার কারন ছিল ছবির ইমোশনাল দৃশ্য। নায়িকা বা অন্য কাউকে কাঁদতে দেখলে আমিও তাই করতাম।
কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেছি। তো আম্মা আমাকে সেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল স্কুলে যাওয়া আসার অভ্যাস করানোর জন্য। তো একদিন স্কুল ছুটি হয়েছে, প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আমাকে বাবার অফিসের আর্দালি এসে নিয়ে যেত। সেদিন অনেক্ষন দাড়িয়ে থেকেও যখন কেউ নিতে আসলনা আমি আমার পাশের বাসার এক বড় আপুর সাথে রওনা করলাম। সেই আমার জীবনের প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা। একদিকে অনেক আনন্দ আরেকদিকে আম্মুর বকা খাওয়ার ভয়। কি অদ্ভুত এক অনুভতি। কিছুক্ষন আনন্দে হাসছি, এর পরের মুহুর্তেই ভয়ে কাঁদছি। এভাবেই বাসায় পৌছে জোরে কান্না শুরু করলাম। বাসার সবাই তো ভয় পেয়ে গেল কান্না দেখে, অনেক প্রশ্ন করার পর জানতে পারল কান্নাটা আম্মার বকার ভয়ে।
আরেকটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে, সেটাও সেই কাপ্তাই। আমি অসম্ভব ঘুম কাতুরে। আর এই ঘুমের জন্য ঝারুর মারও খেয়েছি, কারন সকালে উঠতে দেরি করতাম আর ওদিকে স্কুলেরও দেরি হয়ে যেত। ছোটবেলা থেকেই নিয়ম ছিল, ঠিক রাত নটা বাজলেই শুয়ে পড়তে হবে। একদিন বাবা অফিসের কাজে কাপ্তাই থেকে চিটাগং গেছে, রাতে ফিরতে ফিরতে নটা। বাবা আমার জন্য একটা হাড়িপাতিলের সেট কিনে এনেছে, কিন্তু কড়াকড়ি নিয়ম, নটা বাজলেই বিছানা। তাই রাতে আর হাড়ি পাতিল দিয়ে খেলা হলনা। যে আমি কিনা সকাল দশটা বাজলেও ঘুম থেকে উঠিনা, সেই আমি পরদিন সূর্য উঠার আগেই উঠে হাড়িপাতিল দিয়ে খেলা শুরু করলাম। খুটখাট আওয়াজ শুনে আম্মার ঘুম ভেগ্ঙে গেল। আম্মা তো ভয় পেল ভেবে ঘরে চোর ঢুকেছে কিনা, পরে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে আমি। এই সকালে উঠার রেফারেন্স আম্মা এখনো দেয়। সামান্য একটা হাড়িপাতিল দিয়ে খেলার কি রকম আগ্রহ আর এখন আমার বাচ্চাকে অনেক দাম দিয়ে একটা খেলনা কিনে দিলেও ৫মিনিট খেলে ওটার আর খবর রাখেনা।
ছোটবেলার কথা লিখতে গিয়ে যেন থামতেই ইচ্ছ হচ্ছেনা, কিন্তু কত বড় হয়ে গেল লিখাটা খেয়ালি করিনি। আরো তো কত কাহিনী বাদ পড়ে গেল। থাক সেসব। চোখ বন্ধ করে সেগুলি নাহয় এখন ভাবি।