গত বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা যখন চলছিল একটা দরকারেই যেতে হল সিঙ্গাপুর, আমি, 'শ', আমার বাবা আর মা। রুম পেলাম হোটেলের ২৯ তলায়। দুটা রুম কোরিডোরের দুপ্রান্তে।
যেদিন পৌছালাম তার পরদিন আবার বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার খেলা। এই খেলা তো আর মিস করা যায়না। খেলা শুরু হবার পর জানতে পারলাম ঐ হোটেলেই সুনিল গাভাস্কার আর পিট সিমকক্স উঠেছে, আর হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। আমরা খুশি, খেলাও দেখব, সাথে খেলোয়ারও। লবিতে যেয়ে দেখি খুব হুলুস্থুল অবস্থা, দুই খেলোয়ার প্রচুর ইন্ডিয়ান বেষ্টিত। যেই খেলা দেখতে বসছে তাদেরকেই ফ্রি ড্রিংকস্ (যে যেটা চায়) আর বিভিন্ন রকম বাদাম সার্ভ করছে। বাংলাদেশের বেটিং এর সময় আমরা চারজন চুপচাপ দেখছি, আর বাকিরা উইকেট পরলেই হইচই করছে। আর বাংলাদেশ বোলিং করা শুরু করল আমাদের হইচই শুরু হল। একটা করে ইন্ডিয়ার উইকেট পরে আর আমরা একটা করে চিৎকার দেই। বাকি সবাই চুপ। যখন বুঝা গেল বাংলাদেশ জিতবে, আস্তে আস্তে এক এক করে সবাই উঠে গেল। বুঝলাম ঐ দু'প্লেয়ার বেটিং এ বেশ বড় অংক হেরেছে।
রাতে ঘুমাতে বেশ দেরি হল সেদিন। মাঝ রাতে আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা আওয়াজে। মনে হল বিকট একটা শব্দ আর সাথে ফোন বাজার আওয়াজ। পুরাপুরি যখন সজাগ হলাম তখন সব চুপচাপ, 'শ' গভীর ঘুমে। ভাবলাম বুঝি কিছু সপ্ন দেখেছি। যেই চোখটা লেগে এসেছে আবার শুনলাম সেই বিকট শব্দ সাথে মনে হল কেউ দরজা প্রচন্ড জোড়ে ধক্কাচ্ছে আর আমাদের নাম ধরে ডাকছে। লাফ দিয়ে উঠে 'শ'কে ডাকলাম, শুনলাম মাইকে খুব জোড়ে জোড়ে কি যেন বলছে আর একটা সাইরেনের আওয়াজ। আর এদিকে বাবা দরজা ধাক্কা দিয়ে পারলে ভেঙ্গে ফেলে। আমার তখন কিংকর্তব্যবিমূড় অবস্থা। দরজা খোলার পর দেখি বাবা "আগুন আগুন" বলে চিৎকার করছে। বুঝলাম হোটেলে আগুন লেগেছে, তাই সাইরেন বাজচ্ছে। আমরা দুজন বাবার পিছনে ছুটতে শুরু করলাম, তখন দেখলাম পিট সিমক্স আমাদের পাশের রুমে। সে মাথা বের করে আমাদের ছোটাছোটি দেখছে, আমি যখন তার সামনে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি সে জিগ্গেস করল কি হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক জানিনা, তবে মনে হয় আগুন লেগেছে। আমরা চারজন তখন ফায়ার এক্সিট দিয়ে বের হয়ে সিড়িতে। তখন আমি চিন্তা করলাম, তাও ভালো আমরা ২৯তলা থেকে সিড়ি দিয়ে নামব, উঠতে হবেনা। সবার আগে বাবা, এরপর 'শ', এরপর আমি আর মা। বাবা তো সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে আমার আর মার সাথে কেন এত আস্তে আসছি। এক পর্যায়ে খেয়াল করলাম আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ সিড়িতে নাই, তখন মাইকের কথা খেয়াল করে শুনে বুঝলাম বলছে যে যার রুমে থাকতে, কোথাও কিছু হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমি নামতে নামতে এই কথা বাবাকে জানাতেই খেপে গেল। বলল, আগুন লেগেছে দেখেই সাইরেন বাজছে আর হোটেলের লোক তো আর সরাসরি বলবেনা যে আগুন লেগেছে, তাহলে তাদের বদনাম হবে। কি আর করা নামতেই থাকলাম, নামতেই থাকলাম, সিড়ি আর শেষ হয়না। এক সময় চলা শেষ হল, আমরা যখন একটা দরজা ঠেলে বাইরে বের হলাম দেখি হোটেলের সামনের পোর্চ। একটা লোক খুব মনোযোগের সাথে পোর্চ ধুচ্ছে আরেকজন গাড়ি। আমাদের চারজনকে দরজা দিয়ে বের হতে দেখে খুব অবাক হল। আমরা এরপর গেলাম লবিতে, যেয়ে দেখি যাদের নাইট ডিউটি তারা খুব শান্তভাবে তাদের কাজ করছে। তারাও আমাদেরকে অবাক হয়ে দেখল।
সবকিছু মিলিয়ে মেজাজ তখন খারাপ। কিছুক্ষন লবিতে বসে রুমে গেলাম। এরপরও আরো একবার সাইরেন বেজেছিল, আমার আর ২৯তলা থেকে নামার শখ হয়নি, আগুন লাগলেও আমি রুমে থাকার ডিসিশন নিয়েছিলাম। পরদিন হোটেলে মোটামোটি আমাদের কান্ড সবাই জেনে গিয়েছিল, আর ব্রেকফাস্ট করতে গেলে একজন এসে তো হাসতে হাসতেই জিগ্গেস করল যে, গতদিন যারা দৌড়াতে ব্যস্ত ছিল তারা আমরা কিনা। এরপর কয়েকদিন পায়ের ব্যাথায় হাটতে খুবি কষ্ট হয়েছিল।
খুব শখ ছিল দুই ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ নিব, কিন্তু এই ইমেজের পর কি আর সেটা পারা যায়!! চাইলে হয়ত উল্টাই আমার অটোগ্রাফ নিত, যারা কান নাই শুনে চিলের পিছনে দৌড়ায়। নিজেকে এই ভেবে শান্তনা দেই, আগুন যদি সত্যিই লাগত তাহলে আমরা চারজন শুধু সেইফে থাকতাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:২১