সব শিশুরা যেমন তাদের মাকে সবচেয়ে ভালোবাসে, বাবাই তার মায়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে তার বাবাকে। এর কারণটা আসলে কেউ জানে না, তবে বিষয়টা বেশ চোখে পড়ে সবার। আবার ছোটোবেলা সবাই বলতো, বাবাটা বেশি বেশি করে, আরে বাবাতো অনেকেই হয়! বাবাইয়ের বাবার সে কথায় কান দেয়ার সময় নেই। সে যখন প্রথম বাবা হয়, বাবার পুরো পৃথিবীটা এক জায়গায় এসে পড়ে। বাবাইয়ের প্রতিটা মুহূর্ত সে দেখতো, চোখ ঘুরিয়ে থাকানো, হাত পা ছোড়া, গান গাওয়া, গোসল করানো। না, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনাটাও খুব একটা কাজ করে না, বাবার ভাবনা সেই বাবাই। অফিসের সময় শেষ, এক মুহূর্তও অফিসে নয়। সোজা বাবাইকে দেখতে ছোটা! ছোটোবেলা বাবাইয়ের চোখটা ছিলো নীল। বাবাকে সবাই কালো বলতো সেই ছোটোবেলা থেকেই, কিন্তু বাবাই – যে একবার দেখে, অবাক হয়ে যায়। এতো সুন্দর বাবু! এতো কালো ভাঙাচোড়া মানুষটার এমন সুন্দর বাবু, সবাই যখন বাবাকে বলতো, ভাগ্য ভালো, বাবার চেহারাটা পায়নি, মায়ের চেহারা পেয়েছে! আর বাবাই বার বারই তার প্রতিবাদ জানাতো, বলতো বাবা তার শ্রেষ্ঠ বাবা, তার বাবা অনেক সুন্দর।
বাবাই আর বাবার ভালোবাসাটা দিনে দিনে বাড়ছে, চলছে সব দারুণ। অন্যদিকে ক্ষয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। নীরবে চলছে তখন কোন এক ভাঙ্গনের আয়োজন। এই ভাঙ্গনে বাবা আর বাবাইয়ের কোথাও কোন ভূমিকা রাখার কোন সুযোগটাও ছিলো না। মাঝে মাঝে হয়তো আকাশটা হঠাত করেই ভেঙ্গে পড়ে।
আকাশটা হঠাতই ভেঙ্গে পড়লো! বিচ্ছেদটা যতোটা বাবাইয়ের বাবা আর মায়ের মধ্যে হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি হলো বাবাই আর বাবাইয়ের বাবার। দুজনের মধ্যে মিলটা ছিলো একটা জায়গায় – জগতের জটিলতা আর হিসাবনিকাশগুলোর কোন জায়গা ছিলো না বাবাই আর বাবাইয়ের বাবার মনের কোথাও।
দেখা নেই কয়েক বছর। চাইলেও বাবাই তার বাবাকে দেখতে পায় না। বাবাও সময়টা পায় না। দেখা হয় না। একই শহরে থাকে। হঠাত বিচ্ছিন্ন এক জীবনে বাবাইয়ের বাবার তখন দিশেহারা অবস্থা। চাকুরির জটিল সব দায়িত্বপালন করে অভ্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে বিচ্ছিন্ন এক জীবনযাপনে অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। যারা খুব গভীরভাবে ভালোবাসে, তারা হয়তো জীবনটাকেও ভালোবাসে আর ভালোবাসে বলেই হাল ছাড়ে না কোনকিছুতেই। একা এক শহরে হাবুডুবু খেয়েই বাঁচতে হয়। চারপাশের মানুষগুলো টেরও পায় না। প্রতিবছরে সেই ফোন কলটা আসে, “হ্যাপি বার্থ ডে টু মাই বেস্ট বাবা”। মাঝখানে কতগুলো বছর এভাবেই চলে যায়।
বাবাই তো বড় হয়ে গেছে। চার বছরের বাবাই এখন এগারো বছরের দূরন্ত বালক! বাবাইয়ের ভাবনাটা খুব স্থির ছিলো। মাত্র কয়েকমাস, তারপরেই বাবার কাছে চলে যাবে, অথচ কয়েক মাস অনেকগুলো বছর হয়ে গেলো।
মাসে একবার বাবার সাথে দেখা, থাকা। বাবা, “আমাদের এই বাসাটা আমার পছন্দ নয় আরেকটা বড় বাসা নিবা”। তারপর একদিন বলে, “বাবা, তোমার বাসাটা একটু গুছিয়ে রাখতে পারো না!”। এভাবেই একদিন আমাদের বাসা থেকে বাবার বাসাটা ‘তোমার’ বাসা হয়ে যায়। বাবা বুঝতে পারে, পরিবর্তনটা। কয়েক বছরের অনেক কিছুই বদলে গেছে। দূরত্ব বাড়ছে , বাড়ছে, বাড়ছে।
মাঝে মাঝে এখন আসে। অনেক বই নিয়ে আসে। অনেক পড়বে। বাবার কাছে পড়তে হবে। বাবা সবচেয়ে ভালো বুঝাতে পারে। না, পড়াটা আর হয় না। প্যাড নিয়ে খেলার মধ্যেই ডুবে থাকতে চায়। দু’ দিন থাকলেই বলে, “বাবা, বলোতো কী করি! তোমার কাছে আসলে মা’র জন্য মন অনেক খারাপ লাগে। চলে যেতে মন চায়”। চলেও যায়। তারপর আবার কয়েকদিন। “বাবা, কেমন আছো, শুক্রবার আমি তোমার বাসায় আসছি!”। বাবা তাকে বুঝায়, এটা বাবার বাসা নয়, বাবাইয়ের বাসা! আবার আসে, আবার যায়।
বড় হচ্ছে, আর প্রশ্নগুলো খুব পরিষ্কার হচ্ছে, “মা’র কাছে গেলে তোমার জন্য খুব কষ্ট হয়, আবার তোমার কাছে আসলে মা’র জন্য আমার মনটা ছুটে যায়, বলোতো বাবা, কী করি!”। আমাকে কেন যেতে হয়? আসতে হয়! এই যাওয়া আসা আমার ভালো লাগে না, বাবা। বুকের ভিতর কান্না নিয়েই , ব্যাগটা গুছায়, “বাবা, আসি, ভালো থেকো, রাতে ঘুমানোর সময় দুধ খেয়ো, তুমি বুড়ো হয়ে যেও না বাবা! ”। বাবাই চলে গেলেও ছোট্ট বাবাইয়ের বুকের ভেতরের ভাঙ্গনের শব্দগুলো বিরামহীন আঘাত করতে থাকে বাবার বুকের ভেতরে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৬