তোমাকে অভিবাদন, এও কি সম্ভব এই দেশে?
একটা পার্সেল, স্যুট থাকার কথা একটা। খুলে দেখলেন দুটো! সাথে সাথেই ফোন করলেন, টেইলার্সকে! উত্তর আসলো, “স্যার, আপনি এই এলাকার অনেক সেবা করেছেন, আমরা কিছু করার সুযোগ পাইনি, স্যার কিছু মনে করবেন না, এটা আমাদের ভালোবাসা”। হাটহাজারি থানা থেকে যখন বদলি হয়ে যান, পুলিশ বিভাগ তাকে একটা স্যুটের কাপড় দিয়েছিলেন। সেই স্যুট সেলাইয়ের গল্প এটি।
মোবাইল ঠিক করতে গিয়েছেন একটা দোকানে। দোকানদার ঠিক করার সময় নাম জানতে চাইলেন, নামটা তার চেনা চেনা লাগলো আবার এতো সাধারণ পোশাকে! আবার তাকালেন, এ তো সাধারণ মানুষের বন্ধু, কারো বিপদে পাশে দাড়াতে যে মানুষটি কোন বংশ, পদ, শ্রেণির ধার ধারেন না – এলাকার প্রিয় স্যার। “স্যার, আপনি তো এলাকার জন্য অনেক কিছু করেছেন, আমরা কিছুই করতে পারি নাই, স্যার আপনার কাছে থেকে টাকা নিতে পারবো না!”
উপরে দুটো বিচ্ছিন্ন আবেগি ঘটনা মনে হলেও একজন কর্মকর্তার বদলির আদেশ প্রত্যাহারের জন্য হাজার হাজার মানুষ মানব বন্ধন করে, তখন নিশ্চয় সেই আবেগের মূল্য অনেক আর সেই ভালোবাসা এমনি এমনি জন্ম নেয়নি।
২০০৫ সালে ২৪ তম বিসিএস এ যোগ দেয়া অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত মানুষটির নাম বাবুল আক্তার। প্রথম বছরেই ধরলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জাল করার বিশাল শক্তিশালী এক চক্রকে।
নরসিংদির কুখ্যাত সিক্স মার্ডারের যখন কোন ক্লু পাওয়া যাচ্ছিলো না, তখন রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব নেন বাবুল আক্তার। খুনিদের শেষ পর্যন্ত ফাঁসির রায় হয়।
এছাড়া স্কুলশিক্ষিকা তানিয়া হত্যারহস্য উদ্ঘাটন; ১৪ বছরের কিশোর জাভেদকে অহরণকারীদের হাত থেকে অক্ষত উদ্ধার ও অপহরণরহস্য উদ্ঘাটন; গৃহকর্মী রুমাকে হত্যার পর পুড়িয়ে সব আলামত নষ্টের পরও সূত্রহীন সেই হত্যাকাণ্ডের সূত্র উদ্ঘাটন করে আসামিদের গ্রেফতার; রাউজানের বেসরকারি ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৩৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা চুরির হোতা গ্র্যাজুয়েট চোরচক্রকে গ্রেফতার; চট্টগ্রামের ভয়ংকর ডাকাত সর্দার খলিলকে ৯ সহযোগীসহ গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধার, অজ্ঞান-মলমপার্টি-মোটরসাইকেল চোরচক্র গ্রেফতার, ডাকাতির প্রস্তুতি নেয়ার সময় রকেট লাঞ্চার, ৬ অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার, দুর্ধর্ষ ক্যাডার বিধান বড়ুয়ার কাছ থেকে জি-থ্রি রাইফেল উদ্ধার; চট্টগ্রামের কাদের ডাকাত ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার ত্রাস কিলার ওসমানকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করেছেন বাবুল আক্তার।সিএমপিতে যোগ দিয়েই সর্বশেষ পুলিশ মার্ডার মামলার আসামি গ্রেফতার ও খুনের কাজে ব্যবহৃত 'কাটনি' উদ্ধার করে দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।
আর এসব সাফল্যের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে পেয়েছেন স্বীকৃতি-রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা) (২০০৮), ২০০৯ পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসিকতা)। সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেছেন বাবুল আক্তার। আর এর মধ্যে চার-চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের মর্যাদা। ' ২০১২ সালের জানুয়ারিতে রাজারবাগ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার তুলে দেয়ার আগ মুহূর্তে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বাবুল আক্তারকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, 'বাবুল আমাদের সবচেয়ে সাহসী অফিসার।'
দেশের জন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে যাচ্ছেন বাবুল আক্তার। যে সমস্ত অপারেশন তিনি করেছেন, তাতে তারই জীবনহানীর আশংকা থেকে যায় সব সময়। যে শক্তির বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করছেন, তাদের শক্তি অনেক বেশি, তবুও তা পরোয়া না করে এগিয়ে চলেছেন একজন বাবুল আক্তার।
তার অসীম ত্যাগ আমাদের নিরাপদ করলেও, নিজেকে আর নিজের পরিবারের জন্য ঝুকিপূর্ণ করেছেন সবকিছু। হারালেন জীবনসঙ্গীকে। এভাবে চললে ঘাতকের বুলেট হয়তো তাকেও অব্যর্থ নিশানার আঘাতে তার চলার পথ থামিয়ে দিবে।
ততোক্ষণ বাবুল আক্তার অপরাধীদের পিছনে ছুটবেন, তার অতীত সেটাই বলছে আমাদের।
দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য এই বাংলাদেশে আরো বাবুল আক্তার চাই। প্রতিটি বিভাগে চাই বাবুল আক্তার। যতই জানতে পারছি, ততোই অবাক হচ্ছি - এ কি গল্প নাকি সত্যি? আপনার পিতামাতাকেও জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।আপনি বেঁচে থাকুন দীর্ঘদিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:০৯