আগস্ট, ২০১১... মুম্বাই
টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের দশ তলায় ছিল আম্মার কেবিন। কেবিনের সাথে একটা বারান্দাও ছিল। সামনে সেন্ট জেভিয়ার্স ফুটবল মাঠ... ঝুম বৃষ্টির বর্ষাকালের মুম্বাই... কিন্তু তার ভিতরও খেলা থেমে থাকতো না স্থানীয় ফুটবল ক্লাবগুলোর। আমি বারান্দায় দাঁড়ায় দাঁড়ায় ওদের খেলা দেখতাম; আর দেখতাম দূরের এক পাহাড় শ্রেণী। অনেক অনেক দূরে... আমার কাছে খুব রহস্যময় লাগতো সেই পাহাড় এলাকার জনপদটিকে। আমি প্রায়ই তন্ময় হয়ে ভাবতাম কি আছে ওখানে??? হাসপাতালের এক নার্সকে একবার প্রশ্নই করে বসলাম, কি নাম ঐ পাহাড়ের?... অ্যান্টপ হিল। হুমম... নামটা আরো রহস্যময় কিছু হওয়া উচিৎ ছিল; কারণ পাহাড়টাকে আমার চির রহস্যে ঘেরা এক নিসর্গ মনে হতো... মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি সেই দূর রহস্যপানে চেয়ে থাকতাম... তারপর একদিন...
এটা পুরাতন মুম্বাই। বলিউডের 'রঙিন' জগত এখানে দেখা যাবে না। এখানে আছে জীবন-মৃত্যুর সাদা-কালো বাস্তবতা। হাসপাতালে তো তল্পিতল্পা নিয়ে থাকার নিয়ম নাই। তাই আমাদের মতো আজনবীদের এই পোড়ামাটির দেশে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখতে হয়। কন্ট্রাক্ট থাকে এক সপ্তাহ, এক পক্ষ আবার এক মাসের... কন্ট্রাক্ট শেষ তো নতুন ফ্ল্যাট। আর তাই সেউড়ির সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে নতুন আরেকটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। হাসপাতাল থেকে বেশ দূরেই। তবে এখানে যানজট নেই আর বাস সার্ভিসও ভালো। দেখলাম ৩০ মিনিট লাগবে যাতায়াতে। এক রাতে রওয়ানা হলাম সেই ফ্ল্যাট দেখার জন্য... প্রতীক্ষানগরে...
হাসপাতাল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের এই প্রতীক্ষানগর। দশ রুপি বাস ভাড়া। আর ফ্ল্যাটটাও ছিল বেশ ভালো... অনেক কমের ভিতর পাওয়া গেছে... অনেকদিন পর রাতে ভালো ঘুম হল। সকালের বাস ধরে যখন ফিরছি হঠাৎ চোখে পড়লো সেই অ্যান্টপ হিলকে!!! আরে আরে... আমি তো দেখি শেষপর্যন্ত চলেই আসলাম তার সকাশে... বাসের রুটে পড়ে না; একটা শাখা রাস্তা সোজা চলে গেছে আমার সেই রহস্যময় সবুজ পাহাড়ের দিকে। আরো দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্তি ধারাবীকে... স্ল্যামডগ মিলিয়োনিয়ারের শুটিং স্পট। গতকাল রাতে একে দেখেছি কিন্তু চিনতে পারিনি।
ঠিক করেছিলাম, আম্মা মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেলে প্রতীক্ষানগর একবার ঘুরে আসবো। ঘুরে আসবো নারিমান পয়েন্ট, জুহু বীচ... দেখবো আরব সাগরে ডুবে যাওয়া শেষ সূর্য... কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে যে রচিত হয় রহস্যের আরো চিত্রনাট্য। আমার আর এই জায়গাগুলো ঘুরে দেখা হয় না। ডাক্তারদের কাছ থেকে হতাশার বানী শুনে আম্মাকে নিয়ে চলে আসি মারাঠাদের মুম্বাই থেকে জন্মভূমি বাংলাদেশে... ফেলে আসি প্রতীক্ষানগরকে...
কিন্তু আমার মনে আজো সেই প্রতীক্ষানগর ভেসে বেড়ায়... সেই পাহাড়শ্রেণীর সবুজ ঘুরে বেড়ায়... মনে হয় আমার জন্য এখনো অপেক্ষায় রত পাহাড়কোলের প্রতীক্ষানগর... যে কারণে আমার হাসপাতালের বারান্দা থেকে সেই দূরের অ্যান্টপ হিলকে রহস্যময় মনে হতো, যে কারণে আমি তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকতাম কোন কারণ ছাড়াই... সেই কারণটা ছিল একটা নামে... প্রতীক্ষানগর...