পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- প্রথম পর্ব
পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- দ্বিতীয় পর্ব
পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- তৃতীয় পর্ব
পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- চতুর্থ পর্ব
হেল দ্য হাইওয়ে
পঞ্চম পর্বঃ দুঃস্বপ্ন ও কুমিরার রাত
অবিচ্ছিন্ন সারাটা রাত জুড়ে বিচ্ছিন্ন ঘুম হল। এপাশ ওপাশ করে শক্ত মেঝের উপর কাটিয়ে দেয়া এই ক্ষণে ঘুম ক্ষণে জাগরণ অপেক্ষা একেবারে নির্ঘুম রাত অনেক ভালো। এতে অন্তত ভোরের দিকে এসে ধরা দেয় রজনীর সেই নির্ঘুম ঘুম। তার উপর এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘুমের মধ্যেই একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম। খুব খারাপ একটা স্বপ্ন। সেই মাত্রায় খারাপ। ধড়ফড় করে উঠলো বুকটা, কোন্ অজানা বিপদের বার্তা এই স্বপ্ন? বাকি রাত্রি কেবল অমানিশা দূর করে আসা নতুন ভোরের প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দিলাম... একসময় ভোর হল। সব গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পথে। জনশূন্য মহাসড়কে পা ফেললাম আবার। শুরু হল ২০১০ সালের ৪ জুন, পঞ্চম দিনের পথচলা। সময় তখন ৫টা বেজে ৪৫ মিনিট।
শরীরে না ঘুমানোর ক্লান্তি অথচ চোখে তার দেখা নেই, দু’পায়ে পদক্ষেপের যন্ত্রণা অথচ মনে তার নেই আঁচড়, তামাটে হয়ে পুড়ে যাওয়া ত্বক অথচ আত্মায় অভেদ প্রশান্তি। গভীর রাতের দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে পথে নামতেই সঙ্গী হল ভোরের লাল সূর্য। বা’দিকের এই উদীয়মান সূর্য্যিমামা যে কি সুন্দর এক আবহ তৈরি করেছিল সেদিনের সেই চট্টগ্রামের আকাশে তা এখানে কিভাবে বলি! ভাষাতীত সৌন্দর্যের বর্ণনা কোন্ ভাষায় হবে প্রকাশিত; ভাবুক বানিয়ে দেওয়া সেই ক্ষণের তরে কোন্ সে ভাবের হবে অবতারণা- তা আমার অজানা। ঘোরের মতো চোখে লেগে থাকা, তীরের ন্যায় মনে গেঁথে যাওয়া সেই দিনগুলোর ক্ষণিকের কিছু মুহূর্ত না হয় থাকুক আমার মনোদর্পণেই। আপনাদের তার থেকে বরং নিয়ে যাই পথের নীরস, নিরেট আক্ষরিক বর্ণনায়। পাঁচ মিনিতেই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। সাড়ে ছয়টার দিকে মিঠাছড়া বাজারে যাবার রোড ডিভিশনে এসে পৌঁছলাম। ডানদিক দিয়ে গেলে পড়বে লোকে লোকারণ্য মিঠাছড়া বাজার। আমি গেলাম জনশূন্য বা’দিকে, সুনসান মহাসড়ক মাঝে। ৬:৩১ মিনিটে শুক্রবারের প্রথম কিলোমিটার পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য আরো ৬৪ কিলোমিটার দূরে; সাথে আরো একটা তথ্য- সীতাকুণ্ড পৌঁছতে আরো ২৪ কিলোমিটার বাকি।
সড়কের এই অংশে আমি সেরকম উল্লেখ করার মতো কিছু পেলাম না। আসলে আমি দু’ধারের অপার রহস্যমাখা সৌন্দর্য দর্শনে তন্ময় হয়ে ছিলাম। আর সেকারণেই ‘দীর্ঘ’ চুয়াল্লিশ মিনিট পরে ৭:১৫ মিনিটে আবার ক্রনিকল খুললাম। কারণ মীরসরাই উপজেলা সদরে প্রবেশ করি এই মাত্র। নগরায়নের প্রভাব পড়তে লাগলো বনানীর পথে। ৭:৩৩ মিনিটে একটা কিলো পোস্ট চোখে পড়লো- চট্টগ্রাম ৫৮ (!), সীতাকুণ্ড ২০; অন্যপিঠে ঢাকা ২০৫ আর ফেনী ৩৭। ব্যাপারটা আমার কাছেই বিস্ময়মাখা লাগছিল। ৬২ মিনিটে ৬ কিলো পথ হেঁটে এসেছি! এটা যে আমার পক্ষে সম্ভব না তা না। কিন্তু সেটা এই জর্জরিত পা যুগল দ্বারা সম্ভব করাটাই অসম্ভবের মতো। ৭:৪০ মিনিটে পার হলাম মীরসরাই পুলিশ স্টেশন। শহরতলীর প্রভাব কেটে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে; অপসৃয়মাণ ইট-কাঠের অগোছালো কাঠামোর জায়গায় আবার ফিরে আসতে লাগলো বৃক্ষশোভিত পাহাড়ঘেরা নির্মল নিসর্গ। থামতে ইচ্ছা করছিল না; যে দূর্বার গতিতে পথ চলছিলাম তাতে সহসা ‘ব্রেক’ কষা শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিন্তু পূর্ব খৈয়্যাছড়ার পাগল করে দেওয়া রূপ আর অদূর পাহাড়ের রহস্যমাখা সবুজ আমাকে থামতে বাধ্য করলো। রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা নুড়ি পাথরের উপর বসে পড়লাম। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের পানে। পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল একেকটা গতিদানব। পথে হাঁটার সময় এদের গতির তীব্রতা অতটা বোঝা যায় না যতটা স্থির হয়ে থাকার সময় যায়। মাঝে মধ্যে দু’একজনকে দেখলাম। এরা সবাই হাটের পথিক। আমার দিকে ক্ষণিকের অবাক চাউনি দিয়ে তারা চলে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে। মনে কৌতূহল কিন্তু মুখ নিশ্চুপ। আরে বাপ, প্রশ্ন যদি থাকে করে ফেল্ না; চিড়িয়া দেখার দৃষ্টিতে কৌতূহল চেপে রাখার কি দরকার! কিন্তু কি কারণে যেন তারা আমার সাথে কোন কথা বললো না। কারণটা অবশ্য পরে আমি কিছুটা বুঝতে পারি। পরে বলছি সে কথা...
পায়ের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। ব্যথা তো আছেই; কিন্তু সেটা সহ্য করার ক্ষমতা ব্যথার মাত্রা থেকে বেশি ছিল বিধায় এতক্ষণ আমলে নিই নাই, সামলে নিয়েছি। এখন একটু একটু পাত্তা দিতে হচ্ছে তাকে। হঠাৎ মনে পড়লো, আমি না আনছিলাম... কৈ ঐটা? আরে এতোদিন এর কথা মনেই পড়েনি! পড়েনি কেন??? সেই প্রথম দিন বৃষ্টিভেজা সকালে রড-সিমেন্টের দোকানে বসে থাকার সময় একবার... ব্যাগ থেকে বের করলাম চাইনিজ ব্র্যান্ডের দুই নাম্বার () XDC- Microlab এর এমপিথ্রি প্লেয়ারটা। কানে হেডসেট দিয়ে ছেড়ে দিলাম গান…
স্বাধীন কোন পাখির মত
ডানা মেলে স্বপ্ন জ্বেলে
আমি তুমি বন্ধু সবাই
বাঁধা ফেলে চলেছি এগিয়ে…
………………
………………
দীপ নেভার আগে
এসো স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়াবে
ক্লান্তি ছোয়ার আগে
চলো সত্যের দীপ জ্বালাবে…
ফুয়াদ ফিচারিং উপল ও মাহেরের গাওয়া এই গানটা টনিকের মতো কাজ করলো। ছুঁয়ে যাওয়া ক্লান্তি দূরে গেলো নিমিষেই। আবার বাড়তে থাকলো গতি, কমতে লাগলো গন্তব্যের দূরত্ব, ফিরতে শুরু করলো আত্মবিশ্বাস ও উচ্ছ্বাস। আর এভাবেই সকাল পৌনে দশটা নাগাদ চলে আসলাম ফকির হাটে। চারিদিকের পৌনঃপুনিকভাবে ক্রমাগত দেখতে থাকা সবুজে ছাওয়া পাহাড় আর মহীরুহে ঢাকা সড়ক নিয়ে বিশেষ কিছু কি লিখবো ক্রনিকলে! তাই এগারোটা নাগাদ যা লিখলাম তার বেশিরভাগই ছিল কিলোমিটার পোস্টের বর্ণনা। মাঝে ১০:১১ মিনিটে ডানদিকে চলে যাওয়া কমলদহ বাজারের একটা সাইনপোস্ট ও বাইপাস রোড চোখে পড়লো। চোখে তো পড়েছিল আরো অনেক কিছুই; কিন্তু লিখে রাখিনি তা প্রাণহীন কাগজে। প্রথমবারের অনভিজ্ঞতাই বলেন আর উচ্ছ্বাসের আতিশয্য কিংবা ক্লান্তিময় পথচলাকেই (কারণ হিসেবে) ধরেন - মোটকথা অনেক কিছুই তুলে ধরতে পারিনি আমার শতভাগ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করার এই অভিযাত্রায়।
১১:০৭ নাগাদ পৌঁছলাম সীতাকুণ্ডের এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনে। মিনিট এগারো পরে আরো সামনে এগিয়ে চোখে পড়লো শ্রী শ্রী নারায়ণ আশ্রম, বারৈয়াঢালা; প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী মাধবানন্দ মহারাজ। ১১:৪৩ মিনিটে পার হলাম এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেই কিলোমিটার পোস্টটা অতিক্রম করলাম যার মাধ্যমে আমি ঢাকাকে ২০০ কিলোমিটার পেছনে ফেলে দিলাম। চট্টগ্রাম আর মাত্র ৪৫ কিলোমিটার; সীতাকুণ্ড ৫। দশ মিনিট পরে স্বাগত জানালো সীতাকুণ্ড উপজেলা; অর্থাৎ প্রবেশ করলাম সীতাকুণ্ড পৌরসভায়। সূর্যের তাপের প্রখরতা বাড়ছে, তেজ পাচ্ছে প্রচণ্ডতায়। একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। রাস্তা পার হয়ে ডানদিকের একটা মসজিদ সংলগ্ন পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। নুনাছড়া ৩নং ইউনিয়নের জামে মসজিদ। পুকুর পাড়ে কিছু লোক গোসল করছিল, কারো কারো শেষ। ওনারা এসে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। গতানুগতিক বিস্ময় প্রকাশ করলেও ওনাদের কাছ থেকে একটা কথা এই প্রথম শুনলাম... আপনারে দেইখা আর্মির লোক মনে করছিলাম প্রথম। আমি ঠিক বুঝলাম না, আমার এই 'সুবোধ বালক' টাইপ চেহারার সাথে আর্মি ম্যানের কঠিন চেহারার কি মিল থাকতে পারে! ওদের কথা আমলে নিলাম না তবে শুনে খুশি খুশিই লাগছিল। বাহ,আর্মি টাইপ লাগছে আমাকে। ভালো তো, ভালো না?
দুপুর ১২:৩৬... এটাই কি সীতাকুণ্ড পাহাড়? আর ঐ দূর গিরিশিখরে চকচক করছে কি? চন্দ্রনাথ মন্দির না? প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসাকে হ্যাঁ-বাচক তথ্যে পরিণত করতে আরো কিছুক্ষণ সময় লাগে। যত সামনে বাড়ছিলাম ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল দূর পাহাড়ের চন্দ্রনাথ। হঠাৎ সড়কের ডানদিকে একটা শ্মশান দেখলাম। তবে অবাক ব্যাপার... এটা বৌদ্ধদের শ্মশান। বৌদ্ধদের আবার শ্মশান হয় নাকি! জানতাম না... আজকে জানলাম। এক পর্যায়ে মনে হল হাঁটাটা ঠিক হচ্ছে না আমার। এতো সুন্দর পরিবেশকে কোথাও স্থির হয়ে উপভোগ না করাটা সারা জীবনের জন্য আফসোস আর বর্তমানের সাপেক্ষে অন্যায়তুল্য হয়ে যাবে। তাই রাস্তার ধারেই সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়লাম। এখান থেকে সুউচ্চ চন্দ্রনাথ এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। একটু পর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হল। ইলশে গুঁড়ির সেই ছিটে এসে গাঁয়ে আলতো আঘাত করছে। বাতাসের কারণে মনে হচ্ছে যেন সীতাকুণ্ডের ওপার থেকে গুলির মতো তির্যকভাবে ছুটে আসছে তারা। ভেসে যাওয়া মেঘমালা মধ্য গগনের তেজী সূর্যকে ক্ষণিকের জন্য ঢেকে দিচ্ছে তার অস্বচ্ছ কাঠামোয়। হাঁটার সময় মনে হয়েছিল, একটু বসি। আর এখন বসে থেকে মনে হচ্ছে, হাঁটছিলাম...সেটাই তো ভালো লাগছিল। আসলে ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। আর কতদূর? কতক্ষণ?
দুপুর ১:৩৪ মিনিটে সীতাকুণ্ড উপজেলার সদরে প্রবেশ করলাম। একটু আগের (১:২৮) কিলোমিটার পোস্ট থেকে জানলাম চট্টগ্রাম আর গুণে গুণে ৪০ কিলোমিটার দূরে। ১:৪৮ এ স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অফিসের পাশ দিয়ে গেলাম। ওদের ফোন নাম্বারটা রেখে দিন। কাজে লাগলেও লাগতে পারে... ০৩০২৮-৫৬০২২। তবে চার বছরের ব্যবধানে ফোন নাম্বার বদলে গিয়ে থাকলে তথ্যদাতা এই আমি দায়ী থাকবো না কিন্তু। খানিক বাদে একটা অদ্ভুত কাঠামোর বিদ্যালয় দেখলাম। অনেকগুলো সিমেন্টের পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম সাদেক মস্তান (রঃ) প্রাথমিক বিদ্যালয়। সীতাকুণ্ড সদর পেরিয়ে আসলাম। এখন সামনের কিলোমিটার পোস্টে কেবলই থাকবে চট্টগ্রামের দূরত্ব। আগামীর এই চল্লিশ কিলোমিটার পথে যদি পা দুটো ভেঙেও যায় তো আমি যেভাবেই হোক পার হবো, হবোই হবো। অতএব এখন জানিয়ে দেওয়া যায় ওকে। কাকে?
প্রায় দু'টোর মতো বাজে। স্থানীয় এক দোকান থেকে ফোন দিলাম আহমাদকে। ও আমার ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই। আমি যখন পায়ে হেঁটে চট্টগ্রাম যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করি তখন আহমাদ বলেছিল, সেও যাবে... আমাকে রিসিভ করার জন্য! আমি যেদিন চট্টগ্রাম পৌঁছবো তার আগের রাতে বাসে করে রওয়ানা দেবে সে। আহমাদের যুক্তি... ভাই, আপনি এতো কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে যাবেন আর আপনাকে আমি বাসে করে গিয়ে রিসিভ করতে পারবো না! আর তাছাড়া সামার ভ্যাকেশনের শুরুতে কাজটা কি আমার? আহমাদকে ফোন করে বলে দিলাম, আসতে পারো এখন।
২:০৮ এ পথের বা’দিকে নজরে পড়লো সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। আর সাথে একটা কিলোমিটার পোস্ট... চট্টগ্রাম ৩৮। মাঝে একবার আমার ছোট ভাই রাশেদুলকে ফোন দিই। মাঝরাতের সেই দুঃস্বপ্নটা ওকে নিয়েই দেখা। পথে নেমে দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ যাবত মনটা কেন জানি বিষণ্ণ লাগছিল। আর তখনই মনে পড়ে যায় রাতের সেই স্বপ্নের কথা। লিখতে গিয়ে এখন ঠিক মনে নেই কি দেখেছিলাম স্বপ্নে। তবে সেটা যে সুখকর কিছু ছিল না এটা নিশ্চিত। আমার উদ্বিগ্ন প্রশ্নে ওর নির্ভার উত্তর চিন্তামুক্ত করলেও মনমরা ভাবটা কাটলো না। বিরস মনের এহেন অবস্থা আঁচ করতে পেরেই কিনা কে জানে... কালো মেঘ জমতে লাগলো নীলাকাশে। জমতে জমতে প্রায় আঁধার করে ফেললো চারিদিক। তারপর হঠাৎ ঝুম করে নামলো শুষ্ক জমিন পানে। প্রচণ্ড তীব্রতা সেই অঝোর ধারায়। সাড়ে তিনটার মতো বাজে তখন। অনন্যোপায় হয়ে আশ্রয় নিলাম পথের ধারে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আবার যখন নামলাম তখন বিকাল পাঁচটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। মাথার উপরের মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো আরম্ভ হল। আলোর একেকটা ঝলকানির অব্যবহিত পরেই কড়ড়ড় করে সেই কি শব্দ! ছোটবেলা থেকেই বজ্রপাতের বিকট শব্দে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। আজও পাই। হুমমম... ছোটবেলায় পাওয়া সেই ভয় এখনো আছে। কিন্তু সিক্ত মহাসড়কে সেদিন মন খারাপ থাকা সত্ত্বেও কেন কোন ভয় লাগলো না?
বৃষ্টির তীব্রতায় কোথাও আশ্রয় নেওয়া আবার কমে গেলে বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে দেখতে পথ চলা- এই করতে করতেই এক সময় চলে আসলাম ছোট কুমিরায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে কুমিরার আকাশে। মাঝে সাড়ে পাঁচটার দিকে এক ফিলিং স্টেশনে (মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্স ফিলিং স্টেশন) থেমেছিলাম... বৃষ্টির 'যন্ত্রণায়'। তখন এক ট্রাক ড্রাইভার অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকে জানালেন, তিনি আমাকে ফেনীতে দেখেছিলেন। কিভাবে চিনলেন যে সেই আমিই এই আমি- এর জবাবে উনি... আপনারে চিনতে কষ্ট হওনের তো কথা না। দ্যাখলেই বুঝন যায়। ভালোই, আমি তাহলে ট্রেডমার্ক চেহারার হয়ে গেছি অথবা আমার চেহারা ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে।
রাত বাড়ছে। সেই সাথে ধীরলয়ে বাড়ছে বৃষ্টির তীব্রতা। কিন্তু এই আঁধার মাঝে কোথাও যে একটু আশ্রয় নেবো তার উপায় নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পথ চলতে চলতে খুঁজতে লাগলাম আজকে রাতের ডেরা। কিন্তু যুতসই কোন জায়গাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোয় একটু আধটু দেখতে পাচ্ছিলাম আশপাশ। আর তাতে কেন যেন মনে হচ্ছিলো রাস্তার দু’পাশ অনেকটা নীচে আর পুরোটাই পানিতে থৈ থৈ; একটু পরেই সেই পানি উপচে এসে আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে যাবে। এটা সম্পূর্ণই মনের ধারণা, অলীক কল্পনা। কিন্তু ঐ যে একটা কথা আছে না... আন্ধার ঘরে সাপ তো সারা ঘরে সাপ। একে তো কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না; তার উপর চোখে-মুখে ক্রমাগত এসে পড়ছিল বৃষ্টির ফোঁটা। ঝাপসা হয়ে আসছিল চশমার কাঁচ। সেই সময়ে এমন ভাবনা আসাটা হয়তো বা খুব একটা অস্বাভাবিক না ।
৭:২৯ মিনিটের কিলোমিটার পোস্ট জানিয়ে দিলো, আর দরকার নেই হাঁটার। চট্টগ্রাম মাত্র ২৮ কিলো দূরে। এখন খুঁজতে থাকো রাতের আবাস। আমিও সেই মতো খুঁজে পেলাম রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা নির্মীয়মাণ মসজিদ। রাত তখন সাতটা বেজে ৪৭ মিনিট। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে শুয়ে পড়লাম কাঁচা মাটির ’পরে বিছানো ছনের মাদুরের উপর। অসম্ভব দুর্বল লাগছিল। মনে হচ্ছিলো সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেছে। ঘুমে চোখ লেগে আসছিল। যখন হাঁটছিলাম তখন এক তালে ছিলাম বলে ক্লান্তিটা বুঝতে দিইনি শরীর মহাশয়কে। কিন্তু অবসন্ন হয়ে পিঠ ঠেকাতেই সেই মহাশয়ও এখন বেঁকে বসেছেন। সেই সাথে বেঁকে বসেছেন স্থানীয় এক বয়স্ক মুরুব্বী। উনি আমাকে আজকের রাতটা এখানে থাকতে দেবেন না। কিছুতেই না। বেশ খারাপ আচরণই করেছিলেন তিনি আমার সাথে। ওনার কথাতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। সেই কষ্টতেই কিনা কে জানে, স্থানীয় অন্যান্যদের বেশ অনুরোধ সত্ত্বেও আমি আবার নেমে পড়লাম পথে। কুমিরার সেই নিকষ তমসার রাতে...
ক্লান্তিতে পা দুটো ঠেকে ঠেকে আসছিল। আমি অনেকটা ঢাল বেয়ে নেমে রাস্তার বা’দিকের সেই মসজিদটায় গিয়েছিলাম। এখন এই ঢালটা বেয়ে উঠতে হবে। উঠলাম সেই ঢাল বেয়ে এবং আবার চলতে লাগলাম সামনের দিকে। অচেনা পথ ধরে অজানা অন্য কোন আশ্রয়ের খোঁজে। আমি যখন পুনরায় মহাসড়কে পা রাখি তখন নয়টা বেজে পাঁচ মিনিট। কেউ নেই পথের মাঝে। বৃষ্টিও নেই। কিছুক্ষণ পর পর দু’একটা গাড়ি যাচ্ছিলো ভেজা পথ কামড়িয়ে। সাড়ে নয়টার দিকে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের সামনে এসে পৌঁছলাম। একটু সামনে দিয়ে চলে গেছে পোর্ট রোড। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পরিচিত কেউ পড়াশোনা করে না। অতএব খামোখা ওখানে গিয়ে লাভ নেই। সামনে বাড়াই একমাত্র সমাধান। রাত তখন পৌনে দশটা। অবশেষে খুঁজে পেলাম আজকে রাতের কাঙ্ক্ষিত ডেরা। এটাও একটা নির্মাণাধীন মসজিদ। তবে আগেরটার চেয়ে অনেকটাই প্রাথমিক পর্যায়ে এখানকারটার নির্মাণকাজ। ঐ মসজিদে চারপাশ বেড়া দেওয়া ছিল, এখানে তাও নেই। সর্বত্র মশা, পোকা আর ব্যাঙের অবাধ বিচরণ। এগুলোর মাঝেই বেষ্টনীবিহীন শূন্য মসজিদের এক কোণে থাকা পাটের কার্পেট দিয়ে বিছানা বানালাম। আশপাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশ আর রডের গাঁয়ে দড়ি দিয়ে মশারি টাঙালাম। আজও দুঃস্বপ্ন দেখবো কিনা এই ভয় ছিল, কালকেই কি সেই ঐতিহাসিক (আমার জন্য) মাহেন্দ্রক্ষণ হবে কিনা সন্দেহ ছিল, আহমাদ আদৌ আসবে কিনা একটু হলেও সেটা নিয়ে চিন্তা ছিল; কিন্তু সবকিছু একপাশে রেখে চোখ বুঝলাম অপার ক্লান্তিমাখা শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে। দুঃস্বপ্ন আর কুমিরার রাত যেন একাকার হয়ে মিশে গেলো অজান্তেই তলিয়ে যাওয়া গভীর ঘুমে।
(চলমান...
-------------------------------------------------------
অহেতুক ব্যস্ততার কারণে পঞ্চম পর্বটা দিতে 'অনেক' দেরিই হয়ে গেলো। অতিশয় দুঃখিত আমি...