পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- প্রথম পর্ব
পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- দ্বিতীয় পর্ব
মঙ্গলের ঊষা বুধে পা
যথা ইচ্ছা তথা যা।
ভারতবর্ষের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ লীলাবতী ওরফে মিহির সঙ্গিনী খনার বচন এটি। কৃষিজভিত্তিক নানারকম ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য তাঁর বচন আজো এক প্রকার চর্যাচর্যবিনিশ্চয়। কিন্তু উপর্যুক্ত বচন এই ধারার ব্যতিক্রম। মধ্যযুগের বিদুষী জ্যোতির্বিদ বলতে চেয়েছেন, মঙ্গলের শেষ আর বুধের শুরুর যে ক্রান্তিকাল তা নাকি যেকোনো যাত্রার জন্য শুভ; এমনকি সেটা যথেচ্ছ যাত্রার জন্যেও... এখন বুধবারের ভোর; ২০১০ সালের ২ জুনের বুধবার। শুরুর প্রতীক্ষায় চট্টগ্রাম অভিযাত্রার তৃতীয় দিন...
বাংলাদেশে প্রচলিত সূর্য সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে, বাংলা দিন বা তারিখ আরম্ভ হয় সূর্যোদয়ের এক দণ্ড (১ দণ্ড ২৪ মিনিটসম) আগে থেকে; আর ঊষাকালই হল সেই ক্রান্তিকাল। ভোর পাঁচটার আগেই সেই ঊষাকালে উঠে পড়তে বাধ্য হলাম। অথচ মশাগুলোর বিরক্ত করার মাত্রা কমে যাওয়াতে শেষরাতের দিকে একটু ঘুম আসি আসি করছিল। গাঢ় ঘুমে নিপতিত হবো এমন সময় মসজিদে দিল ভোরের আযান। আর শুয়ে থাকা যাবে না। সব গুছিয়ে উঠে পড়লাম। পায়ের ব্যথাটা নেই। টুপি মাথায় ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাতে ভোরে গেলো মসজিদ প্রাঙ্গণ। আচ্ছা, সাথে মাদরাসাও আছে তাহলে।
পদুয়ার বাজারের জামে মসজিদ থেকে যখন বেরিয়ে এলাম প্রকৃতি তখন ভোরের স্নিগ্ধ আকাশ আর হিমেল বাতাসের এক নৈসর্গিক সম্মেলনে সজ্জিত। গতানুগতিক ব্যস্ত মহাসড়ক আজ এমন ভোরে ব্যতিক্রম। ফাঁকা রাস্তা পার হয়ে ট্র্যাকে ফিরলাম। শুরু করলাম তৃতীয় দিনের মতো হাঁটা। পায়ে আর ব্যথা নেই- এই স্বস্তির নিঃশ্বাস যখন ফেলতে যাবো ঠিক তখনই আবার চিনচিন করে উঠলো বা পায়ের নিম্নাংশ। প্রতি পদক্ষেপে যেন সেই আগের মতোই ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন ভোঁতা রামদা জাতীয় কিছু দিয়ে আমার পায়ের নিচে একটা আনাড়ি কোপ দিয়েছে। তারপর অসম্পূর্ণভাবে কাটা জায়গাটার হাড়ের ভিতর দিয়ে নকশী কাঁথা সেলাই করার যে চিকন লম্বা সুঁই সেটা আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একেকটা পা ফেলছি আর যেন সুঁইটা গেঁথে যাচ্ছে আরো গভীরে। কালকের সন্ধ্যাবেলার সেই চিনচিনে চিকন ব্যথাটা আজ শুরু থেকেই শুরু হয়েছে। মাথায় যেন একটা বাজ পড়লো। তার মানে সারারাতেও... একটুও কমেনি!!! কি করবো এখন আমি!!! বুঝতে পারলাম, হবে না... আমি পারবো না... শেষ দেখতে পারবো না আমি এই পথের। বিরস বদনে, ন্যুব্জ শরীরে গিয়ে বসলাম এক মিষ্টির দোকানে। ইচ্ছামতো মিষ্টি, দই যা আছে সব খাবো। তারপর ঢাকার বাস ধরে সোজা বাসায়। গ্রীষ্মের বন্ধের পুরোটা সময় সলজ্জ মুখে এক কোণায় পড়ে থাকবো আমার রুমে। যারা জানে তাদের নানান রকম ঘাই মারা প্রশ্নবাণের বিপরীতে নিশ্চুপ থাকবো অসহায় চাউনিতে...
স্পঞ্জ মিষ্টির অর্ডার দিলাম। রসসহ পুরো মিষ্টি মুখে পুরে কিছুক্ষণ চাবিয়ে কুত করে গিলে দই আনতে বললাম। চোখের কোণে ঘুম নিয়ে দই দিয়ে গেলো দোকানের জনৈক ‘মিঠাইওয়ালা’। আরেকটা সাধারণ সাদা মিষ্টিও বোধহয় খেয়েছিলাম, ঠিক মনে নেই। তবে এটা ঠিক ঠিক মনে আছে, ৫৫ টাকার সেই ‘ভোজন’ পর্বের শেষ আইটেম চায়ে যখন চুমুক দিতে যাবো এমন সময় মাথার ভিতরে একটা অনুরণন খেলে গেলো। কে যেন বলছে, "পথ ছেড়ো না, ছেড়ে যেও না। দরকার নেই তোমার চট্টগ্রাম যাবার, তুমি ফেনী পর্যন্ত যাও। ইলিয়টগঞ্জের মসজিদে বসে কাগজে যে পাঁচ জুনের হিসাব করেছিলে, কোন দরকার নেই তার বাস্তবায়নের। লাগলে লাগুক ছয় তারিখ পর্যন্ত সময়, হোক সেটা সাত কিংবা আট... কিংবা দশ। কি সমস্যা তাতে... এই সময় নিয়ে যাও না ফেনী পর্যন্তই, প্রয়োজন নেই চট্টগ্রাম যাবার। আগে ফেনী পৌঁছাও... চট্টগ্রাম ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে। ফেনীই এখন তোমার শেষ গন্তব্য... চট্টগ্রাম বলে কিচ্ছু নেই বাংলাদেশে!" শূন্য থেকে নিয়ে এলাম আশার ভেলা। চড়ে বসলাম তাতে, আহত পায়েই আবার নামলাম মহাসড়কের কঠিন পিচে...
প্রত্যূষের পবিত্র নীলিমা আর সকালের সজীব কিরণমালার বর্ডার লাইন চলছে এখন। শুনশান মহাসড়কে ট্রাক ছাড়া আর কিছুই নেই; তাকেও দেখা যাচ্ছে কালেভদ্রে। মাথা বাইরে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সেই ট্রাকের হেলপার, ঝিম মেরে গাড়ি চালাচ্ছে তার ড্রাইভার। এদিকে আমার মাঝেও অস্বাভাবিকতা শুরু হয়েছে। ঘুমের ঘোরে মহাসড়কের ভিতরের দিকে চলে যাচ্ছিলাম আমি। কিছুতেই চেতনাশক্তিকে জাগিয়ে রাখতে পারছিলাম না। বুঝে গেলাম, রাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে না পারার কার্যকারণ হল এখনের এই মাতালের মতো উদ্ভ্রম হাঁটা। মহাসড়ক একটা ভিন্ন জিনিস, এতে ভিন্ন আবহের মাত্রা যুক্ত থাকে। এটা ঢাকা শহর বা মফঃস্বলের কোন হাটবারের ব্যস্ত রাস্তার মতো না। খেয়াল করে দেখবেন, আপনি মহানগরীর কোন ব্যস্ত রাস্তা নির্ভয়ে, আগপাছ চিন্তা না করে গটগট করে পার হয়ে যাচ্ছেন, পাশের ফুটওভার ব্রিজকে কলা দেখিয়ে পার্কার খেলার মতো লাফ মেরে, ঝাঁপ দিয়ে, চলন্ত গাড়ির সামনে দৌড়িয়ে রাস্তার এ মাথা ও মাথা করছেন... নির্দ্বিধায়। কিন্তু এই আপনিই যখন ঈদে বা অন্য কোন উপলক্ষে বাড়ি যাচ্ছেন আর পথে কোথাও গাড়ি থামলে বা থামালে মহাসড়কে পা রাখছেন তখন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছেন। চা বা ধোঁয়া গিলতে রাস্তার অপর পাশের কোন দোকানে যাওয়ার সময় মাশরেক থেকে মাগরেবের মতো এপাশ থেকে ওপাশ যতদূর চোখ যায় মহাসড়ক গাড়িশূন্য থাকলেও বার বার চেক করে নিচ্ছেন, ঠিক দেখছি তো, আসলেই কি কিছু আসছে না... কি, আমি ঠিক বলেছি না? এরকম হবার কারণ কি? প্রথম কারণ হল, মহাসড়কে হেঁটে আমরা অভ্যস্ত নই। এর উপর দিয়ে আমরা ইঞ্জিনের ঘোড়া ছুটিয়ে দাপিয়ে বেড়াই। এখানে হাঁটা বা হাঁটাহাঁটি করা সাধারণ্যের কাজ না। আরেকটা কারণ হল, মহাসড়ক ক্ষমাহীন। এখানে তুমুল বেগে ছুটে চলা কোন যান আপনাকে চাইলে ব্রেক কষে বাঁচাতে পারে, আবার অনিচ্ছায় আপনাকে পিষে চ্যাপ্টাও করে দিতে পারে। আর এটা আমি, আপনি সবাই জানি এবং ভয়সমেত মানিও। তাই প্রাণহীন, শূন্য মহাসড়ক পেয়েও আমরা ঢাকা বা মফঃস্বলের ব্যস্ত রাস্তার মতো এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ি করি না। আর তাই বুঝতে পারলাম, একটু না ঘুমালে চলছে না... একটু দূর হেঁটে সামনে এগোতেই দেখি হাতের বা’দিকে একটা নির্মাণাধীন ফিলিং স্টেশন। সড়ক ছেড়ে নেমে আসলাম। ওখানে কর্মরত একজনকে আমাকে ঘুমাতে দেওয়ার আর্জি পেশ করলাম। আর্জি কবুল হল; কিন্তু শর্তসাপেক্ষে... আমাকে সকাল আটটার মধ্যে উঠে পড়তে হবে। আমি যখন এই কথা শুনলাম তখন বাজে প্রায় সাড়ে ছয়টার কিছু বেশি। অর্থাৎ আমি ঘুমাতে পারবো টেনেটুনে এক ঘণ্টার মতো। সারারাতের ঘুমের অভাব, ক্লান্তিময় আহত শরীরের বিশ্রাম নেওয়ার সময় মাত্র একটা ঘণ্টা। অসম্ভব এক শর্ত পূরণের ওয়াদা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ফিলিং স্টেশনের নামাজ ঘরের শক্ত মেঝেতে...
সকাল ৮:০১ মিনিটে ক্রনিকলে প্রথম কলমের কালি পড়লো। লিখলাম- Journey starts … অর্থাৎ এতক্ষণ যা বললাম সব স্মৃতির পাতা থেকে। আমি মাত্র মিনিট পঞ্চাশের মতো ঘুমাতে পেরেছিলাম আর তাতেই একদম ঝরঝরে সতেজ হয়ে গেলাম। চোখে একদম ঘুম নেই। হাতমুখ ধুয়ে, ফ্রেশ হয়ে আমার ক্ষণিকের সুহৃদ সেই ফিলিং স্টেশনের লোকদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে আসলাম আমার ট্র্যাকে। হাঁটার ধরণের মধ্যে পরিবর্তন আনলাম অথবা বলা যায়, আনতে বাধ্য হলাম- বা পাটা উলম্বভাবে সোজা উপরে তুলে সামনে নিয়ে আবার সোজা উলম্বভাবে নামিয়ে আনা। একটা চারকোনা ফ্রেমের মতো হয়ে যাচ্ছে বা পায়ের প্রতিটা পদক্ষেপ। এতে অবশ্য ডান পায়ের উপর চাপ পড়ছে বেশি; কিন্তু কি করতে পারি আমি! একে একে পার হলাম কাল সন্ধ্যার শেষ কিলোমিটার পোস্ট, অসম্পূর্ণ অথচ অসাধারণ লোকেশনের সেইই মেডিক্যাল কলেজ আর তার ডাক্তার ও আমার সুহৃদ তাপস ভাইকে। গতদিনের পথের পুনরাবৃত্তি শেষ হল; এবার নতুনের সাথে সামনের পানে... মাঝখানের একটা কিলোমিটার পোস্ট বাদ পড়ে গেলো ক্যামনে জানি; ছিল না হয়তো। ৮:২৮ মিনিটে পেলাম চট্টগ্রাম- ১৬৪ আর ঢাকা ৯৮ কে। ভালোই হাঁটছিলাম আমি। বা পায়ে ব্যথা পেলেই পকেট থেকে পেনরিফ বের করে লাগিয়ে নিচ্ছিলাম। ঠাণ্ডা একটা পরশে মুহূর্তে ব্যথাহীন হয়ে যেতো পা খানি। হোক না তা অল্পক্ষণের জন্য; কিন্তু হতো তো। অদ্ভুত বর্গাকার ফর্মুলায় পা ফেলে ফেলে, কিছুক্ষণ পর পর পেনরিফ বের করে আর সকালের মিষ্টি আলোয় চারপাশ দেখতে দেখতে এক সময় ঢাকাকে ১০০ কিলোমিটার পেছনে ফেলে দিলাম; চট্টগ্রাম আর ১৬২ কিলো দূরে। সময় তখন ৮টা বেজে ৫৯ মিনিট। যতই ভাবি না কেন, চট্টগ্রাম আপাতত আমার লক্ষ্য না, আমার লক্ষ্য ফেনী। কিন্তু রক্তে আমার নেশা লেগে গেছে এই মিশন সম্পূর্ণ শেষ করার। ফেনী আছে সান্ত্বনায় কিন্তু চট্টগ্রাম... ভাবনায়, চিন্তায়, কল্পনায়। কষ্ট হচ্ছিল প্রচণ্ড কিন্তু পাত্তা দিচ্ছিলাম না। সবুজে আচ্ছাদিত দূর গাঁও, সড়কের দু’ধারের বিস্তীর্ণ ফসলি জমিন, পাশ দিয়ে সাইকেলে করে পাঠশালায় যাওয়া সাদা ইউনিফর্মের ছোট্ট ছাত্রটি কিংবা মহাসড়কে ধূলা উড়িয়ে ছুটে যাওয়া বিশাল যানগুলোকে দেখতে দেখতে পথ চলছিলাম; মাঝে মাঝে পকেট থেকে বের করছিলাম দু’দিনের বৃষ্টিতে ভিজে কড়কড়ে শক্ত হয়ে যাওয়া ক্রনিকলটি। এগুলো দিয়ে ভুলে থাকছিলাম ক্রমাগত পেতে থাকা যন্ত্রণাকে। কিন্তু আমার জন্য আরো বহুগুণে বিবর্ধিত এক মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল ‘কুখ্যাত’ এই মহাসড়ক...
পৌনে এগারোটার মতো বাজে। দেখলাম একটা বাস আমার পথের বিপরীত দিকে ‘এলোমেলোভাবে’ দাঁড়িয়ে আছে। লাল রঙের বাসটির সামনের কাঁচ নেই। সামনে কিছু মানুষের জটলা। ঐদিকে নজর দিবো এমন সময় দেখলাম মহাসড়ক রক্তে ভেসে গেছে। আর সেই রক্তের মাঝে মাখামাখি হয়ে আছে চারজন মানুষ; চারজন মেয়েমানুষ। সবার সামনের জন স্পট ডেড। বেচারির পা ভেঙে উল্টো হয়ে সাদা হাড় বেরিয়ে গেছে। হাঁটুর কাছে পা খানি বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোরকমে অল্প একটু মাংসের সাথে লেগে আছে। বীভৎস করুণ সেই দৃশ্য। সামনে বাড়ল চোখ। দেখলাম পাশেই একটা কিশোরী মেয়ে; রক্তে মাখামাখি তার ছোট্ট শরীরটা। এই দুই জনের মাঝখান দিয়ে আমি আরো সামনে এগোলাম এবং আরো দুইজন বোরকা পরিহিতা মহিলাকে চোখে পড়লো। তাদের সারা মুখ রক্তে গোসল হয়ে গেছে। একজন খুব আস্তে আস্তে কাতরাচ্ছিল। প্রথমবারের মতো জীবন-মৃত্যুর এরকম বর্ডার লাইন দেখে হতবিহবল হয়ে গেলাম আমি। ভুলে গেলাম আমার নিজের যন্ত্রণা। আহত পা নিয়ে দ্রুত বাড়লাম। এখানে থাকবো না বেশিক্ষণ। মৃত্যুসকাশে সেদিনের অভিজ্ঞতা আমাকে অনেকদিন তাড়া করেছিল। যে জায়গাটিতে দুর্ঘটনা ঘটে সেটি চট্টগ্রাম- ১৫৪ লিখা কিলোমিটার পোস্টের খুব কাছাকাছি ছিল। কেন জানি হঠাৎ করে মৃত্যুভয় চেপে বসলো। একেকটা গাড়ি যখন শরীর ঘেঁষে ওভারটেক করে চলে যেতো, জানা আশংকায় অজান্তে কেঁপে উঠতো মন। একটু থামা দরকার। রাস্তা পার হয়ে একটা বাঁশের হোটেলে গিয়ে বসলাম। দুইটা শিঙাড়া খেয়ে বের হয়ে আসলাম আবার। ধীর পায়ে পথ চলছি অবিরাম, অবিশ্রাম...
দুপুর ১২:৫৩ মিনিটে মহাসড়কে একটা মরা প্রাণী পড়ে থাকতে দেখলাম; খুব সম্ভবত কুকুর হবে। সম্ভবত বলছি এই জন্যে, নিরীহ প্রাণীটা এমনভাবে থেঁতলে গিয়েছিল যে তাকে দেখে বোঝার উপায় নাই সেটা কুকুর নাকি ছাগল নাকি বাছুর। ইচ্ছাবিরুদ্ধ কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে মনটাকে শক্ত করলাম। মিনিট তিনেক পরে ১২:৫৬ তে নজরে আসলো বিডিআরের আমানগন্ডা সীমান্ত ফাঁড়ীর কংক্রিট ফলক। বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ-ভারতের কুমিল্লা অংশের বর্ডার লাইন অতি সন্নিকটে। মাথার উপরের মধ্য গগনের সূর্য্যিমামা ততক্ষণে জ্বলন্ত ফার্নেস হয়ে আছে। চান্দি ফাটার উপক্রম। দর দর করে সমানে ঘামছি। বোতলে থাকা খাওয়ার পানি মাথায় ঢাললাম। সেই পানি মাথা চুইয়ে হাইওয়ের উত্তপ্ত পিচের উপর পড়তেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল শূন্যে। রাস্তার বা’দিকের একটা মসজিদ থেকে নতুন করে পানি ভরলাম। চাপকল চেপে মাথাসহ পুরো শরীর ভিজিয়ে নিলাম। পানিটা এতো ঠাণ্ডা অথচ চারপাশের প্রতিবেশ তার ঠিক উল্টো। অবাক কেরামতি...
আস্তে আস্তে পায়ের ব্যথাটা সয়ে আসছিল। ব্যথা ছিল অনেক কিন্তু সহ্য ক্ষমতা বাড়ছিল সময়ের পথচলায়। আমার সমস্যা হচ্ছিল অন্যখানে এবং সেটা মানসিক। সকালের দেখা সেই লাশ ও জীবন্মৃত মানুষগুলো আর রাস্তায় থেঁতলে থাকা প্রজাতি না জানা ঐ প্রাণীটি কেবলই আমার মনোদর্পণে ফিরে ফিরে আসছিল। যতই মন থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম, ততই জেঁকে বসছিল সে আমার স্মৃতির পটে। সুন্দর কোন ঘটনার অপেক্ষায় আমি। কিন্তু সকাল থেকে সেরকম কোন সুখস্মৃতি পেলাম না। হঠাৎ দেখলাম রাস্তার ওপাশে একটা গিরগিটি টাইপ সরীসৃপ। কত...? ইঞ্চি আটেক লম্বা হবে। এতো ছোট একটা প্রাণী কিন্তু ওর দিকেই আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি। রাস্তা পার হয়ে ও আমার দিকেই এগিয়ে আসছিল অর্থাৎ ও রাস্তা পার হচ্ছিল। ওর এই কাজটাকেই ক্রনিকলে টুকতে যাবো যে, “একটা বাবু টাইপ গিরগিটি দেখলাম রাস্তা পার হয়ে আমার দিকে আসছে; হয়তো আমাকে তার ভালো লেগেছে। শেষ পর্যন্ত এই নিঃসঙ্গ পথিকের এক সঙ্গী হল।” গিরগিটিটা রাস্তার প্রায় ৭০% কভার করে চলে এসেছে এমন সময়... একটা ট্রাক এসে আমার চোখের সামনে ওকে পিষে কিমা বানিয়ে ফেললো। ও কোন এক্সপ্রেশনও দেখাতে পারলো না, চিহ্নিতের অতীত হয়ে গেলো আমার ক্ষণকালের ছোট্ট বন্ধুটি, কোনটা ওর লেজ আর কোনটা ওর মাথা বুঝতেই পারলাম না। প্রাণীর ডেভেলপমেন্টাল স্টেজে সব কোষ যেমন একই রকম থাকে, মনে হচ্ছিল এই ছোট্ট প্রাণীটি সেই স্টেজে চলে গেছে। ক্রনিকলে আমার ছোট্ট বন্ধুটির মৃত্যুর সময় লিখে রাখলাম দুপুর ১:০৫...
১:৪২ মিনিটে কুমিল্লার সর্বশেষ উপজেলা চৌদ্দগ্রামে প্রবেশ করলাম। একটা ফলকে আমাকে স্বাগত বাণী লিখে আমন্ত্রণ জানালো। আপাতত আর সামনে বাড়লাম না। “স্বাগতম চৌদ্দগ্রাম” লিখা সেই ফলকের পাশেই মহাসড়কের বা’দিকে একটা একটা ছোট্ট দোকান। দোকানের সামনে একটা বেঞ্চি রাখা। আমি ঐ বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছিলাম যে, কুমিল্লার এই অংশের মানুষ খুবই ভালো, সহজ-সরল। চৌদ্দগ্রামের মানুষগুলো হয়তো একটু বেশিই সরল। আমার এই অনুমান পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়।
-বর্ডার আর কতদূর, ভাই?
-বেশি না, আট দশ কিলু অইবো...
-আমি শুনছি, বর্ডার ঘেঁষে যাওয়া মহাসড়ক নাকি একদম জনশূন্য, কোন দোকানপাটও নাকি নাই?
-অ্যাকদম নাই যে তা না। কম, অনেক কম। আপনে সামনে চৌদ্দগ্রাম বাজার পাইবেন। ঐখান থেইক্কা সদাই কিন্না নিতে পারবেন।... আইচ্ছা ভাই, আপনে কবে বাইর হইছেন ঢাকা থেইক্কা? হাইট্টাই যাইবেন পুরাডা?
হাসিমুখে কিছু সরল প্রাণের কৌতূহল মিটিয়ে আর তাদের চোখেমুখে একরাশ ঔৎসুক্য জিইয়ে রেখে ঠিক ২টা নাগাদ সামনে বাড়লাম আমি। আস্তে আস্তে মানুষের আনাগোনা বাড়তে লাগলো, বাড়তে লাগলো মহাসড়কের দুই পাশে ইট-বালু-রডের কঠিন ইমারতের সংখ্যাও। ২:২৫ মিনিটে চোখে পড়লো চৌদ্দগ্রাম ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স। বুঝতে পারলাম, ধীরে ধীরে এগোচ্ছি আমি চৌদ্দগ্রাম সদরের দিকে। মিনিট দশেক পরে রাস্তার বা’দিকে নজরে আসলো একটা খেজুর গাছ। মরু এলাকার এই নিঃসঙ্গ প্রজাতিটিতে দেখে সেই সময়ের আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। ২:৪৫ মিনিটে চোখে পড়লো ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজ। একই সাথে আমার ক্রনিকল হয়ে উঠছিল তথ্যসমৃদ্ধ। পথের খুঁটিনাটি টুকে রাখায় অভিজ্ঞ হয়ে উঠছিলাম আমি। নতুন একটা কাজে ধাতস্ত হবারও তো একটা ব্যাপার থাকে, তাই না? চৌদ্দগ্রাম বাজার থেকে হাফ লিটারের একটা ফ্রুটো কিনলাম। রাশেদুলের (আমার ছোট ভাই) কাছে শুনেছিলাম, চৌদ্দগ্রাম বাজারের কিছু পর থেকে নাকি বর্ডার ঘেঁষা মহাসড়কে কিচ্ছু পাওয়া যায় না; না থাকে নাকি কোন দোকান, না পাওয়া যায় একটা খাবার হোটেল। জনশূন্য আর বৃক্ষহীন এক পথ নাকি আমার অপেক্ষায়...
মাথার উপর এখন মেঘলা আকাশ। তবে এই আকাশের কেঁদে ফেলার কোন সম্ভাবনা নাই। ভাসমান মেঘের ভেলাগুলো যেন সূর্যের চরম চোখ রাঙানির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করার নিমিত্তে আগত। চৌদ্দগ্রাম সদর ছেড়ে এসেছি অনেকক্ষণ হল; শহুরে নীরস চেহারা আবার গ্রাম্য নির্মল রূপে ফিরে এসেছে। ৩:৪৯ মিনিটে চোখে পড়লো মোটামুটি বিরাট একটা দীঘি। স্থানীয় কয়েকজন মারফত জানলাম এটার নাম গোলমানিক্কা দীঘি। মহাসড়কের কাঠিন্য এখন অনেকটাই ভাটির দিকে। পায়ের ব্যথাও সহ্যের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি। নতুন একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। “স্বাগতম চৌদ্দগ্রাম” লিখা ফলকের পাশের যে দোকানে কিছুক্ষণের জন্য থেমেছিলাম, ওখানে জুতা খুলে দেখলাম আমার দুই পায়ের বেশ কিছু জায়গায় পানি জমে ফোস্কা পড়ে গেছে। দুই এক জায়গার ফোস্কা ইতোমধ্যেই ফেটে গেছিল। হয়তো সময়ের সাথে সাথে আরো কয়েকটা ফোস্কা ফেটে গেছে। মনে হচ্ছে আরো কয়েকটা ব্যান্ডেজ লাগাতে হবে দুই পায়ের জায়গায় বেজায়গায়। ৩:৫৯ মিনিটে একটা কিলোমিটার পোস্টের তথ্য লিখে শেষ হল আমার প্রথম ক্রনিকল ডায়েরিটি। আমার সাথে এই বেচারাও অনেক ধকল সহ্য করেছে। চট্টগ্রাম- ১৩৫, ফেনী- ২২ আর পিছনে ঢাকা- ১২৭, কুমিল্লা- ৩৫ তথ্যটি লিখে বিশ্রামে পাঠালাম আমার আড়াই দিনের পকেট সঙ্গীটিকে। বের করলাম নতুন ক্রনিকল...
বিকাল তখন চারটা বেজে এক মিনিট। হঠাৎ করেই হল ব্যাপারটা। গাছগাছালির আড়াল থেকে সহসা উন্মুক্ত হয়ে গেলো মহাসড়কের বাঁদিক। এক অপার্থিব সৌকর্য দেখলাম দুচোখ দিয়ে। মুখ ফুটে আপনা আপনি বের হয়ে আসলো, বেহেশত এর থেকেও কি সুন্দর!!! (কথাটা ধনাত্মক রূপকার্থে, ঋণাত্মক ব্যঙ্গার্থে নয় মোটেই) বাংলাদেশ-ভারতের কুমিল্লা অংশের বর্ডার লাইন আমার পথের অদূরে। পা জমে গেলো কঠিন পিচের উপরে। মুখ হা হয়ে গেলো সৌন্দর্যের ওপার বিস্ময়ে। বাক্যবাগীশ এই আমি বাক্যহীন হয়ে গেলো। আমার ঘোর কাটাতে পাশের ক্ষেত থেকে উঠে আসলেন দুজন কৃষক। একজনের নাম আবদুল মান্নান মিয়াজি, অপরজন মোহাম্মদ আলম। মিয়াজি ভাইয়ের কাছ থেকে আমার স্থির দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটির বিস্তারিত নিলাম। আমি এখন চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামে; সামনের বর্ডার আমার ট্র্যাক থেকে ৪০০ গজ পূর্বে। কৃষক বন্ধুদ্বয় থেকে বিদায় নিয়ে সামনে বাড়লাম। গতি আমার সম্মুখ পানে কিন্তু দৃষ্টি দূরের পুবের টানে। ৪:২৮ মিনিটে বিডিআরের আনন্দপুর বর্ডার স্টেশনের কংক্রিট ফলকটি দেখলাম। কিন্তু বর্ডার স্টেশনটি কোথায়? আরো ভিতরে মনে হয়। দাঁড়িয়ে পড়লাম পথের মাঝে। একটু বিরতি নিবো... বিশ্রামের খাতিরে না, সীমান্তের ওপার রহস্যময় সৌন্দর্য দেখতে... দূউউর, বহুদূরে দেখলাম দুইটা গার্ড পোস্ট; কাদের আণ্ডারে এতো দূর থেকে বোঝা গেলো না। কিভাবে যে বলি, কত সুন্দর ছিল সেই মেঘমেদুর নিসর্গের সীমান্ত অঞ্চল!!! আপনাদের আমি লিখে বোঝাতে পারবো না। বুঝতে হলে সেখানে যেতে হবে। পাঁচ মিনিট বসে থেকে ৪:৪৭ এ আবার শুরু করলাম... হাঁটা। এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার হাঁটার গতি চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যাচ্ছে। পায়ের ব্যথা একেবারেই অনুভব করছি না, এমনকি দুই পায়ের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে যেসব ফোস্কা পড়ে ভয়ানক যন্ত্রণা দিচ্ছিল সেটাও টের পাচ্ছি না। যাইহোক, বিকাল ৫:০৫ মিনিটে কয়রা বাজার পার হলাম; ছোট্ট একটা ছিমছাম বাজার। ৫:২৩ এ দেখলাম জগন্নাথ দীঘি। গাছগাছালি আর অদূর গাঁয়ের কারণে মাঝে মাঝেই চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছিল দুই দেশের নো ম্যানস ল্যান্ড... বর্ডার লাইন।
অস্বাভাবিক দ্রুততায় পথ চলছিলাম আমি। সকাল বেলায় যেখানে আমার একেক কিলোমিটার পার হতে ষোল থেকে বিশ মিনিট সময় লাগছিল। সেই একই পা জোড়া দিয়ে এখন আমি সেই একই দূরত্ব জাস্ট এগারো বেশি হলে বারো মিনিটে পার হচ্ছি! আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না, আমার কি হচ্ছে। অতিরিক্ত ব্যথায় মানুষ অনেক সময় শকে চলে যায়, তখন আর ব্যথার অনুভূতি থাকে না। আমি কি ঐরকম কোন শকে চলে গেলাম? নাকি চারপাশের মোহনীয়, জাদুময় সৌন্দর্যে স্পেল বাউন্ড হয়ে গেছি? বিকালবেলা বিদায় নিচ্ছে... সন্ধ্যাতারাকে সাথে নিয়ে অপেক্ষায় গোধূলি লগ্ন। ৬:০৯ এ বিডিআরের (অদেখা) সাতঘড়িয়া বর্ডার স্টেশন পার হলাম আর ৬:২৪ এ পাদুয়া বাজার। হাঁটছি তো হাঁটছি... কোন থামাথামি নেই। চারপাশের সব মানুষ অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। কিন্তু তাদের বিস্মিত চাউনি আর অবাক দৃষ্টির মাঝেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৪২ মিনিটে...
থামতে বাধ্য হলাম। আসলে কথাটা হবে... আমাকে থামতে বাধ্য করলো একজন, “ভাই, একটু থামেন। সেই তিন কিলো দূর থেকে দেখে আসছি আপনি হাঁটছেন তো হাঁটছেনই। থামাথামির কোন নামগন্ধ নেই! কি হয়েছে আপনার, ভাই! এমন হাঁটছেন কেন!" কি উত্তর দিবো তাকে আমি? তাও দিতে হবে বলে দিলাম একটা উত্তর। এই পথে নেমে মানুষের যে অভিব্যক্তিতে আমি সবচেয়ে বেশি মজা পাই সেটা আমার উত্তর শুনে সেই যুবক বয়সী ছেলেটি আমাকে দিলো। তার অনুরোধে সেদিনের মতো যাত্রাবিরতি করলাম চৌদ্দগ্রামের একদম শেষপ্রান্তের কাইছুটি নামক এক স্থানে। সেখানকার এক ফিলিং স্টেশনের নামাজ ঘরে আজকের রাতটা কাটাবো। ফিলিং স্টেশনের নাম ইউনিভার্সাল সিএনজি স্টেশন। অনেকক্ষণ সেই ফিলিং স্টেশনের একজন মালিকের সাথে কথা বললাম। দক্ষিণ কোরিয়া ছিলেন কয়েক বছর। টাকা-পয়সা জমিয়ে শেয়ারে এই ফিলিং স্টেশনটা দিয়েছেন তিনি। ওনার কাছ থেকে জানলাম, আমরা যেখানে বসে আছি সেখান থেকে বর্ডার খুব কাছে। আর আমি আছি কুমিল্লার একদম শেষ প্রান্তে। আর এক কি দেড় কিলো... তারপর থেকে ফেনী জেলা শুরু। তারমানে আজকেরটা নিয়ে টানা তিন রাত আমার কুমিল্লায় কাটবে! কাটুক, কি আর আসে যায় তাতে... ঘুমাতে গেলাম কন্টেইনার কেটে বানানো অস্থায়ী নামাজ ঘরে। আমার জন্যে কয়েকজন স্টাফ তাদের ঘুমানোর ভালো জায়গাটি ছেড়ে দিয়েছেন। কয়েকজন নাইট ডিউটি করবেন, বাকিরা এক পাশে জড়সড় হয়ে ঘুমাবেন। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে। গভীর রাতে ঝুম বৃষ্টি নামলো কাইছুটিতে, সেই সাথে বজ্রপাত। বাজ পড়ার আওয়াজে গম গম করে কেঁপে উঠছে কন্টেইনারসমেত পুরো এলাকা। কষ্ট আর স্বস্তি, আনন্দ আর বিষাদ, মন্থরতা আর গতিময়তা, সৌন্দর্য আর বীভৎসতা- এমন আরো অনেক বৈপরীত্যের সমাবেশ ছিল আজকের এই দিনটিতে। আসলে এটাই জীবন... ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, চড়াই-উৎরাইয়ে গড়া এক রহস্যময় বর্ডার লাইন।
(চলমান...)