পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম- প্রথম পর্ব
হেল দ্য হাইওয়ে
দ্বিতীয় পর্বঃ Hell the Highway…
জুনের প্রথম সকাল, মঙ্গলবার। নীল আকাশের মাঝে লাল সূর্য নিয়ে আসলো এক নতুন ভোর। ইলিয়টগঞ্জের সেই জামে মসজিদকে এখন বিদায় দিতে হবে। এক সহজ সরল মাদরাসা ছাত্র, সাইফুলের অকৃত্রিম আতিথেয়তায় রাতটা বেশ আরামেই কাটলো। ভালো ঘুম হল রাতে। যদিও শেষরাতের দিকে মসজিদ সংলগ্ন বাজারে জনৈক চোরের আগমনে হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধে; কিন্তু তার আগেই প্রগাঢ় এক ঘুম দিয়ে সতেজ হয়ে গেছি আমি। বিগত রাতেই মসজিদে বসে একটা হিসাব কষে নিয়েছিলাম, কতদিন লাগতে পারে আমার চট্টগ্রাম পৌঁছতে। হিসাব অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমি জুনের ৫ তারিখে পৌঁছে যাবো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থল নিউমার্কেট জিরো পয়েন্টে। সময় এখন পথে নামার... কাগজের এই হিসাবকে বাস্তবে রূপদানের প্রচেষ্টার...
সবকিছু গুছিয়ে আবার পা রাখলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কঠিন অ্যাস্ফাল্টে। হালকা কুয়াশামাখা সেদিনের সকালে লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে ইলিয়টগঞ্জের স্থানীয় বাজার। মহাসড়কের ধারে সাইকেলে করে টাটকা মাছ নিয়ে এসেছে রাতজাগা ভোরের মাঝি, সবুজ সবজির কার্পেট হয়ে আছে সড়কের পাশের নিচু মেঠো পথ, ঘুম ঘুম চোখে মানুষের নৈমিত্তিক কর্মব্যস্ততা দেখতে দেখতে কোমরে ব্যাগের স্ট্যাপ বাঁধলাম। তারপর রাস্তা পার হয়ে বা’দিকে চলে আসলাম। এবার শুরু আবার... সকাল ৬:২০ এ আমার যাত্রা আরম্ভ হল। মিনিট পাঁচেক পরেই প্রথম কিলোমিটার পোস্ট চোখে পড়লো... চট্টগ্রাম এখন গুণে গুণে ২০০ কিলোমিটার দূরে; ঢাকা ৬২ কিলোমিটার পশ্চাতে আর কুমিল্লা ৩৩ কিলোমিটার অগ্রে অপেক্ষমাণ। ৬:৩৮ মিনিটে আমার উপজেলা দাউদকান্দিকে বিদায় দিয়ে মুরাদনগরে প্রবেশ করলাম। ৭:১৯ মিনিটে পাঁচ মিনিটের একটা ব্রেক নিলাম। হাঁটছিইই তো হাঁটছিই... ধীর ও লয়সম পদক্ষেপে; উতরাই দেখে যেমন নেই কোন ত্বরা, তেমনি চড়াইয়ে নেই ছিটেফোঁটা জড়া। হৃৎপিণ্ডের ছান্দিক গতির ন্যায় এক তালে হেঁটে গেলাম প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ। ৯টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি... চট্টগ্রাম আর ১৯০ কিলোমিটার দূরে। আর তখন থেকেই...
প্রথমে খেয়াল করিনি যে, আমি একটু পর পর থামছি। এ থামা ফুসফুসের ক্লান্তি নিবারণ কিংবা ঘেমে যাওয়া শরীরে প্রশান্তির নিমিত্তে নয়, এটা একটা নির্দিষ্ট পায়ের জয়েন্টের ব্যথা থেকে। পাত্তা দিলাম না একটুও। দুই-তিন মিনিটের জন্য বিরতি নিলেও পথচলা রইলো অবিরাম। সকাল ৯:০৯ মিনিটে চান্দিনা পৌঁছলাম। ততক্ষণে মহাসড়কের দুই ধার হয়ে উঠেছে প্রাণে চঞ্চল। সবাই যার যার ধান্ধায়, কর্মে ব্যতিব্যস্ত, নিবিষ্ট। মনে মনে ভাবছি, এভাবে হাঁটতে থাকলে তো হিসাব করা সময়ের আগেই পৌঁছে যেতে পারবো... আর তখনই প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম বা পায়ের টার্সালের (অর্থাৎ পায়ের যে জাংশন থেকে আমরা পায়ের পাতা বিভিন্ন দিকে ঘুরাই) চিনচিনে ব্যথাটা। বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা হাড়ের থেকে উৎসারিত। তারপরও হাঁটতে লাগলাম; গতি কমে আসলো কিন্তু... থামলাম না। কখনো আট মিনিট, কখনো চার মিনিট আবার কখনো ছয় মিনিটের জন্য থামতে হচ্ছে। সাধারণত আমি চার কিলোমিটার হেঁটে তারপর কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই। কিন্তু পায়ের ব্যথায় সেই নিয়মের নিদারুণ ব্যত্যয় ঘটলো। হাঁটার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা প্রকট হয়ে উঠলো। একেকটা পদক্ষেপ ফেলছি আর মনে হচ্ছে ব্যথা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। এভাবেই এক সময় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করলাম। তখন দুপুর ১২:২৫। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় ঢুকতে না ঢুকতেই একটা কিলোমিটার পোস্ট পড়লো। চট্টগ্রাম ১৭৭; অন্য পিঠে ঢাকা ৮৫। একটু পর সেনানিবাসের মূল ফটকের সামনে চলে আসলাম। এই জায়গাটুকু দাঁতে দাঁত চেপে (সত্যিই দাঁতে দাঁত চেপে) স্বাভাবিক পদক্ষেপে পার হলাম। সেনাবাহিনীর কোন সদস্যের সামনে আমি আমার অসহায় পরিস্থিতির ব্যাপারটা দেখাতে চাই না। ওরা ব্যাপারটাকে করুণার চোখে দেখতে পারে।
ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া পার হয়ে এসেছি এমন সময় হঠাৎ খেয়াল হল... এতদূর আসলাম আর ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি দেখে যাবো না! ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি অবশ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পড়ে না। এটি মূল মহাসড়ক থেকে উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চলে গেছে যে সড়ক তার এক পার্শ্বে অবস্থিত। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর যে চৌরাস্তার মতো তার একদিকে টিপরা বাজার। সেই বাজারকে ডানে রেখে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ধরে মিনিট সাতেক হাঁটলেই রাস্তার বাঁদিকে পড়বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। বেলা ১২:৪০ মিনিটে অ্যাপ্রোচ চেঞ্জ করে হাঁটতে হাঁটতে যখন সিমেট্রির সামনে পৌঁছলাম, দুর্ভাগ্য আমার... দুপুরের মধ্য বিরতির জন্য সিমেট্রির প্রধান ফটক বন্ধ। সামনে লাগানো বিজ্ঞপ্তিফলকে দেখলাম, সকাল ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সিমেট্রি খোলা থাকে; তারপর ঘণ্টাখানেক বিরতি দিয়ে ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বাকি সময়। ৫টার পর প্রবেশের অনুমতি নেই। রমজান মাসে সকাল ৭টা থেকে একটানা দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা। বছরের দুই ঈদের দিন সিমেট্রি পুরো বন্ধ। বিজ্ঞপ্তিফলকের তথ্যগুলো আমার ক্রনিকলে টুকে নিলাম যাতে পরবর্তীতে আমার মতো মন্দভাগ্য অন্য কারো না হয়। বাইরে থেকেই যা দেখার দেখে নিয়ে ১:২২ মিনিটে ফিরতি পথে ট্র্যাকে ফিরলাম।
ক্রমবর্ধমান ব্যথাকে সঙ্গী করে আবার শুরু করলাম হাঁটা। এমন সময় নামলো বৃষ্টি। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগছিল। রাস্তার বা পার্শ্বের এক দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। নাই কাজ তো খৈ ভাজ। খৈ না পাওয়ায় ভাজতে পারলাম না; কিন্তু জেনে নিলাম কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই আসলে কোথায় পাওয়া যায়। জেনে রাখুন, মহাসড়কের পাশে যত রসমালাইয়ের দোকান আছে, এমনকি কোন কোনটার আবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘অনুমোদন’ও আছে, সেগুলো একটাও আসল রসমালাই প্রস্তুত করে না। যে রসমালাইয়ের জন্য আমার কুমিল্লা দেশবিখ্যাত তার উৎস ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধারে কাছেও নেই। এর অবস্থান কুমিল্লা শহরের ভিতরে সোনালী ব্যাংকের পশ্চিম পার্শ্বে কালী মন্দিরের বিপরীতে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫০ গজ সামনে রাস্তার ডানদিকে। নামঃ আদি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। যে দোকানে দাঁড়িয়েছিলাম, তার দোকানিই তথ্যটি দিলেন। হুবহু টুকে নিলাম ক্রনিকলে। কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে গেলো ‘বিরক্তিকর’ বৃষ্টি। সাত মিনিট পর ১:৪৭ মিনিটে বেরিয়ে এলাম আবার।
পায়ের ব্যথা অসহ্য মাত্রায় বেড়ে গেলো। একেকটা পদক্ষেপে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে এক সময় আলেখারচর পৌঁছলাম। তখন বাজে দুপুর ২টা। এই আলেখারচরে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্য আছে। নাম- যুদ্ধজয়। এখান থেকে রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একভাগ বাঁদিক দিয়ে সোজা কুমিল্লা শহরে; এই রাস্তা ধরলে এক সময় পাওয়া যাবে সেই আসল আদি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সন্ধান। আর অন্য রাস্তাটি হল বর্তমানের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (N1) । আমি স্থানীয় এক দোকানে ঢুকলাম ফোন করার জন্য। রাশেদুল ও ছোট মামাকে ফোন করলাম। পায়ের ব্যথার কথা জানালাম। দুজনই আশেপাশে কোন অর্থোপেডিক্স ডাক্তার থাকলে তাঁর কাছে যেতে বলল। সমস্যাটা হাড়ের। যেন তেন জায়গায় গিয়ে উল্টো আরো ঝামেলা বাধানোর কোনই দরকার নাই। এখন এই মহাসড়কের পাশে ডাক্তার কই পাই, যাকে আবার অর্থোপেডিক্সে স্পেশালিষ্ট হতে হবে! একটা হসপিটাল কাম মেডিক্যাল কলেজ অবশ্য অনেক দূরে ক্যান্টনমেন্টের আগে ফেলে এসেছি- ইস্টার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। কিন্তু আমি পিছনে ফিরে ওখানে যাবো না। এমনকি ট্র্যাক চেঞ্জ করে কুমিল্লা শহরেও ঢুকবো না। আজ বুঝি, সেদিনের সেই একরোখা জেদি স্বভাব ছিল স্রেফ অভিজ্ঞতা কম থাকার ফল; অদম্য মানসিকতার বোকামি প্রতিফলন। কিন্তু একই সাথে এটাও চিন্তায় আসে যে, সেই হার না মানা স্বভাব, সেই জেদ, সেই সাহসী মনোভাবই কিন্তু আমাকে আজ এক অন্য মানুষে পরিণত করেছে। এই পরিবর্তন আমি বুঝি আর তারা বোঝে যারা আমাকে Chittagong Expedition এর আগে ও পরে কাছ থেকে দেখেছে।
N1 এর এই অংশটা আনকোরা। তাই রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো ছায়াদার হয়ে ওঠেনি এখনো। সুযোগ পেয়ে মাথার উপরের সূর্য যেন তার প্রখরতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। দরদর করে ঘামতে লাগলাম। ভেজা কপালের নোনা পানি দুই চোখের ভ্রুর কাছে এসে জড়ো হয়ে একসময় নিজের ভারেই পড়ে যাচ্ছিল নিচে। সেই সাথে বাড়ছিল পায়ের ব্যথাটা। বেশ মন্থর হয়ে আসলো হাঁটার গতি। অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসলো। দ্রুত মাইনাস পাওয়ারের চশমা খুলে সানগ্লাস চোখে দিলাম। আঁটসাঁট করে চোখের সাথে লাগিয়ে রাখলাম যাতে অঝোর ধারার পানি চশমার ফাক গলে বাইরে বেরিয়ে লোকের গোচরে না পড়ে। আমার এখনো মনে আছে, টপ টপ করে পড়তে পড়তে আমার সানগ্লাসের নিচে পানি জমে গিয়েছিল। দুটি ফ্রেমের নিচের দিকে জমে থাকা সাদা সাদা লবণের উপস্থিতি নিয়ে সানগ্লাসটা আমার কাছে অনেক দিন পর্যন্ত ছিল... ঝামেলা বাঁধলো অন্যখানে। এই স্টাইলিশ সানগ্লাসে তো পাওয়ার নেই। একে তো চোখভর্তি পানি, তার উপর নেই -২.২৫ ডাই অপ্টারের চশমা। ফলে একটু সামনের জিনিসও ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। অগত্যা সানগ্লাস পকেটে রেখে দিলাম। ব্যথার সাথে কান্না চেপে রাখারও প্র্যাকটিস করতে শুরু করলাম। সেদিন কেন আমার কান্না এসেছিল? আমি নিজে থেকে এনেছিলাম তাকে? নাকি সেই এসেছিল স্বেচ্ছায়? আসলে প্রকৃতি আর নিয়তির অমোঘ টানে আমি না চাইলেও সেদিনের চোখ ভরে উঠছিল...
এমনিতে আমার একেক কিলোমিটার পার হতে গড়ে ১৩ থেকে ১৪ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটা বেড়ে দাঁড়ালো কখনো সতেরো, কখনো আঠারো আবার কখনো বা বিশে। ক্রনিকলে তথ্য টুকতেও ভুল হয়ে যাচ্ছিল। যেমন বেলা ২:৫৩ মিনিটে আমি চট্টগ্রাম- ১৭২ আর কুমিল্লা- ৫ লেখা কিলোমিটার পোস্ট অতিক্রম করি। কিন্তু ক্রনিকলে লিখি ৩:৫৩। স্থানীয় কিছু লোকের থেকে জানতে পারি সামনে কয়েক কিলো দূরে বিশ্বরোড পদুয়ার বাজার বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে বিকাল বেলা ডাক্তার বসেন, ‘ভালো’ ডাক্তার। ৪:৫৩ মিনিটে সড়কের ডানদিকে একটা ফলকে দেখলাম- কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় লিখে বিপরীত দিকে তীর চিহ্ন দেওয়া। বিকালের ক্লান্ত সূর্য সেদিনকার মতো তার শেষ দীপ্তিহীন কিরণমালা দিয়ে আমাকে ক্লান্ত করার চেষ্টা করছে। ৫:১৭ মিনিটে পদুয়ার বাজার রেলক্রসিং পার হলাম। অনেক সুন্দর একটা জায়গা। শেষবেলার ঠাণ্ডা বাতাসে ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলাম কষ্ট। দূর থেকে নজরে আসলো সদাব্যস্ত বিশ্বরোড পদুয়ার বাজার। তিন মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেখানে। বিকাল তখন ৫টা বেজে ২০ মিনিট। এই ফার্মেসি সেই ফার্মেসি ঘুরতে লাগলাম। ফার্মেসির দোকানদারেরা বিভিন্ন ওষুধ দেখালো। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো। এমন সময় একজন শ্রদ্ধেয় হিতাকাঙ্ক্ষী পরামর্শ দিলেন, এখান থেকে ঠিক ১ কিলো দূরে একটা বেসরকারি হাসপাতাল আছে। আমি যেন ওখানে যাই। ওখানে অর্থোপেডিক্সের ডাক্তারও পাওয়া যাবে। আমার চোখে তখন অসহায়ত্বের ছাপ। উনি কি সঠিক কথা বলছেন? আসলেই কি এটা ১ কিলো দূরে? নাকি আরো বেশি? অনেক বেশি? সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, কি করবো আমি?
হাজার প্রশ্ন নিয়ে আবার নামলাম পথে... অজানার পথে। পদুয়ার বাজারে আমি প্রায় ৫৫ মিনিটের মতো ছিলাম। সন্ধ্যা ৬:১৫ মিনিটে যখন আমি সন্ধ্যাবেলার ব্যস্ত মহাসড়কে পা ফেললাম তখন আমার লক্ষ্য আর চট্টগ্রাম নেই, সেটা বদলে সেই অদেখা হাসপাতাল হয়ে গেছে। কিন্তু আর হাঁটতে পারছিলাম না। একে তো কাঁধে ভারী ব্যাগ; তার উপর সারাদিনের খাটনিতে সর্বাঙ্গে ক্লান্তি অনুভব করছিলাম। লেন চেঞ্জ করে রাস্তা থেকে নেমে আসলাম। ডানদিকে অদূরে কিছু সাদা সাদা বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে রাখা হয়েছে। আমি গিয়ে ওখানে বসলাম। কাছেই কিছু ছোট ছোট ছেলে খেলাধুলা করছিল। আর আমার পাশে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ দাদু। সেদিনের সেই সন্ধ্যাকাশ ছিল বেগুনী রঙের, সামনের ছোট্ট শান্ত লেকের প্রবহমান পানি ছুঁয়ে আসা বাতাস ছিল ঝিরিঝিরি হিমেল প্রবাহের, আর পরিবেশটা ছিল ভয়ংকর রকমের মায়াবী আবহের। অথচ এই অবস্থায়ও আমার ব্যথা কমছিল না। পায়ের ব্যথা ভুলে থাকার জন্য হাসিমুখে সেই দাদুর সাথে গল্প শুরু করলাম। উনি এখানে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। জামাই স্থানীয় পল্লী বিদ্যুতে কাজ করেন। আঙুল তুলে মেয়ের বাড়ি দেখালেন... ও, এই খুঁটি তাহলে ঐ দূরের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। দশ মিনিট ছিলাম সেই সাদা পাঞ্জাবী পরা দাদুর সাথে বসে। আমি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো মনে রাখবো তার মধ্যে এই ১০ মিনিটের বিরতি আর সেই বৃদ্ধ দাদুর সাথে গল্প করার স্মৃতি চির অমলিন হয়ে থাকবে।
সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৯ মিনিট। আজকের দিনের শেষ কিলোমিটার পোস্ট থেকে জানলাম- চট্টগ্রাম আরো ১৬৬ কিলোমিটার দূরে, ফেনী ৫২ কিলোমিটার; আর কুমিল্লা জাস্ট ১ কিলোমিটার পেছনে, ঢাকা ৯৬ কিলোমিটার সেই সুদূরে। একই সাথে আরো জানতে পারলাম যে, পদুয়ার বাজার থেকে বেসরকারি হাসপাতালটি প্রায় দেড় কিলো দূরে আর তার নাম সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হসপিটাল। নবনির্মিত হাসপাতালের অপরিণত ক্যাম্পাসে এসে কথা বললাম সেখানকার এক ছাত্রের সাথে। আমার সমস্যার কথা শুনে আমাকে নিয়ে গেলো হাসপাতালের ভিতরে। সেখানেই পরিচয় ডাঃ তাপসের সাথে। ডাঃ তাপস ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ২০০৮ সালে পাশ করে এখানে জয়েন করেছেন। উনি আমার কথা শুনে গভীর মনোযোগ দিয়ে আহত পা খানি দেখলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন, ১৪ দিনের বেডরেস্ট। আমি সাথে সাথে বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম, সেটা কবে থেকে? ডাঃ তাপস যা জানালেন তা হল- আমার পায়ে যে ইনজুরি হয়েছে তা বেশ মারাত্মক আকারের। ন্যূনপক্ষে ২ দিন বিশ্রাম না নিলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। উনি আমাকে একগাদা ওষুধ লিখে দিলেন। সাথে ৬ ইঞ্চি প্লাস্টার। ওনার প্রেসক্রিপশন দেখে আমার পায়ের ব্যথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যেতে বাধ্য হলাম। উনি আমাকে Todol নামের এক ওষুধ সাজেস্ট করেছেন যেটা কিনা ভরা পেটে খেতে হবে; আর আমি আজ টানা দুইদিন ভাত না খাওয়া। আমার প্রধান খাবার ছিল গ্লুকোজ মেশানো পানি। এক বোতলে থাকতো স্যালাইনের পানি, আরেকটায় গ্লুকোজের। মাঝে মাঝে চাপকল থেকে শুধু পানিও ভর্তি করতাম। শক্ত খাবার হিসেবে থাকতো পুরি, শিঙাড়া কিংবা পরোটা। তাও দুইটার বেশি না এবং দিনে দুইবারের বেশি না। উনি আমাকে এই হাসপাতালেই ভর্তি করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি; তবে ওষুধ কেনার জন্য পিছনে ফিরে আবার সেই পদুয়ার বাজার যেতে আমাকে রাজি হতে হয়েছিল। কারণ হাসপাতালে আমাকে সাজেস্ট করা বেশিরভাগ ওষুধ ছিল না তখন। তো কি আর করা, আবার পথে নামলাম। নিয়ম ভেঙে চললাম সেই পথে যাকে কিছুক্ষণ আগেই পিঠ দেখিয়ে পেছনে ফেলে এসেছিলাম।
বিপদ যখন ঘনিয়ে আসে চারিদিক থেকে সে তার ‘সৈন্যসামন্ত’ নিয়ে আসে। মহাসড়কে নামতেই নামলো ঝুম বৃষ্টি। কোথাও যে একটু আশ্রয় নেবো তার বিন্ধুমাত্র উপায় নেই। একে তো ঘন অন্ধকার, তার উপর এই রাস্তাটা নতুন হওয়ায় দু’ধারে একটাও বড় গাছ ছিল না। ফলে মুহূর্তের মধ্যে ভিজে জবজবে হয়ে গেলাম আমি, ভিজে গেলো আমার ব্যাগ, ভিতরে থাকা সব কাপড়চোপড়, সবকিছু। রাস্তার উপর দিয়ে গর্জন করতে করতে ছুটে চলা গাড়িগুলো আমাকে নতুন করে আর না ভেজালেও হেডলাইটের তীব্র ঝলকানিতে চোখদুটো ঠিকই ঝলসে দিচ্ছিলো। সেই অন্ধকার রাতের ব্যস্ত মহাসড়কে আমিই ছিলাম একমাত্র পথিক। সামনেও কেউ নেই, পিছনের দূর ঋজু পথও জনশূন্য। কতোটা যে অসহায় লাগছিল নিজেকে, কতোটা যে একা লাগছিল তখন...
অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব আমার মধ্যের জেদ আরো বাড়িয়ে দিলো। মনে মনে ঠিক করলাম, ডাঃ তাপসের (যৌক্তিক) সাজেশন মানবো না। উনি একটা মলম সাজেস্ট করেছিলেন। পেনরিফ নাম। ঠিক করলাম ওটা কিনবো শুধু। আর বাকি সব বাদ। ওটা পায়ে মেখে রাতটা পদুয়ার বাজারের স্থানীয় জামে মসজিদে কোনোরকমে কাটিয়ে দেবো। আশা করি, মলম লাগিয়ে রাখলে রাতের মধ্যে ব্যথা সেরে যাবে। দোকান থেকে কাকভেজা হয়ে পেনরিফ কিনলাম এবং স্থানীয় মসজিদে এসে বসলাম। এই মসজিদে থাকার অনুমতি পেতে বেশ বেগ পেলাম। যাইহোক, আস্তে আস্তে মসজিদ খালি হয়ে গেলো। রয়ে গেলাম কেবল আমি একা। বা পায়ে পেনরিফ মেখে ব্যাগ থেকে সব ভেজা জামাকাপড়, ভেজা মশারি বের করলাম। মশারিটা কোনোরকমে টাঙিয়ে ভেজা জামাকাপড়গুলো দিয়ে বিছানা বানিয়ে তার উপর শুয়ে পড়লাম। মশারিতে লাভ হল না কোন; আমার সাথে সঙ্গিনী হল একগাদা নারী (!) মশা। ইলিয়টগঞ্জে নিজের মশারি বের করতে হয়নি। সেই মাদরাসার ছাত্র সাইফুলের মশারির নিচেই ঘুমিয়েছিলাম। টনটন করছিল পা দুটো। চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছিল কিন্তু মশার যন্ত্রণায় একটুও হচ্ছিল না। তার উপর মসজিদটা মহাসড়কের ঠিক পাশেই হওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর সগর্জনে ছুটে যাওয়া একেকটা গতিদানবের তীব্র কর্কশ আওয়াজ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। জনশূন্য রাতের ফাঁকা পথে স্বাধীন মতো দাপিয়ে বেড়ানো গাড়িগুলোর ইঞ্জিন কেড়ে নিচ্ছিলো আমার দু’চোখ জুড়ে আসা আরাধ্য ঘুমকে। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে কাটালাম। ঘুম আসলো না একটুও। ফোনও নেই যে আম্মার সাথে আগের রাতের মতো একটু কথা বলবো। ইমাম সাহেব যাওয়ার সময় মসজিদ বাইরে থেকে তালা মেরে গেছেন। অবশ্য এই কাজে আমার সমর্থন আর সনির্বন্ধ অনুরোধও ছিল! শক্ত পাকা মেঝের উপর শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা হয়ে গেলো। পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম সামনের দিনগুলোতে আরো প্রকটিত হবে মহাসড়কের নিষ্ঠুরতা। আপনা থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, Hell the Highway…
(চলমান...)
.................................................................................
চট্টগ্রাম এক্সপেডিশনে আমি কোন ক্যামেরা কিংবা মোবাইল ফোন নিয়ে যাইনি। তাই আমার যাত্রাপথের কোন ছবি আমি আপনাদের দেখাতে পারছি না।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৩৪