...সেই কবে শেষ এই প্রিয় প্লাটফর্মে এসেছিলাম! পরীক্ষার চাপ অনেক বড় চাপ। অনার্স ফাইনাল থাকার কারণে বেশ কিছুদিন ব্লগে লেখক হিসেবে অনুপস্থিত ছিলাম। অবশ্য এই ব্লগের একজন নিয়মিত পাঠক আমি; আবার মন্তব্যে অনিয়মিত... এটাতেও নিয়মিত হতে হবে এখন থেকে। ব্লগ জগতে তিন বছরে পা পড়লো। আজকের হিসেবে (৪ জানুয়ারি ২০১৫) ৩ বছর ৩ দিন।
কেন আমি নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিকঃ
আমি যখন সামুতে একাউন্ট খুলি তখন কি নিক দেওয়া যায় ভাবছিলাম। অনেক ভেবে ঠিক করি নাম... আমি একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। তবে আমার ঘোরাঘুরি অন্য সবার মতো না। এই কথা বলে যে আমি সাধারণ্যের প্রতি তাচ্ছিল্য করছি তা কিন্তু মোটেও না। আসলে আমি বলতে চাইছি, আমার ঘুরে বেড়ানোর স্টাইল আলাদা। আমি একা একা ঘুরি। একা একা ভ্রমণ করি। একা পথ চলি। আমার এই নিঃসঙ্গ ঘোরাঘুরি শুরু হয় ২০১০ সালের মে মাসের শেষাশেষি থেকে। প্রথমবারের মতো মহাসড়কে নামি ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম... মহাসড়ক ধরে... প্রায় ২৫০ কিমি। এই পুরোটা পথ একা একা পাড়ি দিতে সোয়া পাঁচ দিন সময় লাগে আমার। ২০১০ সালের ৩১ মে থেকে ৫ জুন- এই ছিল প্রথম এক্সপেডিশনের ব্যাপ্তিকাল। চড়াই-উৎরাই, আনন্দ-বেদনা, রোদবৃষ্টি, হাসিকান্না- এইসব নিয়েই আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ রহমতে এক সময় আমি লক্ষ্যে পৌঁছাই।
প্রথম এক্সপেডিশনের সাফল্য আমাকে আরো সাহসী উদ্যোগে উৎসাহিত করে। আবার বের হই নতুন লক্ষ্যে... এবারের লক্ষ্য আরো বড়। ঢাকা থেকে বাংলাদেশের সর্বউত্তরে; অর্থাৎ সেই উত্তরের শেষ প্রান্তে যেখানে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট অবস্থিত। ৫৩২ কিমির সুদীর্ঘ এক পথ পাড়ি দিতে ১৩ দিন সময় লাগে। সময়টা সেই ২০১০... হেমন্তের উত্তরবঙ্গ। ৩ নভেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর ছিল দ্বিতীয় এক্সপেডিশনের সময়কাল।
ভার্সিটির দুই অবকাশে এই ট্যুর দুইটা দিয়েছিলাম। পরের বছর আমার জীবনে এক বড়সড় ঝড় বয়ে যায়। ২০১১ সাল ছিল আমার জন্যে এখন পর্যন্ত (হয়তো সারাজীবনের জন্যেই) সবচেয়ে ট্র্যাজেডিময় বছর। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমাকে ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। '১১ সালের শেষের দিকে ক্যান্সারে আম্মা মারা যান। আমি হয়ে যাই নিঃসঙ্গ এক মানুষ। আম্মাকে হারানোর শোককে শক্তি করতে অনেক টাইম লেগে যায়। জীবনে ফিরতে আবার এক্সপেডিশনে বের হই। নিঃসঙ্গতা কাটাতে সামুতে জয়েন্ট করি। শুরু করি লেখালেখি। আমার প্রথমদিকের কিছু লিখা ড্রাফ্ট করার কারণে এখন আর দেখায় না। প্রথম পাতায় সুযোগ পাওয়ার পরে আমি সেই লিখাগুলো রিপোস্ট করি। মিথ্যা বলে লাভ কি বলেন... আমি চেয়েছিলাম লিখাগুলো আরো অনেক মানুষ পড়ুক। তাই রিপোস্ট...
...এক দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১২ সালের ২১ মার্চ আবার পথে নামি আমি। লক্ষ্য একবার ৩৬০ আউলিয়াবিধৌত সিলেট। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে টানা ৬ দিন সময় নিয়ে ২৪০ কিমি পথ পাড়ি দিই। আল্লাহ্র রহমতে আগের দুইটা এক্সপেডিশনের অভিজ্ঞতায় বেশ ভালোভাবেই পৌঁছে যাই আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে; বাসা থেকে বের হবার সময় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম সেটারই বাস্তবায়ন করতে পারি পথে নেমে। মহান স্বাধীনতা দিবসে শেষ হয় আমার পথচলা। আগের দুইটা এক্সপেডিশনের সাথে আমার এই সিলেট এক্সপেডিশনের একটা বড় পার্থক্য ছিল। কি সেটা বলতে পারবেন কেউ...? আম্মা ছিল না আমার সাথে। লক্ষ্যমাত্রা যাই হোক, আমার জিরো পয়েন্ট সবসময়ই আমার আম্মা ছিল। তাই আম্মার কবর থেকে অশ্রুভেজা চোখে শুরু করি আমার তৃতীয় এক্সপেডিশন।
আম্মা যে আমার কি ছিল তা তাঁর অনুপস্থিতিতে হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকি। ছন্নছাড়া এক জীবন কাটাতে থাকি আমি। আমার ছিল না দিনের ঠিক, না ছিল রাতের ঠিকানা। ঘুরে বেড়ানোর মানুষ আমি... এখানে ওখানে একা একা ঘুরে বেড়াতাম। তবে আল্লাহ্র কাছে অনেক শুকরিয়া, উনি আমাকে ঠিক পথে রেখেছিলেন। আম্মার সেই চোখে চোখে রাখার অনুপস্থিতিতে আমি বখে যাইনি। কেন যাইনি জানেন? কারণ সে এসেছিল। দীর্ঘ প্রেমবিহীন জীবনে প্রথমবারের মতো সে এসেছিল। বাউন্ডুলে হয়ে পড়া এই নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক জীবনে ফেরে আবার। নতুন আশার ভেলা বানায় সে। তারপর...
আবার পথে নামি আমি। আমার চতুর্থ এক্সপেডিশন ছিল ঢাকা থেকে সুন্দরবনবিধৌত খুলনায়। ৩৩০ কিলোমিটারের এক দীর্ঘ পথ রোদবৃষ্টি মাথায় নিয়ে পাড়ি দিতে সাড়ে আট দিন সময় লাগে। আমার আগের তিনটা এক্সপেডিশন ১০০% পায়ে হেঁটে ছিল। কিন্তু খুলনা এক্সপেডিশন সেরকম হয়নি। আসলে বলা উচিৎ, হতে পারেনি। আরিচা দিয়ে রাজবাড়ি জেলায় ঢুকতে আমার ফেরি পার হতে হয়। মন খারাপ করে অনন্যোপায় হয়ে সেই ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিই। সেদিনের মেঘাচ্ছন্ন দিন যেন আমার মনেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে ছিল।
আর পথে নামা হয়নি। ইচ্ছা ছিল হিল এক্সপেডিশন দিবো। বাংলাদেশের সুউচ্চ তিনটা পাহাড়ে উঠবো। কিন্তু আমার একাকী পথচলায় বাধ সেধে বসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা আমাকে একা এপথে যেতে দিবে না। আর তাই আজও পাহাড়ে যাওয়া হয়ে উঠেনি আমার।
নিঃসঙ্গতা ভালো আবার ভালো না। সঠিকভাবে নিঃসঙ্গতাকে উপভোগ করতে পারা একটা বড় অর্জন। কিন্তু স্থিতিশীল জীবন যথার্থ নিঃসঙ্গতার জন্যে হানিকর। নিঃসঙ্গতার মতো অতি পানসে অবস্থাও মধুময় হয়ে ওঠে যখন আপনি হয়ে উঠবেন একজন অভিযাত্রিক। অজানার নেশায় ছুটে যাবেন মৃত্যুভয়ে সংকুচিত না হয়ে, অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমাবেন পিছুটানমুক্ত হয়ে। অজানায় তখন দেখা মিলবে অজানার। Never lose hope...., Never Stop Expedition.... যদি এই আপ্তবাক্যটি মন-মনন-কায়ায় ইন্সটল করতে পারেন তাহলেই হওয়া সম্ভব নিঃসঙ্গ হয়েও অভিযাত্রিক তথা নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক...
পরিশেষেঃ ঠিক করেছি, এই ভ্রমণকাহিনীগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। আর আজকের এই লিখাটা তার উপক্রমণিকা। প্রথমে ছয় পর্বে লিখবো আমার চট্টগ্রাম এক্সপেডিশনের কাহিনী। বেঁচে থাকলে কাল দিবো প্রথম কিস্তি। বাকিগুলোও একে একে লিখে ফেলবো, ইন শা আল্লাহ্। সবাই সাথে থাকবেন আশা রাখি...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫০