“তুমি কোনোভাবেই নিজের হাতে স্বীয় প্রাণ সংহার করতে পারবে না। লাগতে পারে তিন বছর, কিংবা পাঁচ; কিন্তু যাই ঘটুক না কেন আমরা তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি নেতৃত্ব দিয়ে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিজে একজন সৈনিক হিসেবে বেঁচে আছো। তোমাকে নারিকেল খেয়ে বেঁচে থাকতে হতে পারে। যদি তাই হয়, তবে নারিকেল খেয়েই বেঁচে থাকবে! কোন অবস্থাতেই তুমি স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেবে না।” ডিভিশন কম্যান্ডারের এই নির্দেশকে অমোঘ বিধান হিসেবে শিরে ধার্য করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চলে গেলেন তরুণ যুবা হিরু ওনোদা। আর যখন ফিরলেন তখন মহাযুদ্ধের তামাম লীলাখেলা শেষ হয়ে সেই বহুদূর। মাঝখান দিয়ে কম্যান্ডারের সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ভুল যুদ্ধে কাটিয়ে আসেন জীবনের প্রায় ৩০টি বসন্ত। বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে বিভীষিকাময় যুদ্ধে পরাজিত জাতির এক জয়ী যোদ্ধার নির্মম সত্য কাহিনি এটা!
হিরু ওনোদা। জন্ম ১৯২২ সালের ৩০ মার্চ; জাপানের কাইসো জেলার কামেকাওয়া গ্রামে। বয়স যখন ১৭ তখন কাজের জন্য চীন চলে যান। হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান নগরীর তাজিমা ইয়োকো ট্রেডিং কোম্পানিতে কাজে যোগ দেন। কিন্তু বেশিদিন সেখানে কাজ করতে পারেননি। ২০ বছর বয়সে ফিরে আসেন আবার জাপানে। যোগ দেন জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীতে। সেখানে ওনোদা একজন ইনটেলিজেন্ট অফিসার হিসেবে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নাকানো ইনটেলিজেন্ট স্কুলের ফুতামাতা (Futamata) কমান্ডো দলের একজন সদস্য। ট্রেনিং শেষে ওনোদাকে ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপপুঞ্জে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। তার উপর আদেশ ছিল- যেকোনো উপায়ে শত্রুপক্ষের চলাচল, আক্রমণ প্রভৃতিতে বাঁধা প্রদান করা; হোক সে লুবাং এয়ারফিল্ড ধ্বংস করে কিংবা পোতাশ্রয়ের জেটি আক্রমণ করে । আর কি কি আদেশ ছিল তা তো পাঠককুল আপনারা এখন জানেনই।
লুবাং ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী এক সমুদ্রবিধৌত দ্বীপপুঞ্জ। ১৯৪৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ওনোদা যখন এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপপুঞ্জে পা রাখেন বাকি বিশ্বের ন্যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের করাল গ্রাসে সমগ্র ফিলিপাইন তখন নিমজ্জিত। সব জায়গায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির জয়জয়কার। শেষ চেষ্টা হিসেবে অক্ষপক্ষের অন্যতম সদস্য জাপান যা করতে পারতো ওনোদার অ্যাসাইনমেন্ট ঠিক তাই ছিল। জায়গায় বেজায়গায় শত্রুপক্ষকে বাধাপ্রদান করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওনোদা তার কাজ ঠিকমতো করতে পারেনি। আর তা হয়নি ওনোদার গ্যারিসন কম্যান্ডারদের কারণে। মূলত লুবাং দ্বীপপুঞ্জে আসার সাথে সাথেই সেখানে অবস্থানরত একদল জাপানী সৈন্যের সাথে সাক্ষাৎ হয় ওনোদার। সেই দলের যেসব অফিসার ওনোদার থেকে র্যাঙ্কের দিক থেকে উচ্চপদস্থ ছিল তারাই আসলে ওনোদাকে ঠিকমতো কাজ করতে দেয়নি। ব্যাটারা তখন নিজেদের পিঠ বাঁচাতে শশব্যস্ত। এই অসহযোগিতা কিন্তু মিত্রপক্ষকে দারুণভাবে সহযোগিতা করলো। ফলে যা হবার তাই হল। ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন কমনওয়েলথ ফোর্সের সম্মিলিত আক্রমণে লুবাং জাপানের হাতছাড়া হওয়া শুরু করলো এবং এক সময় হয়েও গেলো। ওনোদাসহ মোট চারজন সৈন্য কোনোমতে পালিয়ে বাঁচল। বাকিরা হয় মারা গেছে নয়তো যুদ্ধবন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। ওনোদা, যিনি ইতোমধ্যেই লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হয়েছেন, বাকিদের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। নিজেও নিলেন। আর তারপর...
ওনোদার সাথে যে তিনজন ছিল তারা প্রত্যেকেই সৈনিক পদমর্যাদার। প্রাইভেট উইচি আকাতসু, কর্পোরাল শইচি শিমাদা এবং প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস কিনশিচি কজুকা। এর মধ্যে উইচি আকাতসু ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে দলত্যাগ করেন এবং ছয়মাস পর ফিলিপিনো ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এমনিতেও তারা অনেক সতর্ক ছিল, উইচির দলত্যাগ অন্যদের আরো সতর্ক করে দিলো। আর সতর্ক হবেই বা না কেন! আত্মসমর্পণের পর এই উইচিকে দিয়েই ফিলিপিনো ফোর্স আকাশ থেকে লিফলেট দেওয়া শুরু করলো। কিন্তু এর ফল হল উল্টো। তারা ধরেই নিলো যে উইচি শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে। আর এখন লিফলেট দিয়ে তাদের ধোঁকা দিয়ে শত্রুর হাতে ধরিয়ে দিতে চাইছে। ফলে তারা জঙ্গলের আরো গভীরে সেঁধিয়ে গেলো। এই লিফলেট অবশ্য অনেক আগে থেকেই দেওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু যুদ্ধ শেষ, এখন সময় জীবনে ফেরার- এই কথা ওনোদাদের কে বোঝাবে। তারা সবগুলোকেই শত্রুপক্ষের প্রোপ্যাগান্ডা আর ধোঁকা বলে মনে করলো। অতি স্বাভাবিক এই মনে করা। তাদের ফিরে আসার জন্য প্রথম লিফলেট ছাড়া হয় অক্টোবরে অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরপরই। এরপর আরো ছাড়া হয় যার কোন কোনটিতে ১৫ আগস্ট যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে আর তাদের পাহাড় থেকে নেমে আসার কথা লিখা ছিল। কিন্তু এসব লিফলেটের কোনটিই তারা বিশ্বাস করলো না। এমনকি ’৪৫ এর শেষের দিকে বোয়িং বি-১৭ থেকে ফেলা জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের কম্যান্ডার জেনারেল তোমোয়ুকি ইয়ামাশিতার “ফিরে আসো” টাইপ লিফলেটও তাদের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে পারেনি। অবশ্য জেনারেলের স্বাক্ষর করা একটা কাগজ, তার তো একটা ভারিক্কী আছে। তাই কাগজটি আসলেই আসল কিনা তা নিয়ে তারা অনেকদিন ধরে গবেষণা (!) করলো। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে তারা প্রত্যেকেই একমত হল যে- লিফলেটটি ভুয়া! ফলে বহাল থাকলো সেই পালিয়ে থাকার জীবনই।
১৯৫২ সালে প্লেন থেকে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের পক্ষ হতে চিঠি ও ছবি ফেলা হল। বলা হল ফিরে আসার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তিনজন এটাকেও ধোঁকা হিসেবে ধরে নিলো। পরের বছর জুন মাসে ঘটলো এক দুর্ঘটনা। কর্পোরাল শিমাদা গুলিবিদ্ধ হল। একদল ফিলিপিনো জেলের সাথে বন্দুকযুদ্ধে শিমাদার পায়ে গুলি লাগে। কিন্তু ওনোদার ঐকান্তিক সেবায় সুস্থ হয়ে উঠলো শিমাদা। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৭ মে শিমাদা মারা পড়লো তাদেরই খুঁজতে আসা সার্চ টিমের গুলিতে। ওনোদার সাথে এখন শুধুই কজুকা। শিমাদা মারা যাবার দশ দিনের মাথায় আবার লিফলেট ফেলা হল। সাথে লাউডস্পিকারে ঘোষণা করা হল, “ওনোদা, কজুকা, যুদ্ধ শেষ।” বরাবরের মতো এটাকেও তারা আমেরিকানদের একটা কূটকৌশল হিসেবে ধরে নিলো। ওনোদাকে আমরা দোষ দিতে পারি না কিন্তু। কারণ কমবেশি আমরা সবাই জানি যে, কূটনামির জন্য আমেরিকা আজো অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে। আর তখন তো আরো বেশি ছিল। তাছাড়া ওনোদা ও কজুকার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে একদিন তার স্বদেশীরা আমেরিকানদের হটিয়ে দিয়ে আবার এই ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের দখল ফিরে পাবে। একজন জাপানি নাগরিক বেঁচে থাকতে তাদের জন্মভূমি হেরে যেতে পারে না। আর এতো বড় যুদ্ধ তো আর রাতারাতি থেমে যাবে না। একশ’ বছর লেগে যাবে এই মহাযুদ্ধে জিততে। এই বিশ্বাসই তাদের ঐ অবিশ্বাসের কারণ ছিল।
এবার যুক্ত হল ওনোদার আপন ভাই তাদাও। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সেও ভাইকে ফিরে আসার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালো। কিন্তু অনেক দূর থেকে কথকের চেহারা বোঝা যাচ্ছিলো না। আমেরিকানরা নিশ্চয়ই তার ভাইয়ের মতো কাউকে সাজিয়ে এনেছে- এই ভেবে এটাকেও ওনোদা ফেলে দিলো বাতিলের খাতায়। জলে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানো, কখনো খাবারের জন্য স্থানীয় ফিলিপিনোদের আক্রমণ করা, তারপর আবার পালিয়ে বেড়ানো- এই ছিল ওনোদাদের আবর্তনসংকুল অথচ বিবর্তনহীন জীবনের দৈনন্দিন চক্র। স্থানীয়দের কাছে তারা মূর্তমান আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিলো। তারা ওনোদাদেরকে “পাহাড়ি দস্যু” “পাহাড়ি শত্রু” ইত্যাদি উপাধিতে (!) ভূষিত করলো। করবেই বা না কেন! মাঝে মাঝেই তাদের দুজনের হাতে এইসব সাধারণ দ্বীপবাসী বেঘোরে প্রাণ হারাতো। ওনোদারা এইসব সাধারণ মানুষকে শত্রুপক্ষ মনে করতো। তাদের গেরিলা কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ জনের মতো ফিলিপিনো নিহত হয়। স্থানীয় পুলিশের সাথেও তাদের বেশ কয়েকবার ছোটোখাটো খণ্ডযুদ্ধ (Skirmishes) হয়েছে। ’৬৫ এর শেষের দিকে ওনোদা ও কজুকা একটা ট্রানজিস্টার রেডিও সংগ্রহ করলেন যেখানে পিকিং থেকে সংবাদপ্রবাহ হচ্ছিলো। যেহেতু তাদের মন সেই ’৪৫ এই আটকে ছিল, তাই কোন কিছুই তারা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তবে শিল্প পরাশক্তি হিসেবে জাপানের উত্থানের খবর তাদের মনে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। আর এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো তাদের দিনগুলি।
১৯ অক্টোবর ১৯৭২; ওনোদা ও কজুকা ধান সিদ্ধ করছিলো। এইসব ধান স্থানীয় থেকে পাওয়া। কিন্তু সেদিন তারা ছোটোখাটো(!) একটা ভুল করে বসে যার জন্য বড়সড় একটা মাশুল দিতে হয়। সেদিন তারা একটু বেশি সময় নিয়ে ধান পোড়ায়। সেই ধোঁয়া স্থানীয় পুলিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের ছোড়া দুটি গুলি কজুকার শরীরে বিদ্ধ হয় যার মধ্যে একটি হৃদপিণ্ড এফোঁড়ওফোঁড় করে চলে যায়। সাথে সাথে মারা যায় ওনোদার দীর্ঘদিনের সাথী প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস কিনশিচি কজুকা। নিঃসঙ্গ ওনোদা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লো। “শত্রুকে” এখনই আক্রমণ করতে গেলে খামোখা প্রাণবায়ু উড়ে যেতে পারে। এদিকে কজুকার মৃত্যুর পরে আবার সবাই নড়েচড়ে বসলো। কারণ ওনোদা ও কজুকাকে ১৯৫৯ সালে দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার কারণে মৃত ঘোষণা করা হয়। আবার শুরু হয় সার্চ পার্টির দৌড়াদৌড়ি, লাউডস্পীকারে ঘোষণা আর লিফলেট ফেলা। এমনকি তাকে নিয়ে লিখা ম্যাগাজিন ও পত্রিকা ফেলাও বাদ যায়নি। হাস্যকরভাবে সেগুলোর কোন কোনটিতে তার সুদীর্ঘ নিখোঁজের ভিত্তিতে করা গায়েবানা (!) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিস্তারিত খবরও ছিল। কিন্তু কোন কিছুই ওনোদা বিশ্বাস করলো না। সে এই দ্বীপেই তার জীবনের বাকি দিনগুলো কাটানোর জন্য মনস্থির করে ফেললো। আর তখনই ঘটলো এক ঘটনা...
তিনটি জিনিসের সন্ধানে বের হওয়া জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ঝরুয়া (অর্থাৎ যে ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে!) ছাত্র ওনোদার আক্রমণের শিকার হলেন। ওনোদা তাকে দেখামাত্রই মেরে ফেলতেন। কিন্তু সুজুকির ভাগ্য ভালো। হ্যাঁ, সেই ছাত্রের নাম নোরিও সুজুকি। জাপানের হোসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র সুজুকির পড়াশোনা মোটেই ভালো লাগতো না। তার রক্তে যে মিশে ছিল ঘোরাঘুরির অদম্য নেশা। সেই নেশার টানে ১৯৬৯ সালে বেরিয়ে পড়েন। সমানে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা চষে বেড়ান। কিন্তু ’৭২ সালে আবার জাপানে ফিরে আসেন। কিন্তু এই পরিবেশ, জীবন সবকিছু তার কাছে মেকি মেকি লাগে। এমন সময় জাপানি মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হতে থাকে কিনশিচি কজুকার মৃত্যুর খবরটি। একই সাথে ওনোদার বেঁচে থাকার বিষয়টিও। সুজুকি মনস্থির করে ফেললেন। ওনোদাকে খুঁজে বের করবেন তিনি। সাথে আরো দুইটা জিনিস। একটি হল পাণ্ডা, আরেকটি অ্যাবমিন্যাবল স্নোয়ম্যান (Abominable Snowman) বা ইয়েতি। তিনি একটি ক্রমধারাও ঠিক করে ফেললেন। প্রথমে মহাযুদ্ধের হারানো যোদ্ধা ওনোদা, তারপর পাণ্ডা এবং সবশেষে ইয়েতি। চলে আসলেন লুবাং দ্বীপপুঞ্জে। সুজুকির খোঁজা লাগলো না। তাঁবুর ভিতরে ওনোদাই সুজুকিকে খুঁজে বের করলো। সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। অবাক চোখে সুজুকি দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিস্মৃত মহাযুদ্ধের গোঁয়ার যোদ্ধা। ওনোদা আর সুজুকি একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। দুজনের মাঝে বেশ ভাব জমে উঠলো। ওনোদা সুজুকির সাথে কিছু ছবিও তুললেন।
সুজুকি তাকে জীবনে ফিরতে আহ্বান জানালেন। 'বন্ধু' সুজুকির কথায় সরাসরি সায় দিলেন না ওনোদা। তিনি জানালেন, তার কম্যান্ডারদের কেউ যদি তাকে ফিরে আসার আদেশ দেন তো তবেই তিনি ফিরবেন। নতুবা নয়। সুজুকি কথা দিলেন তিনি তার কম্যান্ডারদের সাথে কথা বলবেন। ওনোদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলেন সুজুকি। প্রমাণ হিসেবে জাপান সরকারকে তাদের দুজনের মধ্যে তোলা ছবিগুলো দেখালেন। ওনোদা তাকে কি কি বলেছিল তাও তাদের বললেন। জাপান সরকার নড়েচড়ে দাঁড়ালো! খুঁজে বের করা হল ওনোদার সেই কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশিমি তানিগুচিকে।
৯ মার্চ, ১৯৭৪ সাল। শনিবার। ওনোদা তাদের নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দেখলেন সেখানে সুজুকির রাখা একটি চিরকুট, সাথে প্রথমবার সাক্ষাতে তাদের দুজনের তোলা দুটি ছবি এবং দুটি সামরিক আদেশপত্র। ওনোদা ঠিক করলেন একটা সুযোগ নেওয়া যেতে পারে। ফলে পরদিন তিনি সুজুকির সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। দুইদিনের যাত্রা শেষে দেখা পেলেন বন্ধু সুজুকির। কিন্তু একি! সাথে ইনি কে! এ যে সেই কম্যান্ডার যিনি ৩০ বছর আগে ওনোদাকে আদেশ দিয়েছিলেন। যেই আদেশের কারণে ওনোদা সবকিছুকে মিথ্যাজ্ঞান করে মাতৃভূমির জন্য আজো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এ যে সেই মেজর তানিগুচি। মেজর তাকে জীবনের গতিময় ধারায় ফিরে আসতে আদেশ করলেন। বললেন,
“১/ ইমপেরিয়াল কম্যান্ড অনুযায়ী ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সমস্ত সামরিক কার্যাদি রহিত করা হল।
২/ সামরিক হেডকোয়ার্টার কম্যান্ড নং এ-২০০৩ মতে, স্টাফ হেডকোয়ার্টার্সের স্পেশাল স্কোয়াড্রনকে সব সামরিক কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।
৩/ স্পেশাল স্কোয়াড্রনের আওতাধীন সমস্ত ইউনিট ও ব্যক্তিবিশেষকে যাবতীয় সামরিক কর্মকাণ্ড এবং অপারেশন স্থগিতকরণপূর্বক নিকটবর্তী ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে রিপোর্ট করার জন্য বলা হল। যদি সেরকম কেউ না থাকে তো তখন আমেরিকা কিংবা ফিলিপিনো ফোর্সের সাথে যোগাযোগ করে তাদের নির্দেশনা নেওয়ার আদেশ দেওয়া হল।”
ওনোদা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পুরো ব্যাপারটা হজম করতে তার অনেক সময় লাগলো।
“আমরা সত্যিই যুদ্ধে হেরে গেছি! কিভাবে তারা (জাপানিরা) এটা মেনে নিতে পারলো? সহসাই যেন সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। আমার ভিতরে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। এতদিনের এতো কষ্ট আর সতর্ক পদক্ষেপের জন্য নিজেকে বোকা মনে হতে লাগলো। তার থেকেও খারাপ লাগছিলো এই ভেবে যে, এতো বছর তাহলে আমি করলামটা কি? ধীরে ধীরে আমার ভিতরের ঝড়টা থিতিয়ে আসলো। আর প্রথমবারের আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার তিরিশ বছরের গেরিলা জীবনের এখানেই সহসা সমাপ্তি। আজ সব শেষ। আমি আমার রাইফেলের বল্টটা পিছন দিকে টানলাম, বের করে আনলাম বুলেটগুলোকে। আমার কাঁধের বোঝাটিকে পীঠ থেকে নামিয়ে তার উপর রাইফেলটি রাখলাম। সত্যিই কি এই রাইফেলটি আমার আর কাজে লাগবে না যাকে এতো বছর ধরে নিজের সন্তানের মতো করে অতি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম? কিংবা কজুকার রাইফেল, যেটিকে পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে রেখে এসেছি? সত্যিই কি তিরিশ বছর আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিলো? যদি তাই হয় তো কিসের জন্য শিমাদা আর কজুকা প্রাণ দিলো? যদি এটাই সত্য হয়, তাহলে কি তাদের সাথে আমারও মরে যাওয়া ভালো ছিল না?”
এতো কেন’র উত্তর কে তাকে দেবে? কারো কাছেই যে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। থাকার কি কথা? ওনোদা আত্মসমর্পণ করলেন না। তিনি মেজর তানিগুচির কাছে তার তলোয়ার, .২৫ ক্যালিবার আরিসাকা টাইপ ৯৯ রাইফেল, ৫০০ রাউন্ড গুলি আর হ্যান্ড গ্রেনেডগুলো হস্তান্তর করলেন। এমনকি তার সাথের ড্যাগারটিও দিয়ে দিলেন যেটি তার মা তাকে আত্মরক্ষার জন্য সুদীর্ঘ ৩০ বছর আগে দিয়েছিলেন। তবে অনেকে বলেন যে, ওনোদা ফিলিপাইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোসের কাছে তার তলোয়ারটি সমর্পণ করে নিজেকেও সমর্পণ (আত্মসমর্পণ) করেছিলেন। তবে আমি বলি কি, ইতিহাস তো সবসময়ই জয়ীদের দ্বারা লিখিত হয়; অতএব এইরকম কথা কেউ কেউ বলতেই পারেন।
ওনোদা ফিরে আসলেন তার প্রিয় জন্মভূমি জাপানে। বীরের সম্মান দেওয়া হল ওনোদাকে। শত সহস্র উৎসুক মানুষ ঘিরে ধরল এই সাহসী বীরকে। তার আগে তাকে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষমা করে দিলেন ফিলিপাইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোস। ওনোদা এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন যে কেউ কেউ তাকে জাপানের জাতীয় আইনসভা পরিচালনার অনুরোধ জানালেন। ১৯৭৪ সালে ওনোদা তার ৩০ বছরের গেরিলা জীবনের উপর মাতৃভাষায় একটি বই লিখলেন। এটি পরের বছর ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়। নাম দেওয়া হয়- নো সারেন্ডারঃ মাই থার্টি-ইয়ার ওয়ার।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও ওনোদা মানিয়ে নিতে পারছিলেন না নতুন এই পরিবেশের সাথে। পরিবর্তিত জাপান যেন তার কাছে বড়ই বেমানান। তাই ’৭৫ এর এপ্রিলে ওনোদা জাপান ত্যাগ করে তার বড় ভাই তাদাও এর কাছে চলে যান। তাদাও ব্রাজিলের এক পশু প্রজনন কেন্দ্রে কাজ করেন। ওনোদা তার সাথে যোগ দেন। ’৭৬ এ ওনোদা বিবাহ করেন। ১৯৮৪ সালে আবার জাপানে ফিরে আসেন তিনি। টিনএজদের জন্য গঠন করেন ওনোদা শিজেন জুকু অর্থাৎ ওনোদা নেচার স্কুল নামের এক প্রতিষ্ঠান যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের জীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা। তবে তার স্বদেশে ফেরত আসা আর এরকম একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনের মূল কারণ হিসেবে ছিল ১৯৮০ সালে ১৯ বছরের এক টিনএজ বালক কর্তৃক তার (টিনএজের) মা-বাবার খুন হবার মর্মান্তিক ঘটনা।
ওনোদার কি আর কখনোই ইচ্ছা করেনি সেই লুবাং দ্বীপপুঞ্জে ফিরে যাবার? করেছিল। আর তাই ১৯৯৬ সালে তিনি আবার সেই দ্বীপপুঞ্জে যান। এবার আর যোদ্ধার বেশে, হত্যাকারীর ভূমিকায় নয়; বরং একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে, দাতার ভূমিকায়। তিনি স্থানীয় এক স্কুলে দশ হাজার মার্কিন ডলার দান করেন। ওনোদার বইতে ৩০ বছরের জীবনের সব উঠে আসলেও তিনি ও তার সহযোদ্ধাদের হাতে লুবাং এর সাধারণ মানুষ মারা যাবার কথা লিখা ছিল না। বইটা যেহেতু আমি নিজে পড়ে দেখিনি তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য অনুচিত। তবে কথাটাকে এভাবে বলা যায়, যদি বিষয়টা আসলেই সত্য হয় তো তা সত্যিই নিন্দনীয়।
পরিশেষেঃ ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি ওনোদা তার বন্ধু সুজুকির কাছে চলে যান। মনে আছে তো সুজুকির কথা? যার জন্য ওনোদা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। ২০১০ সালের এক সাক্ষাতকারে ওনোদা সুজুকির ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করে বলেন, “এই হিপ্পি বালক সুজুকি এক জাপানি সৈন্যের অনুভূতি জানতে লুবাং দ্বীপপুঞ্জে আসে। সুজুকি আমাকে জিজ্ঞাসা করে কেন আমি ফিরে যাচ্ছি না...”।. কিন্তু অশীতিপর এক বৃদ্ধ কেন তার বন্ধু সুজুকির স্মৃতিচারণ করবে? তাকে কেন পাশে বসিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিবে না? কারণ অনেক আগেই সুজুকি তার বন্ধু ওনোদাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সুজুকির কথা একটু বলিই তাহলে। ওনোদার সাথে সাথে সুজুকিও বিখ্যাত হয়ে যান। কিন্তু এই খ্যাতি সুজুকিকে তার শেষোক্ত অভিপ্রায় থেকে নিবৃত করে রাখতে পারেনি। তাই ইয়েতির সন্ধানে তিনি আবার বেরিয়ে পড়েন। আর সেই ইয়েতি সন্ধানের মিশনেই মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে প্রাণ হারান নোরিও সুজুকি। স্থান- হিমালয় পর্বতমালা।
সবশেষেঃ লেফটেন্যান্ট হিরু ওনোদার মতো কাহিনি আরো দুজনের আছে। একজন প্রাইভেট তেরুও নাকামুরা আর অন্যজন সার্জেন্ট শইচি ইয়োকোই। তারা প্রত্যেকেই ইমপেরিয়াল জাপানিস আর্মির সদস্য ছিলেন। তাদের কথাও বলবো। তবে আজ না, অন্যদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:১৬