somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ মনতলার যুদ্ধ (১৫- ২১ জুন ’৭১)

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন একেকটা অসামান্য বীরত্বের অমরগাথা। তেলিয়াপাড়া পাকিস্তানিদের দখলে চলে যাওয়ার পর মনতলা রেলস্টেশনটি মুক্তিবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে যুদ্ধ পরিচালনার সর্বশেষ অবস্থানটি ছিল মনতলা। মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট মহাসড়কের পূর্বপার্শ্বের ভারতীয় সীমান্তের কাছে উঁচু টিলার ওপর অবস্থিত ছোট স্থানটি মনতলা কমপ্লেক্স নামে খ্যাত ছিল। কমপ্লেক্সটির উত্তরে মনতলা স্টেশন আর দক্ষিণে হরষপুর স্টেশন। মনতলার দক্ষিণে মোহাব্বতপুর, উত্তরে তেলিয়াপাড়া, পশ্চিমে মাধবপুর এবং পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা। হরষপুর-মনতলা-শাহজীবাজার রেললাইন মনতলার সাথে যুক্ত ছিল। এছাড়াও উত্তরে ইটাখোলা, মাধবপুর, শাহবাজপুরের সর্পিল রাস্তা এবং মোহাব্বতপুর-মনতলা-তেলিয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকার সঙ্গে কিছু ছোট-বড় কাঁচা রাস্তা মনতলার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ইতোমধ্যে তেলিয়াপাড়া পাকিস্তানিদের হাতে এসে যাওয়ায় এবারে তারা মুক্তিবাহিনীর সর্বশেষ অবস্থান মনতলা কব্জা করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। রণাঙ্গনের সেই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যেকোনো মূল্যে, প্রয়োজনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হলেও এই এলাকা শত্রুমুক্ত রাখবে। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে সিলেট যাওয়ার পথে মনতলাই ছিল একমাত্র বাধা। ফলে উত্তাল ’৭১ তার ইতিহাসের পাতায় এক স্মরণীয় যুদ্ধের রচনার জন্য প্রস্তুত হয়। মনতলা ছিল সেক্টর তিনের অন্যতম একটি সাব-সেক্টর।


মনতলার যুদ্ধ (১৫- ২১ জুন ’৭১)

দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া হয়ে একটি রেলপথ হরষপুর, মনতলা, তেলিয়াপাড়া, শাহজীবাজার হয়ে মৌলভীবাজার ও সিলেট পর্যন্ত চলে গেছে। মনতলা স্টেশনের অবস্থান ছিল এই রেলপথের মধ্যবর্তী স্থানে, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল মুক্তিবাহিনীর হাতে। ফলে পাকিস্তানি সামরিক শক্তি মনতলার মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সকে ভেঙ্গে দিয়ে মনতলা করায়ত্ত করে তাদের ঢাকা-সিলেট রেল সংযোগকে নির্বিঘ্ন রাখতে ছিল বদ্ধপরিকর। তিন সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানিরা মনতলা আয়ত্তে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এজন্য তাদের যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছিলো; প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিলো। কনভেনশনাল বা প্রচলিত যুদ্ধ কৌশলের মাধ্যমে মনতলা দখলের কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে পাকিস্তানিরা তাদের আক্রমণ কৌশলে পরিবর্তন ঘটায়। আর সেই নতুন কৌশলে ১৫ জুন তারা মনতলায় আক্রমণ চালায়।

তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দু’টি কোম্পানি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে মনতলার ডিফেন্সে মাত্র তিনটি কোম্পানি ছিল। সেক্টর তিনের সেই সময়কার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ। তিনি কোম্পানি তিনটিকে আখাউড়া-সিলেট রেলপথের দু’পাশে ডিপ্লয় করেন। মনতলা স্টেশন এলাকা রক্ষার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির উপর। তার দক্ষিণে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার কোম্পানিকে কাশিমপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খানকে তৃতীয় কোম্পানির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি তাঁর কোম্পানি নিয়ে আরো দক্ষিণে হরষপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ তিনটি কোম্পানির কৌশলগত অবস্থানের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে কাবু করার জন্য তিন সপ্তাহব্যাপী বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ করে যায়। কিন্তু মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় যাঁদের চোয়াল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাঁদের পর্যুদস্ত করা করা কি এতই সহজ!

যেভাবে ২৫ মার্চের কালরাতে নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মনতলা এলাকায় তারা ঠিক তেমনি এক কৌশল অবলম্বন করে। ১৫ জুন থেকে রাতের অন্ধকারে আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করে মনতলার আশেপাশের গ্রামের লোকদেরকে তারা ভিটেমাটি ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য করেছিলো। পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেঞ্চ ও পরিখা খননের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের কাছে অগ্রসর হয়ে প্রায়ই অতর্কিত হামলা চালাচ্ছিলো। তাদের একটি ব্যাটালিয়ন উত্তরদিকে ইটাখোলা এলাকা থেকে আক্রমণ চালায়। পশ্চিমে আজবপুর থেকে আরেকটি ব্যাটালিয়ন মনতলা রেলস্টেশনের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। পাকিস্তানিরা দিনের বেলায় পরিখাগুলো থেকে হালকা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা আক্রমণ শানিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখতো। আর রাতের বেলায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ভারি মেশিনগান, মর্টারের গোলাবর্ষণ করতো। তারা অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পরিখা খননের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের নিকটতর হতে থাকে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তখন বেশি কিছু করার ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের হালকা অস্ত্রশস্ত্রের রেঞ্জের বাইরে থাকায় পাকিস্তানিরা তাদের ট্রেঞ্চগুলোতে নিরাপদে অবস্থান করতে থাকে। পাকিস্তানিদের আর্টিলারি গানও মুক্তিবাহিনীর মর্টারের রেঞ্জের বাইরে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্য মাঝে মধ্যে মর্টারের সাপোর্ট নিয়ে অগ্রসর হয়ে প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করেছিল, কিন্তু তা থেকে বিশেষ কোন সুফল তাঁরা আদায় করতে পারেনি। পাকিস্তানিদের গোলাবর্ষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছিল। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে গোলাবারুদ ছিল খুবই কম। অল্প কয়েকটি মর্টার আর সীমিত গোলাবারুদ দিয়ে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করা মুক্তিবাহিনীর পক্ষে খুব কঠিন ছিল। এইভাবে যুদ্ধ চলে একটানা ৫ দিন।

২০ জুন পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী বাহিনী (Vanguard Force) মুক্তিবাহিনীর একেবারে সম্মুখ অবস্থানে চলে আসে। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানিদের বাদবাকি অংশও সকল ফ্রন্টে এগিয়ে আসে। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক অবস্থান জানার জন্য আকাশপথে রেকির ব্যবস্থা করে। তারা হেলিকপ্টারযোগে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন নাসিম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কোম্পানি বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো। কিন্তু ৫ দিনের বিরতিহীন আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনীর এই কোম্পানিটি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিলো। ক্যাপ্টেন নাসিম রি-ইনফোর্সমেন্টের জন্য সাহায্য চেয়ে পাঠান। ফলে মতিনের কোম্পানি থেকে ২০ জুন নাসিমের সাহায্যার্থে এক প্লাটুন সৈন্য পাঠানো হয়। এবারে নাসিম পাকিস্তানিদের মোকাবেলায় অধিকতর দৃঢ়টা অবলম্বন করেন। কিন্তু বিধিবাম! ২১ জুন ৪ ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সৈন্য আকস্মিকভাবে নাসিমের কোম্পানির উপর আক্রমণ চালায়। গোলন্দাজ বাহিনীসহ পাকিস্তানিরা মনতলা কমপ্লেক্সের ওপর তিনদিক থেকে আক্রমণ করে। হেলিকপ্টার অবজারভেশন পোস্টের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানিদের কামানগুলো নির্ভুলভাবে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে যাচ্ছিলো। এই বিপুল সৈন্যের আক্রমণের মুখে নাসিম ও তাঁর কোম্পানির অবস্থান ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মেজর সফিউল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ক্যাপ্টেন নাসিম তাঁর কোম্পানি নিয়ে মনতলার অবস্থান ছেড়ে চলে যান এবং কয়েক মাইল পেছনে সরে গিয়ে ভারতের পঞ্চবটীতে তাঁর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন।

এদিকে পশ্চিমে চান্দুরার দিক থেকে এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সৈন্য ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এই কোম্পানির কাছে এসময় মাত্র ১টি ভারি মেশিনগান, ৯টি হালকা মেশিনগান আর অল্প কিছু রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তাঁর সৈন্য সংখ্যাও বেশি ছিল না, মাত্র ৮০ জন। কিন্তু এই সৈন্যরা যে দেশাত্মবোধে সদাজাগ্রত, জন্মভূমির জন্য জীবন দিতে চির অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলার এই দামাল সন্তানেরা তাই নির্দ্বিধায় পাকিস্তানিদের প্রায় ২০০ সৈন্যের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর ফরোয়ার্ড ডিফেন্সের ওপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়। অপরদিকে ডান দিক থেকে কামানের গোলাবর্ষণ ক্যাপ্টেন সুবিদ আলীর কোম্পানিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। আর সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছিলো কারো সঙ্গে তখন কারো যোগাযোগ ছিল না। বিশেষ করে ইখতিয়ারপুর, ঘিলাতলি, কাশিমনগরে প্রেরিত বিভিন্ন ডিফেন্সের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে মুক্তিযোদ্ধারা হেডকোয়ার্টারে কোনো খবর পৌঁছাতে পারছিলো না। শেষ পর্যন্ত রাত ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে সহযোদ্ধাদের সকলকে জানিয়ে দেন। পরবর্তী অবস্থান এবং প্রতিরক্ষাব্যূহ রচিত হবে চৌমুহনীতে। এই সময় অনেক বেসামরিক লোক মুক্তিবাহিনীকে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরে সহযোগিতা করেছিলো।

অপরদিকে মুকুন্দপুর অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানিদের আরেকটি ব্যাটালিয়ন লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খানের কোম্পানির উপর মারাত্মকভাবে আক্রমণ করে। এমনকি চান্দুরার দিক থেকে পাকিস্তানিদের যে ব্যাটালিয়ন সুবিদের কোম্পানির উপর আক্রমণ করে তাঁদের পিছু হটিয়ে দেয়, তারা এবার হরষপুরে অবস্থানরত এই মোর্শেদ কোম্পানির উপর হামলা চালায়। এই চরম অবস্থায় পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে হেলাল মোর্শেদের অবস্থানের পেছনে ছত্রীসেনাও (Paratroopers) নামাতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়ে। লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদের কোম্পানি চারদিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় থেকেও বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মুক্তিবাহিনীর এই কোম্পানিটি পাকিস্তানিদের ঘেরাওয়ে পড়ে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়। এ সময় মোর্শেদের কোম্পানিটিকে পাকিস্তানি বাহিনীর মরণথাবা থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে মেজর সফিউল্লাহ ক্যাপ্টেন মতিনের দু’টি প্লাটুন নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ক্যাপ্টেন সুবিদের দলটিকে সংগঠিত করে করে মতিনের দু’টি প্লাটুনসহ কলকলিয়ার দিক থেকে মেজর সফিউল্লাহ পাক বাহিনীর উপর পাল্টা হামলা চালান। আক্রমণের তীব্রতা এতো ক্ষুরধার ছিল যে পাকিস্তানি সৈন্যরা বেশ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। মেজর সফিউল্লাহ পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে হরষপুরের একাংশ থেকে পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হন। এই সাহসী আক্রমণের ফলে মোর্শেদের কোম্পানিকেই যে শুধু সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তা নয়, বরং বেশ কিছু এলাকাও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্দখলে চলে আসে। হরষপুর-মুকুন্দপুরের এই এলাকাটি ছিল প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটারের মত। যদিও এলাকাটি কৌশলগত দিক দিয়ে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই পুনর্দখল ছিল নির্দ্বিধায় গৌরবজনক। এই ছোট্ট ভূ-খণ্ডটি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর হাতেই থেকে যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই পাল্টা আক্রমণটি ছিল সত্যিকারের সাহসিকতার এক অনুপম নিদর্শন। তাঁদের সাহস, শক্তি, কৌশল আর দেশপ্রেমের জোরেই পাল্টা আক্রমণটি সাফল্য অর্জন করেছিল। বাংলার এই দামাল সন্তানদের কাছে মাতৃভূমি যে নিজের জীবন থেকেও দামি। এই যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট মোর্শেদের একটি লাইট মেশিনগান পোস্টের দায়িত্বে ছিলেন সৈনিক দৌলা মিয়া। এই সফল অপারেশনের নেপথ্যে দৌলা মিয়ার কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শত্রুসৈন্য কর্তৃক অবরুদ্ধ এবং মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পরেও এই বীর সেনানী হাল ছেড়ে দেননি। মেশিনগানের ট্রিগার থেকে হাত সরিয়ে নেননি। মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণভাগ থেকে দৌলা মিয়ার মেশিনগানের ফায়ার সাপোর্ট ছিল অত্যন্ত কার্যকরী। এ প্রসঙ্গে মেজর সফিউল্লাহর ভাষায়-
“২১ জুন দুপুর ১২টায় আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানিদের হটিয়ে মোর্শেদের অবস্থানে পৌঁছি। দৌলা মিয়ার মেশিনগান পোস্টের কাছে পোঁছে আমি হতবাক হয়ে যাই। দৌলা মিয়ার সমস্ত শরীর রক্তাত্ত। মরণপণ অবস্থায় সে ডান হাতে মেশিনগান আর বাম হাতে পেটের ক্ষতস্থান চেপে ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। পাকিস্তানিদের মেশিনগানের গুলি তাঁর পায়ে ও পেটে লাগে এবং পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসে। আহত হয়েও সে মেশিনগান পোস্ট ছেড়ে যায়নি। মৃত্যুকে বাজি রেখে সে ডান হাতে মেশিনগান দিয়ে ক্রমাগতভাবে শত্রুপক্ষের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কোনো অবস্থাতেই শত্রুপক্ষের হাতে নিজের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে আসেনি। দৌলা মিয়া পরে বেঁচে গিয়েছিল।” (দৌলা মিয়ার উপর আরেকটু বিস্তারিত আরেকটা পোস্টে দেওয়ার চেষ্টা করবো।)

২১ জুন মনতলা পতনের পর মুক্তিবাহিনী ভারতের মনতলা চা বাগানে ঘাঁটি স্থাপন করে। জুন মাসের শেষের দিকে মাধবপুর থানার বিভিন্ন এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে যায়। ২১ জুনের পর থেকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে এসব এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় মুক্তিবাহিনী। চোখে পানি এসে যাওয়া আর গর্বে বুক ভরে ওঠার মতো এমন হাজার হাজার ঘটনা নিয়ে গঠিত হয় আমাদের সংগ্রামমুখর উত্তাল একাত্তরের সেই রণাঙ্গনের দিনগুলি।


সেক্টর তিনের সেক্টর কমান্ডার মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ (এপ্রিল-৩০ সেপ্টেম্বর ’৭১)


পঞ্চবটী সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম


মনতলা/বিজয়নগর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম সুবিদ আলী ভূঁইয়া


কলকলিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খান


সিমনা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন

সূত্রঃ
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস – সেক্টর তিন
২. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হবিগঞ্জ


রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ তেলিয়াপাড়ায় গেরিলা আক্রমণ
রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ অপারেশন জাতিসংঘ গ্যারেজ
রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক অপারেশন
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:২১
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×