ঐতিহ্যবাহী পুরাতন ঢাকার এক অতি পুরাতন মিষ্টির দোকান। মূলত এরা দই তৈরির জন্য বিখ্যাত। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এরা দই তৈরি করেন। বর্তমানকালের পাঁচমিশালি চাহিদার ভিড়ে এখন অনেক কিছুই বানান তারা। কিন্তু তাদের বানানো দই এখন আর সেই দই না থাকলেও স্বাদটা যে কিছুটা হলেও আছে- এটা প্রমাণ করতেই এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে পুরান ঢাকায় আসা। সরু গলি, চিপা রাস্তা, লম্বা শশার মতো ফালি ফালি করে গা ঘেঁষানো সব পুরাতন বাড়ি– খোলা চোখে আমার কাছে এরকমই মনে হয়েছে পুরান ঢাকাকে। আমার বন্ধু পুরান ঢাকার বাসিন্দা। নাম কমল। ভার্সিটিতে আমার সাথেই পড়ে। ওদের এলাকা সম্পর্কে আমার উপর্যুক্ত মতামত জেনে ও কিছুটা ব্যাথিত হল। কিন্তু বন্ধু বলে প্রকাশ করলো না। আমরা নতুন ঢাকার কাঠখোট্টা মানুষ। ওদের মতো সাগর সমান হৃদয় আমাদের কোথায়! তাইতো ওদের উদার মনের অন্তস্তল না দেখে সংকীর্ণ অবকাঠামোর বাহ্যিক দিকটাই দেখলাম। অমৃতসম দই খেয়ে রওয়ানা হলাম ওর দাদাবাড়ির দিকে।
শাঁখারী বাজার। বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের শাঁখা তৈরির স্থান। জায়গাটা হিন্দু প্রধান হলেও হিন্দু-মুসলিমের একসাথে বসবাস। আর তাই আমার বন্ধুর দাদাবাড়ি সেইখানের তথাকথিত সংখ্যালঘু না হয়ে সম্মানিত এক পরিবার। কমলের দাদা বেশ রসিক আর কথাপ্রিয় মানুষ। উনি যে ঘরে থাকেন তা হাজার হাজার বইয়ে ঠাঁসা। অশীতিপর একজন বৃদ্ধ যার চোখে ছানি পড়ার পরও আজও বইপ্রেমিক ভাবতেই অবাক লাগে। টেবিলের উপর একটা ছোট চটি বই পড়ে থাকতে দেখলাম। ভাবলাম গ্রাম্য ধাঁধার বই হয়তো। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম তা না। একটা পঞ্জিকা। নাম – লোকনাথ পঞ্জিকা। বছরের কোন সময় সূর্য-চন্দ্রে গ্রহণ লাগবে, কোন সময় অমাবস্যা-পূর্ণিমা হবে, কোন গ্রহের অবস্থান কোথায় হবে – সবই আছে এই ছোট্ট বইতে। বইটা হাতে নিয়ে যখন নাড়াচাড়া করছিলাম তখন কমলের দাদা ঘরে ঢুকলেন। ওনার সাথে অনেক কথা বললাম। উনি অনেক কিছু জানেন। আমাকে এই এলাকার ইতিহাস বললেন। এটা অনেক আগে থেকেই হিন্দুপ্রধান এলাকা। এ কথা সে কথার পরে একসময় দাদা আমাকে এই এলাকার একটা ঘটনা শোনালেন। কাউকে শোনানো তো দূরের কথা ঘটনাটা আমি নিজে নিজে চিন্তা করলেও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সাহস করে আজ লিখছি।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে পুরান ঢাকায় এক তান্ত্রিক বাস করতো। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিন পরেই সে এই এলাকায় আসে। কোথা থেকে তার আগমন, কোথায় তার আদি নিবাস সর্বোপরি কি তার পরিচয় কিছুই তখন এখানকার মানুষ জানতো না। কেউ জানার চেষ্টাও করেনি। উপরন্তু বিভিন্ন ধরণের লোক আসতো নানাবিধ সমস্যা নিয়ে। আর সে তাদের সেসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতো গুরুলব্ধ কালো-জাদুর মাধ্যমে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাকি লোকেরা উপকৃত হতো। তবে বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য থাকতো খারাপ। মানুষের বিবেক এক আজব আদালত। এখানে মানুষ মারাটাকে এক পক্ষ সভ্যতার প্রগতির মাপকাঠি মানে, আবার কারো কাছে কোনোরকমে বেঁচে থাকাটাই সব। কেউ মনে করে জাদু-টোনা, মন্ত্র পড়ে, বাণ মেরে উদ্দেশ্যসিদ্ধি ঠিক, আবার কেউ কেউ শক্তির জোরে, প্রভাব খাঁটিয়ে কার্যসিদ্ধিকে জায়েজ মানে। তান্ত্রিকও সেরকম কালো জাদুর ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতো। কাউকে বশ করানোর মন্ত্র পড়া তার কাছে হালাল কিন্তু কাউকে মন্ত্র দিয়ে মেরে ফেলা তার কাছে মহাপাপ। তেমনি পাড়ার মাস্তান যার কিনা চরিত্রের ঠিক নেই সে এলাকার কোন মেয়েকে পাওয়ার জন্য তার কাছে আসলে তান্ত্রিক মৌন আনন্দে কাজটা করে দিতো কিন্তু অন্যের স্ত্রীকে ভাগানো বা বাগানোর মন্ত্র – খুউউবই মন্দ। আমার কাছে ব্যাপারটা ভূতের মুখে রাম নাম জাতীয় মনে হয়েছে।
আসামে কামরু আর কামাখ্যা নামে দুইটা জায়গা আছে যেখানে কালো-জাদুর ব্যাপকবিস্তৃত চর্চা হয়। হাজার হাজার মানুষ সেখানে যায় কালো জাদু শিক্ষা করার জন্য। মানুষের নিষিদ্ধ আর রহস্যময় জিনিসের প্রতি আগ্রহ অতি আদিম। এর টান দমন করা মানুষের পক্ষে অতি কঠিন। কেউ পারে কিন্তু অনেকেই পারে না। ভাবের কথা বাদ দিয়ে আসল জায়গায় আসি। ভারতের যে অঞ্চল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সাথে যুক্ত সেটাই মূলত আসাম। আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক উপজাতি টাইপ মানুষ আছে যারা যুগ যুগ ধরে প্রেত সাধনা, অশরীরী পূজা, নরবলির রক্তপান, কাঁচা কলিজা চর্বণ ইত্যাদি নানা ধরণের অদ্ভুত ভয়ঙ্কর কাজ-কারবার করে আসছে। ভারত সরকারও এদের বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পায় না। পাছে যদি আবার কোন ক্ষতি হয়ে যায়। আসামের সব অঞ্চলে আবার এগুলোর চর্চা হয় না। আবার এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখানে বাইরের জগতের কারো প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পুরান ঢাকার এই তান্ত্রিক সেই নিষিদ্ধ রহস্যময় জগতের ছাত্র। কমলের দাদাসহ গুটিকয়েক মানুষ এই বিষয়টা জানতেন। এখন এই ঘটনা স্থানীয় প্রায় সবারই জানা। তাদের বেশিরভাগই আবার কমলের দাদার ন্যায় মুরুব্বী গোত্রের যারা চায়ের দোকানে কিংবা মসজিদে বসে বসে নিজেদের ভেতর গল্প-গুজব করেন। আধুনিক কালের ছেলেদের সময় কোথায় তাদের সাথে গল্প করার! তারা তো আছে ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোন নিয়ে। কমলের দাদা হয়তো আমাকে ওনার যুগের কেউ মনে করেছিলেন।
দশ বছরের একটা ছোট্ট সুন্দর মেয়েকে নিয়ে যখন গণেশ রায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আসে তখন চারিদিকে কেবল হাহাকার আর স্বজন হারানোর করুণ মাতম। গণহত্যার ধকলটা সিংহভাগ যায় পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। ফলে ’৭১ এর পরে পুরান ঢাকায় অনেক জমি, অনেক বাড়ি খালি পড়ে থাকে। তারই এক বাড়িতে চল্লিশোর্ধ তান্ত্রিক গণেশ রায় তার মেয়েকে নিয়ে ওঠে। তিনতলা বাড়ির (আসলে আড়াই তলা) মাঝের তলায় তান্ত্রিক থাকতো। উপরতলা বলতে কেবল একটা রুম ছিল যেখানে তান্ত্রিক তার অফিস চালাতো। আর নিচ তলায় থাকতো এক বুড়ি যার সবাই ’৭১ এ শেষ। এই বুড়িকে তান্ত্রিক পিসিমা ডাকতো। আর তান্ত্রিককে এলাকায় সবাই গণেশ সাধু বলতো। দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো এই গণেশ সাধুর সুনাম(!)।
অর্থ-সম্পদের প্রতি সে নাকি একরকম নির্মোহ ছিল। কার্যসমাধার্থে যে খরচাপাতি হয় তা বাদ দিয়ে যে যা দিতো তাতেই সে খুশি থাকতো। কিন্তু একবার তার মেয়ের মারাত্মক অসুখ হয়। তান্ত্রিক তার এই মেয়ের ব্যাপারে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা ছিল। মেয়ের ক্ষতি হবে এমন কোন কাজ সে কখনোই করতো না। কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াতে গেলে বা শ্মশানঘাটে দাহকৃত্য করতে হলেও মেয়েকে সাথে নিয়ে যেতো। এক কথায় মেয়েকে কাছছাড়া করতো না। বলতে গেলে এই মেয়েই ছিল তান্ত্রিকের অন্ধের যষ্টি। কি অসুখ তা ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, বৈদ্য কেউই ধরতে পারলেন না। তান্ত্রিক প্রায় পাগলের মতো হয়ে পড়েছিলো। শেষতক নাকি কমলের দাদার কাছে ঐ বাড়ির পিসিমা তান্ত্রিকের মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলো। কমলের দাদা আবার টুকটাক চিকিৎসাবিদ্যা জানতেন। তিনিও প্রথম কিছু ধরতে পারেন নি। কিন্তু পরে একদিন রোগটা ধরতে পারলেন। এই ব্যাপারটা কমলের দাদা ব্যাখ্যা করলেন না অর্থাৎ তিনি কিভাবে এটা ধরতে পেরেছিলেন যা কিনা অন্যরা পারলো না। হালকা একটা হাসি দিয়ে আর যা বললেন তা হল- ঘটনাটা ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ের।
পরে অবশ্য এক ডাক্তার রোগটা ধরতে পারেন। তার কাছে যাওয়ার বুদ্ধি কমলের দাদাই দেন। ডাক্তার বললেন, মেয়ে সুস্থ হবে কিন্তু অনেক টাকা লাগবে। তার উপর মেয়েকে হাসপাতালেও অনেকদিন রাখতে হবে। বাসায় নেওয়া যাবে না। ডাক্তার এছাড়া আর যা যা বললেন তান্ত্রিক তার সবই মেনে নিলো। তান্ত্রিক প্রায় সারাদিনই হাসপাতালে মেয়ের ওয়ার্ডের পাশে বসে থাকতো। কিন্তু মহিলাদের ওয়ার্ডের বাইরে সারাদিন বসে থাকাটাও অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগতো। সপ্তাহখানেক পরে আরেকটা নতুন চিন্তা (আসলে দুশ্চিন্তা) যুক্ত হল তান্ত্রিকের ভাঁজপড়া কপালে। অর্থ। এতো টাকা সে পাবে কোথায়? ’৮০ র দশকে আশি হাজার টাকাও অনেক। সেখানে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার কারবার তো মাথা খারাপ হবার মতোই। কি বাড়ি কি হাসপাতাল সর্বত্র সে অর্থ সংকুলানের চিন্তায় চিন্তিত থাকতো। কোন কি উপায় নেই!
এমন সময় তার কাছে যুবক বয়সী একটা ছেলে আসলো। তান্ত্রিকের কাছে তার চাহিদা ও বিনিময় পরোক্ষ উক্তিতে কিঞ্চিৎ ভাববাচ্যে সংক্ষেপে এরকমঃ ছেলেটি গরীব ঘরের ব্রাহ্মণ সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছে। সে একজনকে ভালোবাসে। অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তাকে বিয়ে করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় অন্য আরেকটা মেয়ে। এই মেয়ে বেঁচে থাকলে নাকি তার (ছেলেটির) সাথে অন্য কারো বিয়ে হবে না। ফলে পথের কাঁটা মেয়েটিকে যেকোনো উপায়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। সে জন্যই তান্ত্রিকের কাছে তার আসা। বিনিময়ে সে তান্ত্রিককে এক লক্ষ টাকা দেবে। অভাবে স্বভাব নষ্ট। পরিস্থিতির পাল্লায় পড়ে তান্ত্রিক রাজি হতে বাধ্য হল। তান্ত্রিক অবশ্য ছেলেটিকে এই প্রশ্ন করেছিলো যে, গরীব ব্রাহ্মণের সন্তান হলে এতো টাকা সে পাচ্ছে কোথায়? উত্তরে সে বললো, যে মেয়েকে সে ভালোবাসে, বিয়ে করবে – সেই নাকি তাকে এই টাকাটা দিচ্ছে। আর তার (অর্থাৎ মেয়েটির) চাপাচাপিতেই সে এটা করতে চাচ্ছে।
তান্ত্রিক ঠিক করলো মেয়েটিকে তিনদিনের ভেতর কার্যকর হয় এমন মন্ত্রে বাণ মারবে। একে মারণ বাণ বলে। সেজন্য সে ছেলেটিকে বললো, “তুমি ঐ মেয়েটিকে (যার উপর মারণ মন্ত্র নিক্ষিপ্ত হবে) একটা লাল রঙের শাড়ি কিনে দেবে। নিশ্চিত করবে টানা তিনদিন যেন সে ঐ শাড়ি পরে থাকে। তোমাকে সে যখন ভালোবাসে সানন্দেই সে তোমার উপহার গ্রহণ করবে আর নিঃসঙ্কোচে সে তোমার আর্জিতে রাজি হবে। ব্যস, তোমার কাজ শুধু এটুকুই। তান্ত্রিক ভেবেছিলো টানা তিনদিনের কথাতে ছেলেটা নিমরাজি হবে। কিন্তু সে মহোৎসাহে রাজি হয়ে গেলো। শেষতক মেয়েটির একটা ছবি (তান্ত্রিকের কথামতো) আর অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দিয়ে খুশিমনে ছেলেটি চলে গেলো। আর গণেশ সাধু বসে গেলো রহস্যময় অন্ধকার জগতের এক ভয়ঙ্কর খেলায়।
সেদিন রাতে সাধু একটা স্বপ্ন দেখলো। দেখলো যে, সে একটা অন্ধকার রাস্তা ধরে কোথায় যেন হেঁটে যাচ্ছে। চারিদিক নীরব, শুনশান। মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরের ভরাট গর্জন গভীর রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিচ্ছিলো। হাঁটতে হাঁটতে সে এক সময় একটা প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দোতলা বাংলো বাড়ি। পাশ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে একটা লেক চলে গেছে। সাধু গেট দিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। কালো ধোঁয়ার মতো একটা অবয়ব নিয়ে সে প্রকাণ্ড বাড়ির একটার পর একটা কামরা পার হচ্ছিলো। একটাতেও কেউ নেই। হঠাৎ একটা কামরার সামনে এসে সে থমকে দাঁড়ালো। দরজা ভেদ করে ভিতরে ঢুকে দেখলো কামরার মাঝখানে পাতা একটা বিশাল খাটে পাশাপাশি দুইজন ছেলেমেয়ে শুয়ে আছে। দুজনই অল্পবয়সী। কাছে গিয়ে দেখলো, ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে। আর এ যে সেই ছেলে যে কিনা আজ তার কাছে এসেছিলো! সাধু ঘুরে গিয়ে এবার মেয়েটার কাছে গেলো। মেয়েটাকে দেখে সে তাজ্জব বনে গেলো। আরে এ তো সেই মেয়ে যার উপর সে আজ মারণ বাণ ছুঁড়েছে! পরনে লাল শাড়ি। কিন্তু এ মেয়ে এখানে কেন! ছেলেটা বেশ আরাম করে ঘুমালেও মেয়েটা বিছানায় ছটফট করছিলো। মেয়েটির সাথে তার চোখাচোখি হল। কিন্তু যেই না সে মেয়েটার কাছে যেতে গেলো অমনি সে (মানে মেয়েটি) পেট চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে তান্ত্রিকের ঘুম ভেঙে গেলো। বিছানায় উঠে বসলো। সারা শরীর ঘামে ভিজে একেবারে একাকার অবস্থা। পুরো ব্যাপারটিকে সে দুঃস্বপ্নের তালিকায় ফেলে দিলো। এই যুক্তিতে মনকে প্রবোধ দিলো – মারণ বাণ কালো জাদু চর্চার সবচেয়ে অন্ধকার অংশ। একটি আত্মার অকালহরণ জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ; যা সে করেছে। এমতাবস্থায় এরকম স্বপ্নদর্শন বাঞ্ছনীয়।
পরেরদিন রাতে গণেশ সাধু একই স্বপ্ন দেখলো। সেই অন্ধকার কালো রাত, নির্জন পথ, ক্ষণে ক্ষণে কুকুরের করাল গর্জন, সেই বিশাল প্রাসাদতুল্য বাড়ি, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত লেক আর বাকি সব যা সে গতকাল স্বপ্নে দেখেছিলো। ব্যতিক্রম কেবল দুইটা জিনিসে। এক, এবার সে কালো ধোঁয়ার কোন অবয়ব না বরং সাদা ছায়ামূর্তি আর দুই, মেয়েটির সাথে কথা বলতে পারা। মেয়েটি তাকে জানালো, সে মা হতে চলেছে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটি তার স্বামী। ভালোবেসেই তাদের বিয়ে হয়েছিলো। যদিও এক্ষেত্রে মা-বাবার প্রথমদিকে প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু ইদানীং সে (অর্থাৎ মেয়েটির স্বামী) আর তাকে সেই আগের মতো ভালোবাসে না। কারণে অকারণে বাজে ব্যবহার করে। গায়ে পর্যন্ত হাত তুলে। তবে গতকাল সে তার জন্য একটা লাল রঙের শাড়ি কিনে এনেছে। সেই আগের মতো আদর করে শাড়িটা পরে আসতে বলেছে আর সাথে একটা পাগলামি শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, টানা তিনদিন নাকি এই শাড়িটাই পরে থাকতে হবে। মেয়েটা তাকে আরও অনেক কিছু বললো। সব শুনে শেষতক গণেশ সাধু মেয়েটিকে তার বাড়ির ঠিকানা দিলো। এর পরপরই আবার তার ঘুম ভেঙে গেলো। ভিজে চুপচুপ হয়ে যাওয়া বিছানা ছেড়ে উঠে ভাবতে লাগলো – ব্যাপারটা কি! পরপর দুই রাত একই স্বপ্ন সে কেন দেখলো! নিশ্চয়ই কোথাও কোন ঘাপলা আছে। কিন্তু সেটা কোথায়? বারবারই মনে হচ্ছিলো যেন দূর অতীতের চাপা দিয়ে রাখা কোন সুপ্ত রহস্য জেগে উঠতে চাচ্ছে।
পরদিন গনেশ সাধু কারো সাথে দেখা করলো না। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সপ্তাহের ঠিক মাঝের দিনটিতে সে নিজের মতো থাকে। একান্ত নিজের কিছু কাজ সে করে। মেয়েকেও তখন কাছে রাখে না। তার অতীত জীবনের কিছু স্মৃতিময় ঘটনা এই মঙ্গলবারেই ঘটেছিলো। দুপুরের দিকে একটা মেয়ে তার কাছে আসে। নিচতলার পিসিমার হাজার বারণ সত্ত্বেও সে উপরে তিনতলায় উঠে আসলো। দুপুর বেলায় অহেতুক দরজায় বাড়ি শুনে তান্ত্রিক প্রচণ্ড বিরক্ত হল। পিসিমাকে সে কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছিলো যেন এই দিনে কেউ তাকে বিরক্ত না করে তা সে যতো ক্ষমতাবানই হোক না কেন। কিন্তু দরজায় বাড়ির ধরণ দেখে সে প্রথমে বিরক্ত হলেও হাসপাতালে মেয়ের কথা চিন্তা করে ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলে মেয়েটিকে দেখেই তান্ত্রিক ভয়াবহভাবে চমকে উঠলো। আরে এ তো সেই স্বপ্নে দেখা মেয়ে যাকে বাস্তবে মেরে ফেলার জন্য সে পণবদ্ধ। ঘোর লাগা চোখে সে মেয়েটিকে ভিতরে আসতে বললো। লাল শাড়ি পরা মেয়েটির মুখখানা ছিল মায়ায় ভরা। মেয়েটি তান্ত্রিকের কাছে যা বললো তা সংক্ষেপে এরকমঃ
আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক সহপাঠীর সাথে আমার সম্পর্ক হয়। পরবর্তীতে মা-বাবার অমতে তাকেই বিয়ে করি। মা-বাবার আপত্তির জায়গাটা ছিল সামাজিক অবস্থানের আপেক্ষিকতায়। আমি অনেক ধনী ঘরের মেয়ে হলেও সে (ছেলেটি) ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। কিন্তু আমার জেদের কাছে মা-বাবা একসময় নতি স্বীকার করেন। ওকে মেনে নেন। হিন্দু রীতি অনুযায়ী মেয়েরা বিয়ের সময়ই সম্পত্তি যা পাবার পেয়ে যায়। যেহেতু একমাত্র মেয়ে সেহেতু মা-বাবার প্রায় সব সম্পত্তিই আমি পাই। ওকে নিয়ে ধানমণ্ডিতে আমার নামে থাকা বাড়িটায় গিয়ে উঠি। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম ও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু আস্তে আস্তে তা অনেক কমে যায়। এক পর্যায়ে শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছায়। গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করতো না। সব সময় রাত করে বাড়ি ফিরতো। কারণ জিজ্ঞাসা করলে অকথ্য গালাগাল, ক্ষেত্রবিশেষে......সেটা না হয় নাই বললাম। বাড়িতে কোন চাকর-বাকর স্থায়ীভাবে থাকবে এটা ওর পছন্দসই ছিল না। দু’এক দিন পরপরই ওদের ঝেটিয়ে বিদেয় করতো। ওর এই আচরণে কষ্ট হতো আমার। প্রায়ই আমাকে সারা বাড়িতে একা থাকতে হতো। ও আমার বাবার বিসনেস দেখতো। আমাকে বিয়ে করার কারণে এক লাফে কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে গিয়েছিলো। ওর যে ডিরেক্টর হবার যোগ্যতা নেই তা না কিন্তু এক লাফে হবে তাও তো না। একদিন অফিসের এক ক্লার্ক আমাকে ফোন করে জানালো, ও নাকি কুমিল্লায় আমাদের যে রিজিওনাল অফিস আছে সেখানকার কোন এক মেয়ের সাথে সখ্যতা গড়েছে। এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কিছুদিন আগে সেই মেয়েকে নাকি ও প্রমোশন দিয়ে ঢাকার হেড অফিসে (যেখানে ও বসে সেখানে) নিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে ওর কাছে জানতে চেয়ে কোন সদুত্তর পাই না। যা পাই তা না হয় নাই বললাম। এরই মধ্যে আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ি। ভাবলাম আবার হয়তো ওর মন পাবার জন্য স্রষ্টাই এই ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এই কথা শোনার পর ও খুশি হওয়া তো দূরের কথা ভীষণ রেগে গেলো। আমাকে Abortion –এর জন্য চাপ দিতে লাগলো। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। কিছুতেই রাজি হলাম না। আর এক কি দেড় মাস। তারপর আর আমি একা থাকবো না। কিন্তু আপনার কাছে আসলে এসব বলার জন্য আমি আসিনি।
গত দুদিন ধরে আমার পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ডেলিভারির সময় হয়তো হয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের পারিবারিক ডাক্তার সব পরীক্ষা করে জানালেন, এখনও চিন্তার সময় আসেনি। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। একই সাথে গত দু’রাত ধরে আমি একটা স্বপ্ন দেখছি। প্রথম রাত স্বপ্নে আমি কালো ধোঁয়ার মতো ভয়ঙ্কর করালদর্শন একটা মানুষের অবয়ব দেখেছি। সে যখন আমাদের বেডরুমে ঢুকে আমার কাছে আসতে গেলো ঠিক তখনই প্রচণ্ড পেটের ব্যাথায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার দিয়ে চোখ মেলে দেখি সারা ঘরে ও ছাড়া আর কেউ নেই। একদিকে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা অন্যদিকে ওর নিশ্চিন্ত ঘুম দেখে খুব অসহায় লাগছিলো। পরদিন রাতে আমি একই স্বপ্ন দেখি। সেদিন আমার মনে হচ্ছিলো যেন আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না, কালও দেখিনি। যা দেখেছি ও দেখছি সবই বাস্তব। আজও সেই একই ছায়ামূর্তি আমার ঘরে এসেছে। কিন্তু আজকের সে যেন স্বর্গাগত কোন দেবতার সাদা ছায়ামূর্তি। এবার তার সাথে আমার কথা হয়। মুখখানা দেখতে পারিনি ঠিকই কিন্তু তাকে আমি আমার সমস্যার কথা বিস্তারিতভাবে বলি। সব শুনে সে আমাকে একটা ঠিকানা দিলো। দিয়েই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। পাছে আবার ভুলে যাই কিনা সেজন্য উঠে একটা কাগজে ঠিকানাটা টুকে রাখি। সকালে ও অফিসে চলে গেলে আমি গাড়ি নিয়ে ঠিকানাটা খুঁজতে বের হই। অনেক কষ্টে খোঁজাখুঁজি করে তারপর আপনার এখানে আসা। কাগজের ঠিকানাটা স্থানীয় অনেকেই বলতে পারলেন না। অবশেষে নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়া এক মুরুব্বীকে বলতেই তিনি আপনার বাড়িটা চিনিয়ে দিলেন। আপনি আমার সমস্যার একটা সমাধান করে দিন। আমার স্বামীকে আবার বিয়ের আগের সেই প্রেমিক বানিয়ে দিন। যদি তা না পারেন তবে অন্তত আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করুন। কারণ আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। কিন্তু আমার সন্তান আমার কাছে বেঁচে থাকার আর্তি জানিয়েছে। স্বপ্নে ওকে নিয়ে আমি অনেক অজানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই। শেষ যেবার ওকে স্বপ্নে দেখি ও আমাকে বলে, “মা, আমি মনে হয় তোমার জগতে আসতে পারবো না। তোমাকেই হয়তো আমার জগতে আসতে হবে। কিন্তু তুমি তো এখনো তৈরিই হওনি। ইস! একবার যদি তোমার ওখানে যেতে পারতাম।” গণেশ সাধু হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলো। কাগজে চোখ বুলিয়েই সে চমকে উঠলো। গা শিরশির করে উঠলো। এটা কিভাবে সম্ভব!
চলবে........
গল্পটা লিখতে লিখতে অনেক বড় হয়ে যায়। লিখার সময় কি আর মনে থাকে এসব বিষয়। তাই গল্পটাকে দুই পর্বে ভাগ করে দিলাম। দ্বিতীয় পর্ব ইনশা আল্লাহ্ আগামী ৩০ ঘণ্টার ভিতর ব্লগে দিয়ে দিবো। আর হ্যাঁ, উপরের ছবিটা নেট থেকে ধার নেওয়া। কিন্তু গল্পটা না।
আধিভৌতিক ঘটনা-দাবাবোর্ড
আধিভৌতিক ঘটনা-জ্যোৎস্নাচূড়া
আধিভৌতিক ঘটনা-হলজীবন
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:১১