এই ঘটনাটা ২০১১ সালের প্রথম দিকে ঘটেছিলো। আমি তখন জুরাইন থাকতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভার্সিটির বাসে যাতায়াত করতাম। গত বছরের মার্চের দিকে আমরা আমাদের নিজেদের বাসায় গিয়ে উঠি। শনির আখড়ার পরে রায়েরবাগে একটা বাড়ি আছে আমাদের। কিন্তু সেখান থেকে প্রতিদিন ভার্সিটি যাওয়া-আসা করা খুব কষ্টকর ছিল। তার উপর যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতুর নির্মাণকাজের জন্য দিন দিন অবস্থা আরও ভয়াবহ ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো। সিদ্ধান্ত নিই ভার্সিটির হলে উঠার। আমি ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র। হলে উঠতে গিয়ে নানা রকম ঝামেলায় পড়লাম। ছাত্র রাজনীতির নোংরা মারপ্যাঁচ দিয়ে শেষতক আমার এক ক্লাসমেটের সাথে ডাবলিং (Doubling) করে থাকার বন্দোবস্ত হয়। শুরু হয় আমার হলজীবন।
ছোটকাল থেকেই আমার রাত জেগে পড়ার অভ্যাস। হলে এসেও এটা বজায় রাখলাম। তবে আমি আমার হলের স্টাডিরুমে তেমন একটা পড়তাম না। শহীদুল্লাহ হলের স্টাডিরুমেই বেশিরভাগ সময় যেতাম। এই হলের স্টাডিরুম বেশ বড়সড় ছিল। সামনে প্রশস্ত বারান্দা থাকায় হেঁটে হেঁটেও পড়তে পারতাম। এইটাও আমার পুরান কালের অভ্যাস অর্থাৎ হেঁটে হেঁটে পড়া। পড়তে পড়তে রাত হয়ে গেলে স্টাডিরুমের টেবিলে বা কয়েকটা চেয়ার জোড়া দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। রাতে মাঝে মাঝে আমি একা একা হাঁটতে বের হতাম। চানখারপুলের খাবারের দোকানগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকতো। ওখানে মাঝে মাঝে ঢুঁ মারতাম। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে কিছু চায়ের দোকান ছিল। মাঝে মাঝে ঐখানে বসে চা-বিস্কুট খেতাম। হলজীবনের সাথে ভালোই মানিয়ে নিয়েছিলাম।
কিন্তু হঠাৎ একরাতে
পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে বাস্কেটবল মাঠের ভিতর কিছুক্ষণ হাঁটতে লাগলাম। ক্লান্ত লাগলে, প্রচণ্ড গরমে রোদের মধ্যে কিংবা মারাত্মক ক্ষুধা পেলে আমি সাধারণত হাঁটি। এতে স্বীয় স্বীয় ক্ষেত্রে কষ্টের মাত্রা কমে যায়। অন্তত আমার যায়। তো, আমি কিছুক্ষণ এভাবে হেঁটে শহিদুল্লাহ হলের যে পুকুর তার শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসলাম। হলের মোট তিনটা ঘাট। তবে যে ঘাটটা ফজলুল হক হলের অফিস বিল্ডিঙের সাথে লাগোয়া আমি সেটাতে দক্ষিণমুখী হয়ে বসে রইলাম। রাত তখন প্রায় দেড়টা কি দুইটা। ঝিরি ঝিরি হালকা বাতাস বইছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম এক লোক হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে। পুকুরের দক্ষিণ দিকে কিছু দোকান আছে। লোকটা ঐদিকের রাস্তা ধরে আসছিলো। সে সোজা আমার কাছে আসলো। কাছে আসার পর দেখলাম লোকটা ভয়ানক ফর্সা। মনে মনে ভাবলাম সে হয়তো ধবল রুগী। কালো একটা জোব্বা পরে ছিল। কালো জোব্বা পরে থাকায় আর আমি বসে ছিলাম বিধায় তাকে অন্ধকারে অনেক লম্বা লাগছিলো। উনি আমাকে তুমি করে শুরু করলেন,“তোমার কাছে কি O পসিটিভ রক্ত হবে? খুব দরকার।” আমি ভাবলাম হয়তো তার কোন আত্মীয় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি আছে। সিরিয়াস অবস্থা। গ্রাম থেকে আসায় বুঝতে না পেরে হলে চলে এসেছে। আর ঢাকা শহরে গ্রামের মানুষের জন্য এরকম সহজলভ্য গ্রুপের রক্ত যোগাড় করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে দাড়ায়। এর আগেও হলে দুজন লোক আমার কাছে একই কারণে এসেছিলো। তারা অবশ্য সকালের দিকে এসেছিলো। তাছাড়া রক্তের প্রয়োজনে মানুষ যে কি বিপদে পড়ে তা আমি নিজের অভিজ্ঞতায় টের পেয়েছি। আমার মুঠোফোনে যাদের নাম্বার সেভ করা তাদের প্রায় সবার নামের পাশে রক্তের গ্রুপটাও লিখে রাখি। তাই আমি সাতপাঁচ না ভেবে খুশিমনেই এই লোকটাকে সাহায্য করবো বলে ঠিক করলাম।
আমার O পসিটিভ রক্ত। কিন্তু দুই মাস আগে আমি এক জায়গায় রক্ত দিই। দ্রুত O পসিটিভের কয়েকজনকে ফোন দিলাম। কিন্তু সবাই কোন না কোন অজুহাতে এড়িয়ে গেলো। লোকটা করুণ সুরে বললো,“ভাই, আমার মা হাসপাতালে। ওনার অবস্থা খুব খারাপ। অনবরত রক্তবমি করছে। ডাক্তার বলেছে দ্রুত এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া লাগবে। তা না হলে বাঁচানো যাবে না।” দেখলাম লোকটা আসলেই বিপদগ্রস্ত। আমি একবার বইমেলায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে রক্ত দিই। সেই হিসেবে তারা আমাকে এক ব্যাগ রক্ত দিতে পারে। আমি ওখানে ফোন দিলাম। ওরা আমার নাম ও সেই ফোন নাম্বারটা চাইলো যেটা আমি বইমেলায় রক্ত দিতে গিয়ে ওদের ফরমে লিখেছিলাম। চেক করে ওরা বললো যে আমি এক ব্যাগ রক্ত এখন নিতে পারবো। আমি লোকটিকে একটা কাগজে কোয়ান্টামের ঠিকানাটা লিখে দিলাম। আমি কিন্তু পুকুর পাড়ে পড়ার ফাঁকে এসে বসেছিলাম। ভাবলাম এখন স্টাডিরুমে ফিরে যাই। ঘণ্টাখানিক পড়াশুনা করে ঘুমায় পড়বো। রওনা দিতে যাবো এমন সময় লোকটা বললো, “ভাই আমার আরেকটা উপকার করবেন (এখন তুমি থেকে আপনিতে আগমন)? আমাকে একটা রিক্সা ঠিক করে দেন। রিক্সাওয়ালাকে জায়গাটা চিনিয়ে ভাড়াটা ঠিক করে দিলে আমার জন্য খুব ভালো হয়।” আমি দেখলাম এটা করে দেওয়া যায়। তাছাড়া আমি তো ঐদিকেই যাচ্ছি। একটু না হয় বাইরে গেলাম। বেশিদূর তো যেতে হবে না। আর লোকটার যদি কোন বদ মতলব থাকে তো সে অন্তত এই জায়গায় এইসব করার সাহস পাবে না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম লোকটা গ্রাম থেকে আসা এবং অতি সরল। আমার মনে কোন রকম ভয় কাজ করছিলো না। তাছাড়া এটা এখন আমার এলাকা। আমি হলের পোলা, ছাত্রলীগের পোলা। আমার আবার কিসের ভয়! শহীদুল্লাহ হলের বাস্কেটবল মাঠের কাছে আসতেই হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ঝড়ো বাতাস আরম্ভ হল। তারপরে আমার আর কিছুই মনে নাই।
চোখ খুলে দেখলাম আমি রাস্তার উপর শুয়ে আছি। আমার এক বন্ধু যে শহীদুল্লাহ হলে থাকে সে আমার মুখের উপর উপুড় হয়ে তাকিয়ে আছে। ও বললো, “আয় তোকে আমার রুমে নিয়ে যাই। যেভাবে দড়াম করে মাটিতে পড়লি তাতে তো আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম যে তোর মাথাটা ফেটে গেলো কিনা।” আমি বললাম, “আমার কি হয়েছিলো রে?” ও বললো,“তোকে আমি দূর থেকেই দেখছিলাম কেমন যেন এলোমেলোভাবে হাঁটছিস। তোর থেকে যখন প্রায় ২৫-৩০ গজ দূরে তখন হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইতে লাগলো আর তার একটু পরেই দেখলাম তুই পড়ে গেলি। কিন্তু নিজে নিজে এভাবে তো কেউ পড়ে না। কেউ ধাক্কা দিলে এরকম করে পড়ে যায়।” “কেউ” কথাটা বলাতে হঠাৎ আমার মনে পড়লো কালো জোব্বা পরা লোকটার কথা। আমি ওকে বললাম,“আমার সাথে যে লোকটা ছিল সে কোথায়?” ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,“আছাড় খাইয়া তোর তো দেখি মাথা পুরাই আউট হইয়া গেছে।” আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে ও যা বললো তা আমার মাথায় ঢুকল না। ও নাকি আমার আশেপাশে কাউকেই দেখে নাই। আমি লোকটার বর্ণনা দিলেও সে জানালো এরকম কাউকেই নাকি দেখে নাই। ওর সাথে কথা বলার সময় বুঝলাম ও একটু আগে সিগারেট খেয়েছে। আমি নিজে সিগারেট খাই না। আর কেউ খেয়ে মুখের সামনে কথা বললে মেজাজ গরম হয়ে যায়। কিন্তু আপাতত ওকে কিছু বললাম না। আমি তখন ভাবছিলাম লোকটা কে আর গেলই বা কোথায়!
এই ঘটনা পরে আমার এক ছাত্রের কাছে বলি। ও এসব ব্যাপারে অনেক কিছু জানে। সব বিস্তারিতভাবে শুনে ও বললো,“আপনাকে হয়তো আন্ধাগোলায় (Topographical Disorientation) ধরেছিলো। এরা চেনা পথ ভুলিয়ে অচেনা জায়গায় নিয়ে যায়। তারপর কিছু না কিছু ক্ষতি করেই। অনেক সময় মেরেও ফেলে।” আরও যা জানালো তা হলঃ এসবক্ষেত্রে এরা নিজ হাতে কিছু করে না। ভিক্টিমকে মানসিকভাবে অস্থির করে তোলে, সে তখন চোখের সামনে হয় অন্ধকার দেখে না হয় অন্য কোন জগত দেখে। ও আমার বন্ধুর সিগারেট খাওয়ার বিষয়টা বেশ গুরুত্ব সহকারে নিলো। আমাকে সাবধানে থাকতে বললো। রাতে যেন একা একা কোথাও বের না হই আর ঘুমানোর সময় যাতে দোয়া-দরূদ পড়ে শুই- এরকম আরও কিছু কথা বললো।
এরপর কয়েকদিন কেটে যায়। ব্যাপারটা আমি ভুলে যাই। ভুলে যেতে বাধ্য হই। কারণ মিডটার্মের চাপ বাড়তে থাকায় প্রায়ই আমাকে স্টাডিরুমেই তিনটা-সাড়ে তিনটা পর্যন্ত থাকতে হতো। ক্লান্ত হলে ওখানেই ঘুমায় যেতাম। কিন্তু বিপদ আবার এসে হানা দিলো হঠাৎ একরাতে
আমি শহীদুল্লাহ হলের পত্রিকা পড়ার রুমে বসে পড়াশুনা করছিলাম। এমনিতে এখানে সবাই পত্রিকা পড়তে আসে। কিন্তু রাত দশটার পরে পত্রিকা উঠিয়ে ফেলা হয়। এই রুমটা রাস্তার পাশে। জানালা দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ দেখা যায়। আমি পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে স্টাডিরুমের লম্বা বেঞ্চিতেই ঘুমায় গেলাম। একটু পর দেখি কালো জোব্বা পরা এক লোক রুমে ঢুকেছে। ঢুকেই দরজা ছিটকিনি মেরে বন্ধ করে দিলো। সেই রাতে ঐ রুমে আরেকটা ছেলে ঘুমাচ্ছিলো। লোকটা প্রথমে তার দিকে গেলো। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সোজা আমার দিকে আসলো। আমার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর ঐ অবস্থায় ঝুঁকে আমার গলা চেপে ধরলো। সাথে সাথে আমি কালেমা পড়তে লাগলাম। কিন্তু তাতে সে আরও জোরে গলাটা চেপে ধরলো। আমার তখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমি আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম। আয়াতুল কুরসির শেষদিকে এসে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলাম আমি আয়াতুল কুরসি পড়ে যাচ্ছি। আর আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে কালো জোব্বা পরা এক লোক। চোখদুটো যেন কোনো সুপ্ত ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে। এরপরের কোন ঘটনা আমার আর মনে নাই। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে পরদিন সকালে ক্লাস করতে গেলাম।
পরিশেষেঃ এরকম উপর্যুপরি দুইটা ঘটনায় আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমার ছাত্রকে এই ঘটনাটাও জানাই। ও কেবল সব কথা শুনে চলে গেলো। কিছুই বললো না। হঠাৎ একদিন ও ফোন করলো। ভিসির বাড়ির সামনের গাছতলায় আসতে বললো। ওর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম। আমার পিছনে নাকি একটা পিশাচগোষ্ঠী লেগেছে। কারণটা জানা যায়নি। তবে আমার আপনজনদের ভিতর থেকে এই কাজটা কেউ একজন করছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তার পরিচয় বোঝা যাচ্ছে না। আমি পিশাচগোষ্ঠীর ব্যাপারে জানতে চাইলে ও বললো, “পৃথিবীতে হাজারও রকমের মানুষ আছে। এরকমই এক প্রকার হচ্ছে পিশাচরা। এরা কাগজে-কলমে হয়তো মানুষ কিন্তু আচরণে এক পরিবর্তিত প্রাণী।" ও আমাকে এরকম আরও অনেক জাতের কথা বললো- আদমখোর, চন্দ্রাহত, রক্তচোষা, ইত্যাদি। ওকে বিদায় দিয়ে আমি ক্লান্ত পায়ে টিএসসির দিকে হাঁটছি। মানুষে পরিপূর্ণ প্রাণে চঞ্চল টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে বসলাম। আমার চিন্তায় কেবল একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছিল- আপনজনদের ভিতর পিশাচগোষ্ঠী! কারা তারা! কোথায় তারা! তাদের ব্যাপারে তো কোনোদিন কারো কাছ থেকে কিছু শুনিনি!
সবশেষেঃ এই গল্পটা আংশিক সত্য এবং সত্য অংশটা আমার জীবনেই ঘটেছে। তবে সেই অংশটা কোনটা সেটা বলতে চাচ্ছি না।
আধিভৌতিক ঘটনা-দাবাবোর্ড
আধিভৌতিক ঘটনা-জ্যোৎস্নাচূড়া
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৫৯