ঘটনাটা ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। ভৌতিক ঘটনার অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা আমি কখনোই ভাবতে পারিনি। একটা বিশেষ কাজে আমি যমুনা সেতুর টাঙ্গাইল অংশে যাই। কাজটা আমি অনেকদিন আগে থেকেই করবো বলে ভাবছিলাম। কিন্তু নানা কারণে করা হয়ে উঠেনি। তেমন কিছু না। আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। ঘুরতে পছন্দ করি। ২০১০ সালে আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ রহমতে আমি ঢাকা থেকে বাংলাদেশের সর্বউত্তরে মহাসড়ক ধরে পায়ে হেঁটে একটা ট্যুর দিই। ১৩ দিনের এই দীর্ঘ ভ্রমণে আমাকে যমুনা সেতুও (বর্তমান বঙ্গবন্ধু সেতু) পায়ে হেঁটে পার হতে হয়। আর সেজন্য সেতু কর্তৃপক্ষ আমাকে যে লিখিত অনুমতি দেয় সেটাই আনার জন্য এই বের হওয়া।
সেদিন ছিল বুধবার। আমি কমলাপুর থেকে উত্তরবঙ্গগামী রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠি। কিন্তু পথে কোন এক কারণে মৌচাক রেলস্টেশনে আমাদের ট্রেনটা বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকে। পরে জানতে পারি, সামনে কি যেন একটা সমস্যা হয়েছে। বাংলাদেশে এসবক্ষেত্রে যা হয় আর কি- সামান্য সমস্যা সমাধানে অসামান্য সময়ক্ষেপণ। যাই হোক আমি দুপুর দুইটার কিছু পরে যমুনা সেতুর পূর্ব পার্শ্বের রেলস্টেশনে পৌঁছাই। সেখান থেকে সোজা সেতুর Traffic Control Room (TCR)-এ যাই। আমার আসার উদ্দেশ্য বলি। ওনারা স্টোররুমে গিয়ে বেশ খোঁজাখুঁজি করে আমার সেই কাগজটা খুঁজে পেলেন না। আমি হতাশ হলেও আশা হারালাম না।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমি সোজা যমুনা সেতুর অফিসে গেলাম। কারণ অল্প কিছুক্ষণ পরেই অফিস আওয়ার শেষ হয়ে যাবে। আর এখানে আজকে থাকার কোন পরিকল্পনা আমার ছিল না। ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল কিছু ছবি তুলবো। অফিসে গিয়ে আমার এখানে আসার হেতু আবারো পেশ করলাম। সাথে আব্বার পরিচয়ও দিলাম। আব্বা সড়ক ও জনপদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী। দুয়ে মিলে ওখানকার এক নিরাপত্তাবিষয়ক অফিসার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলেন। কিন্তু গুরুত্ব দিয়েও কোন লাভ হয়নি কারণ আসলেই কাগজটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। যে অফিসারের সাথে আমি এসব কথা বলছিলাম তিনি সেনাবাহিনীর একজন সাবেক মেজর। তখন বিকাল বিকাল হয়ে আসছিলো। উনি আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। বললেন,“বাবা, তোমাকে বরং আমি অফিসের একটা গাড়ি দিই। তুমি সেতু এলাকাটা ঘুরে দেখে আসো।’’ ড্রাইভারকে ডেকে বললেন,“ওকে সব জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে। জ্যোৎস্নাচূড়াতেও নিয়ে যাবে। কোথাও আটকালে আমার গেস্ট পরিচয় দেবে।” আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হলাম।
সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর মানে কি তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম একটু পরে। ড্রাইভার আমাকে সেতুর খুব কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। এখানে সাধারণ মানুষ তো যেতেই পারে না অনেক অফিসারেরও প্রবেশ নিষেধ। বঙ্গভবন, গণভবনের মতো এই সেতু এলাকাটা কেপিআই (KPI)-এর অন্তর্ভুক্ত। সামরিক বাহিনীর নজরদারিভুক্ত। এখান থেকে আরও অনেক জায়গায় গেলাম। নদীতীরের অসামান্য সৌকর্য, যমুনা আনন্দ পার্ক, যমুনা বহুমুখী সেতু আঞ্চলিক জাদুঘর ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। লাল রক্তিম আকাশকে বিদায় দিয়ে এখন আমি জ্যোৎস্নাচূড়ার দিকে যাচ্ছি। এই জায়গাটা কেবল সেনাবাহিনীর অফিসারদের জন্য বরাদ্দ। সেদিন ছিল পূর্ণিমা কিংবা তার পরদিন। চাঁদের আলোয় জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর লাগছিলো। যেহেতু সেই সাবেক সামরিক অফিসারের অনুমতি ছিল সেহেতু আমার জ্যোৎস্নাচূড়ায় উঠতে কোনো সমস্যা হল না। এরই মধ্যে ড্রাইভারকে কে যেন ফোন দিলো। আমি বুঝলাম না কে করলো। ড্রাইভার আমাকে যা বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো সংক্ষেপে তা এরকমঃ “এটা তো পেট্রলের (Security Patrol) গাড়ি। আমাকে জরুরী কাজে এখুনি যেতে হচ্ছে। কিন্তু আমি আপনাকে এসে নিয়ে যাবো। আপনি ততক্ষণ এখানেই থাকুন না হয়। আমার বেশি সময় লাগবে না।” জ্যোৎস্নাচূড়ার দায়িত্বে থাকা সৈনিকও তাতে কোন আপত্তি করলো না। কিন্তু আমি দেখলাম আবার আমাকে নিতে আসলে সেটা বেচারা ড্রাইভারের ডিউটি আওয়ারের বাইরে হয়ে যাবে। তাছাড়া উনি যা করেছেন সেটাই অনেক। তাই ড্রাইভারকে চলে যেতে বললাম। আমি নিজে থেকে বলাতে ড্রাইভার বেশ নিশ্চিন্ত মনে চলে গেলো। আমি একা একা জ্যোৎস্নাচূড়ায় উঠলাম।
জ্যোৎস্নাচূড়াটা তেমন আহামরি কিছু না। বলা চলে বড়সড় উঁচু একটা মাটির ঢিবি। সেখানে উঠেই দেখলাম দুজন সামরিক অফিসার মাটিতে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখে তারা খানিকটা বিরক্ত হল। কেন ও কিভাবে এখানে আসলাম তা জানার পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে বসতে বললো। আমি বসতে গিয়ে দেখলাম জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে। ভাবলাম নদীতীরের একটা জায়গা, তার উপর শীত যাই যাই করলেও একেবারে চলে তো আর যায়নি। তাছাড়া বেঁকে চলে যাওয়া সেতুর পশ্চিম অংশ (যে দিক সিরাজগঞ্জের সাথে সংযুক্ত) ঝাপসা লাগছিলো এখান থেকে। যাই হোক আমি ওনাদের দুজনের সাথে প্রায় এক ঘণ্টার উপরে গল্প করলাম। তবে ওনারা ঠিক সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ছিলেন না। সাবেক বিডিআরের কমব্যাট ড্রেস পরা ছিলেন। আমি ভাবলাম এখানে বিডিআর কি করে! পরে চিন্তা করলাম যা খুশি তাই করুক, আমার কি! ট্রেনে করে আসার সময়ই আমার ঠাণ্ডা লেগে যায়। কারণ প্রায় পুরো রাস্তায় আমি সিট ছেড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করি। উদ্দেশ্য আর কিছুই না-ছবি তোলা। আর এরকম আবহাওয়ায় তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাছাড়া মাথাটাও ঝিমঝিম করছিলো। তাই রাত সাড়ে আটটার পরে নেমে আসলাম।
নিচে এসে দেখলাম সেই জওয়ান নেই যাকে প্রথমে দেখেছিলাম। আরেকজন আছেন। ওনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। আমার একসময় আল্লাহ্ তায়ালার রহমতে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা জেলার উপজেলার নাম মুখস্থ ছিল। আমি মানুষজনকে কখনো তাদের জেলা বলে দিয়ে আবার কখনো উপজেলা বলে আবার কখনো কখনো গ্রামের নাম বলে দিয়ে অবাক করে দিতাম। এতে দেখা যেতো তাদের সাথে আলাপচারিতা অনেক দ্রুত জমে উঠতো। নিচের এই গার্ডকে তার উপজেলা বলে অবাক করে দিলাম। কথা প্রসঙ্গে উপরে বসে গল্প করা দুজন অফিসারের কথা বললাম। উনি শুনে কিছুটা অবাক হলেন। বললেন,“কি বলেন, বিডিআর তো এখন নেই। বিজিবি হয়ে গেছে। তা যাই হোক, কিন্তু ওখান থেকে তো কোন স্যারের আসার কথা না!” যখন বললাম যে, আমি এতক্ষণ ওনাদের সাথেই তো গল্প করলাম। জওয়ান কিছুটা অবাক হয়েই বললেন,“কাদের সাথে আপনি গল্প করেছেন! আসেন তো দেখি।” আমি ওনাকে নিয়ে উপরে গিয়ে দেখি কেউ সেখানে নেই। আমার সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। কোনকিছু না ভেবেই আমি দৌড়ে আমাদের বসার জায়গাটায় যাই। পূর্ণিমার আলোয় পরিস্কার দেখি সেখানের একটা জায়গা ভেজা। একজন মানুষ কাপড় পরে নদীতে ডুব দিয়ে এসে যদি এখানে বসে তাহলে যেমন ভেজা থাকবে সেরকম চাপ মারা ভেজা। ঐ ঘটনার পর আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। বুঝে উঠতে পারি না পুরো ব্যাপারটা।
যমুনার পূর্ব পার্শ্বের রেলস্টেশনে এসে ঢাকাগামী একটা ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর রাজশাহী থেকে আসা পদ্মা এক্সপ্রেসে চেপে ঢাকার দিকে রওনা দিই। সারা পথে এমনকি বাসায় এসেও আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি মনে করতে তাদের সাথে যে সময়টুকু ছিলাম সে সময় কি কি গল্প আমি করেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি না। এমনকি সেই দুজনের চেহারাও আমি আর মনে করতে পারি না। পরদিন সকালে আগেরদিনের তোলা ছবিগুলো কম্পিউটারে আপলোড করার সিদ্ধান্ত নিই। মেমোরি কার্ড ঢুকিয়ে দেখি কোন রেসপন্স করে না। ছোট মামাকে বললাম। মামা দেখে বললো যে, মেমোরি কার্ড হয়তো ক্রাশ করেছে। আমি সেদিন প্রায় ৩০০ এর উপর ছবি তুলি। তার কিছুই এখানে নাই। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। আমার পুরনো দিনের কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে পড়ে যায়। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি ঘটনাটা স্মরণে আনতে। শেষে কেবল সেই দুজনের চেহারা কিরকম ছিল মনে করার চেষ্টা করতাম।
এর অল্প কয়েকদিন পর আমার শরীর খারাপ হয়। জ্বর আসে। ঋতু পরিবর্তনের এই জ্বর আমার প্রতিবছরই হয়। আমার জন্য এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই স্বাভাবিক ঘটনার সময় আমি কিছু অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখি। আমি দেখতাম বেশকিছু লোক এক বিশাল খোলা মাঠের মাঝখানে বসে আছে। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দেখতাম। পরপর বেশ কয়েকদিন তাদের এভাবেই দেখলাম। হঠাৎ একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি ঐ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। দূরে মাঠের মাঝখানে সেই লোকগুলো গল্প করছে। এমন সময় তাদের মধ্য থেকে দুজন উঠে আমার দিকে আসতে লাগলো। কাছে আসার পর আমি লোক দুজনকে চিনতে পারলাম। আরে! এরাই তো সেই দুজন অফিসার যাদের আমি জ্যোৎস্নাচূড়ায় দেখেছিলাম। ওদের একজন বললো,“তুমি আর এখানে আসবে না। আমাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে কোন লাভ নাই। তুমি চলে যাও। এখানে আসার সময় এখনো তোমার হয়নি।” এর কিছুদিন পর (২৬ ফেরুয়ারি) আমি একটা ওয়েবসাইটে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কিছু সামরিক অফিসারের ছবি দেখতে পাই। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে সেই দুজন অফিসারের বিডিআরের পোশাক পরা ছবি ছিল।
পরিশেষেঃ বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তো চিররহস্যময় হয়ে থাকবে বিডিআর বিদ্রোহের আসল ঘটনা; তেমনি হয়ে থাকবে এটাও- কেন আমিই, হ্যাঁ, আমিই তাদের দুজনকে দেখলাম! কারা তারা আর আমার সাথে তাদের কি সম্পর্ক তা আমার কাছে আজও রহস্যে ঘেরা। তবে দুইয়ে দুইয়ে চার না মেলাতে পারলেও অন্তত দুই দুগণে চার ঠিকই একদিন মেলাতে পারবো আশা রাখি। কারণ বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে বিস্তর গবেষণার এক পর্যায়ে বের করতে পারি কিছু বিশেষ সামরিক অফিসারের কথা যাদের বিদ্রোহের দিন হত্যা করে ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়। রাতের নিস্তব্ধতায় নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ে নিঃশব্দে ভাসতে ভাসতে তাদের সিক্ত লাশ একসময় বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। এরকম ছয় কি সাতজন অফিসারের লাশ বুড়িগঙ্গার কালো পানি থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের ভিতর একজন ছিল সেই দুজন অফিসারের একজন যাদের আমি জ্যোৎস্নাচূড়ায় আর পরবর্তীতে স্বপ্নে দেখি। কমবয়সী সেই সামরিক অফিসার জ্যোৎস্নাচূড়ায় যেখানে বসে ছিল সেখানটাই কিন্তু ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ছিল। অন্তত আমার কাছে তো তাই মনে হয়েছে। আরেকটা কথা বলে শেষ করি? আমার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড সেদিন ক্রাশ করেছিল না। আমার এক আর্কিটেক্ট বন্ধু একটা বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে আমার প্রায় সব ছবি উদ্ধার করে দেয়। প্রায় কথাটা বললাম এই জন্যই কারণ, আমি জ্যোৎস্নাচূড়ায় যেসব ছবি তুলি তার কোনটাই মেমোরি কার্ডে ছিল না। মেমোরি কার্ডের সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে সেভ হওয়া ছবিগুলোর ভিতর কেবল দশটা ছবি মিসিং ছিল।
সবশেষেঃ এই ঘটনাটা পুরোটাই কাল্পনিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিডিআর বিদ্রোহের অন্তরালের আসল কাহিনী আমরা মোটামুটি সবাই জানি। এটাকেই ভৌতিক আবহে উপস্থাপনের একটা ব্যর্থ চেষ্টা আর কি। তবে আমার পায়ে হেঁটে ভ্রমণ, রংপুর এক্সপ্রেসে করে (সেই লিখিত অনুমতিপত্র আনতে) যাত্রা, সেনা অফিসারদের প্রমোদস্থান জ্যোৎস্নাচূড়ায় গমন এসব সত্য। মূলত ওখান থেকে ফিরেই এরকম একটা গল্প লিখতে মন চাইলো। এটা পড়ে কেউই হয়তো ভয় পাবেন না, কাহিনীটাও কারো কারো কাছে বাজে লাগতে পারে। কিন্তু এটা আমি এক বিশেষ উদ্দেশ্যে লিখেছি। কি সেই উদ্দেশ্য তা তো ধরতেই পারছেন।
আধিভৌতিক ঘটনা-দাবাবোর্ড
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৪৯