মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ ৭০ শতাংশই যৌন রোগে আক্রান্ত
যৌন সংখ্যালঘুদের বঞ্চনাগাথা
সচেতনতার অভাবে সেক্স মাইনরিটিরা এইচআইভিসহ নানান যৌন রোগে আক্রানত্ম হচ্ছে। যৌন মিলনে কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যবহার না করার কারণে সেক্স মাইনরিটিদের (যৌন সংখ্যালঘু) প্রায় ৭০ শতাংশই কোন না কোন যৌন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ফলে এটা যে শুধু তাদের জীবনকেই বিপন্ন করে তুলছে তা নয়, দেশে এইডসের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও পুরুষে পুরুষে যৌন কর্মের বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। সরকারীভাবেও এটাকে অস্বীকার করা হয় না। বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩৭৭ নং ধারা অনুযায়ী এটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে দেশে যৌন সংখ্যালঘু তথা সেঙ্ মাইনরিটিরা যৌনকর্মের সময় কোন প্রকার প্রতিরোধক ব্যবহার করে না। আবার পারিবারিক চাপে ও সমাজিক কারণে এই সম্প্রদায়ের মানুষরা বিয়ে করে সংসারও করে। ফলে তাদের যৌন রোগ তাদের স্ত্রীদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশে সমকামীদের মধ্যে পাঁচ থেকে দশ শতাংশ এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে সমকামীদের বেশির ভাগই এইডস রোগে আক্রানত্ম হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও যৌন সংখ্যালঘুদের অনেকেই যে এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে তা স্বীকার করেছেন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কর্মকর্তারা। এই সংগঠন গত ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশে সেঙ্ মাইনরিটিদের স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কাজ করছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে যারা পুরুষের সঙ্গে সেক্স করছে তাদের অনেকেই এইডস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই সংগঠনেরই এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশের সেক্স মাইনরিটিদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই এইডসসহ নানা যৌন রোগে আক্রানত্ম হচ্ছে। এই রোগাক্রানত্মরা যাতে সুস্থ থাকে এবং একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে যাতে রোগ না ছড়ায় সে ব্যাপারে বন্ধু উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে। যারা এইচআইভিতে আক্রানত্ম হয়েছে তারা কিভাবে চলবে, কিভাবে জীবনযাপন করবে সে ব্যাপারে নিয়মিত কাউন্সিলিং দেয়া হয়। যাতে একজন রোগাক্রানত্মের কাছ থেকে অন্য জনের কাছে তা না ছড়ায়। এ প্রসঙ্গে বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, বর্তমানে আমরা এই জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছি। আমাদের ফিল্ড অফিসগুলোতে ক্লিনিক্যাল সেটআপ আছে। ওখানে নিয়মিত ডাক্তার বসেন। তারা এই ফিল্ড অফিসগুলোতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীৰা করে যান।
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পাশাপাশি তাদের মধ্যে সচেতনতা
সৃষ্টির ব্যাপারেও কাজ চলছে। বিশেষ করে এইচআইভি সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা নিজেরাই এইডস প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।'
সালেহ আহমেদ বলেন, একজন মানুষের আচরণ যেমন হোক না কেন, তাদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় তারা কোন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা পায় না। অনেকে যৌন রোগে আক্রানত্ম হলেও ভয়ে ডাক্তারের কাছে যায় না। আবার যারা ডাক্তারের কাছে যায়, সেঙ্ মাইনরিটি শুনলে তাদের চিকিৎসা না করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে এ সম্প্রদায়ের মানুষরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এ কারণেই আমরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পাশাপাশি তাদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছি।
সেঙ্ মাইনরিটিরা মানুষ হলেও তারা সমাজে সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিদেশে আইন প্রণয়ন করে তাদের অধিকার প্রদান করা হলেও বাংলাদেশে পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা তাদের অধিকারের বিরম্নদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে সম্প্রতি এই আইনটি বাতিল করা হলেও বাংলাদেশে এই আইনের বলে যৌন সংখ্যালঘুরা নানামুখী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রম্নপের পৰ থেকে এই আইনটি বাতিলের দাবি উঠেছে।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে সপ্তদশ খ্রীস্টাব্দে পেনাল কোডে ৩৭৭ ধারা অনত্মর্ভুক্ত করা হয়। ওই ধারায় প্রকৃতির বিরম্নদ্ধে কোন যৌনকর্মকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার বহু আগেই এই ধারাটি তুলে দিয়েছে। কিন্তু পাকিসত্মান শাসনামল পেরিয়ে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বয়স ৪০ বছর অতিক্রানত্ম হতে চলেছে, কিন্তু এ ধারাটি বাতিল করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, লিঙ্গ বা জন্মস্থান ভেদে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের বিরম্নদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না। কিন্তু এই আইনের কারণে যৌন সংখ্যালঘুরা দেশে প্রতি পদে পদে বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কোন ছেলেমেয়ে হিসেবে আচরণ করে বা তার মধ্যে মেয়েলি স্বভাব জন্ম নিলে সে প্রতি পদে পদে তার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনা শুরম্ন হচ্ছে পরিবার থেকে। পরবর্তীতে সমাজ থেকে নানা বঞ্চনার শিকার হয়। আবার পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হতে হয়। এ প্রসঙ্গে রম্নবেল (ছদ্মনাম) নামে এক যৌন সংখ্যালঘু জানায়, মেয়েলি আচরণের কারণে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়। অথচ জেলখানাতে অন্য পুরম্নষরা তার সঙ্গে সেঙ্ করেছে। সে বলে, 'আমাদের দেশে সবখানেই সমকামী আছে। কিন্তু মুসলিম দেশ বলে তা প্রকাশ পায় না। অন্য দেশে তা প্রচার হচ্ছে। ফলে সমকামীরা সমাজে তাদের অধিকার নিয়ে জীবন যাপন করছে। আমরাও আমাদের অধিকার চাই।'
জন্মের পর মেয়েলি আচরণ বিকাশ লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে সেঙ্ মাইনরিটিরা সমাজের সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। সে তার শিৰা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পারিবারিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোন পরিবারে পাঁচটি সনত্মান থাকলে একটি সনত্মান যদি মেয়েলি আচরণ করে তবে তাকে তার পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে শিৰার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে সে অন্ধকার পথে পা বাড়ায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ পুরম্নষ বা নারীর চেয়ে একজন সেঙ্ মাইনরিটি বেশি মেধাবী হয়। কিন্তু পড়াশোনা করতে পারে না বলে, সুযোগ পায় না বলে সে তার মেধা কাজে লাগাতে পারে না। ফলে দেশও তার মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, আমরা ১৯৯৬ সাল থেকে সেঙ্ মাইনরিটিদের নিয়ে কাজ করছি। গত ১৫ বছরে আমাদের দেশে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমদিকে আমরা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। এখন সামাজকর্মী, আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী সংস্থার সদস্য, সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আমরা এদের অধিকারের বিষয়ে সংসদ সদস্যদেরও অনত্মর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা গত ১৫ বছরে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তা ধরে রেখে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাই।
তিনি বলেন, ভারতের আইন পরিবর্তন হলেও, আমরা এখনই আইন পরিবর্তন চাচ্ছি না। সময় হলে সমাজ থেকেই আইন পরিবর্তনের দাবি উঠবে। সরকারও আইন পরিবর্তন করবে।
সালেহ আহমেদ বলেন, 'আমরা এখন কৌশল বের করার চেষ্টা করছি কিভাবে উপস্থাপন করলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এজন্য আমরা শিৰক, আইনজীবী, নাগরিক ফোরাম, মানবাধিকার কর্মীদের কাছে তাদের বিষয়টি তুলে ধরছি। এর মাধ্যমে দেশের সুশীল সমাজের মধ্যে এই জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে একটি ইতিবাচক বার্তা পেঁৗছে দিতে চাই।
তিনি বলেন, ভারত, পাকিসত্মান ও নেপালে যেভাবে নারী পুরম্নষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সেঙ্ মাইনরিটিদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশেও সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেছেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী সেঙ্ মাইনরিটিদের প্রতি কোন ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু দেশীয় আইনে তাদের সুরৰার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে এ ব্যাপারে হাইকোর্ট থেকে একটি গাইডলাইন পাওয়া গেলে তা এই জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
সূত্রঃ Click This Link