আজকাল টিভি এবং পত্রিকায় এক শ্রেনীর বয়স্ক লোক সুশীল প্রতিনিধির ব্যানারে তরুন প্রজন্মকে সদা জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের জ্ঞানগর্ব বক্তব্যের মূল বিষয় থাকে "তরুনরা দেশের ভবিষ্যত, দেশের আগামী দিনের গণতন্ত্র, স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য দেশের তুরনদের দায়িত্ব নিতে হবে। আজকের তরুন সমাজকে মানবতাবিরোধী, অগণতান্ত্রিক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, ঘরে বসে থাকার কোন অবকাশ নেই, প্রগতিশীল তরুন সমাজকে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য তাঁরা আহবান জানান।"
তাঁদের আহবানের পেছনে যুক্তিক কারণ আছে। এই পর্যন্ত বাংলাদেশে যত পরিবর্তন এবং অর্জন সব কিছুর পেছনেই তরুন সমাজের অবদান অনবদ্য। ১৯৫২ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণাঅভ্যূত্থান, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলন প্রতিটি স্তরে তরুনদের অবদান অপরিসীম। তরুন-যুবক-বুদ্ধিদীপ্ত বয়স্কদের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলেই আমাদের সমস্ত অর্জন সম্ভব হয়েছে।
আজকে যারা সুশীল সমাজের ব্যানারে বড় বড় লেকচার দেন তাদের সবার গড় বয়স যদি ধরি ৬০ তাহলে ১৯৭৫ সালে এদের সবার গড় বয়স ছিল ২২/২৩বছর অর্থাৎ এরা সবাই তখন টগবগে তরুন।
১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্টে দেশ-বিদেশের চরম ষঢ়যন্ত্রের শিকার হয়ে একদল উচ্চাবিলাশী, ক্ষমতালিপ্সু সেনাবাহিনীর হাতে যখন বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে রাতের আধারে খুন করা হলো তখন এই সব সুশীল প্রতিনিধিরা (যাদের বয়স তখন ২২/২৩ বছর) কোথায় ছিলেন? আজকের জাফর ইকবালদের মত জ্ঞানপাপীরা কি করেছিলেন সেই দিন?? তখন কি ওনারা তরুন ছিলেন না?? লেজ গুটিয়ে ঘরে বসে ভুনা খিচুরী আর গো মাংস খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন কি??
আজ গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে তরুনদের স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের দাবীতে এগিয়ে আসার আহবান জানান, তরুনদের অনেক দায়িত্ব আছে বলে উপদেশ দেন, তখন তাঁদের এই বুদ্ধি বা উপলব্দি কোথায় ছিল? স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধুকে যখন খুন করা হলো তখন কেন এরা প্রতিবাদী হয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করতে পারলেন না। আজ সুশীল সমাজ সেজে, জ্ঞানী সেজে মানুষকে উপদেশ দেন, আয়নায় কি নিজেদের চেহারাটি একবার দেখেন?? সেই সময়ে একমাত্র বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীরউত্তম) প্রতিবাদ করেন, এর ফলশ্রুতিতে হুলিয়া মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন বিদেশী অবস্থনা করেন। কোথায় ছিলেন তখন আজকের সুশীল সেই সময়ের তরুনেরা??
আজকে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে ভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা বলেন, স্বার্থানেস্বী রাজনীতিবিদ বলেন, তাদের কাছে প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোথায় ছিলেন?? তখন যদি আপনারা কাদের সিদ্দিকীর সাথে সোচ্চার হতেন, প্রতিবাদ করতেন, তাহলে রাজনীতির ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। আপানদের ব্যর্থতার দায়-ভার কেন কৌশলে, জ্ঞান বিক্রির মারপ্যাচে তরুনদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন?? নিজেদের ব্যর্থতার জন্য কি আপনারা একবারও তরুনদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন??
আজকে যে সব সুশীল সমাজের মুখ টিভিতে বা পত্রিকায় দর্শন করি তাদের অনেকেই দেশের প্রয়োজনে রাজপথে দেখছি বলে মনে পড়ে না। এমনকি ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এদেরকে রাজপথে থাকার কোন ছবি দেখা যায়না।
১৯৭১ সালের যে সব বুদ্ধিজীবিদের রাজাকার, আলবদর- আলশামসরা ধরে নিয়ে নির্মভাবে হত্যা করে জাতীকে মেধাশূন্য করেছিল, সেইসব বুদ্ধিজীবিরা যদি ঘরে না থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতেন তাহলে হয়তো অনেক কম মেধাবী লোককে হারাতে হতো। অনেকে হয়তো আমার এই মতের সাথে দ্বিমত পোষন করবেন, বলবেন ওনারা যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে লেখা-লেখি করে জনমত গঠন করতে পারতেন না, আমি বলবো ভুল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কি সঠিক ভূমিকা পালন করেনি?? তারা কি কন্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেননি? যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবি ভাবেন তারা একটু ভীতু হন এবং নিজেদেরকে ঘরে আটকে রাখতে পছন্দ করেন। এরা সুসময়ে জ্ঞান বিতরণ করেন, অসময়ে ঘরে বসে থাকেন। এইসব বুদ্ধিজীবিদের আমি খুব একটা শ্রদ্ধা করতে পারিনা।
পরিশেষে বলতে যাই আজকের তরুনরা সব সময়ই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন। গণজাগরণ মঞ্চ এর উজ্জল দৃষ্টান্ত যদিও পরবর্তীতে সরকার দলীয় রাজনীতির স্বীকার হয়ে মূল চেতনা ভুলন্ঠিত হয়ে যায়। সুশীল সমাজের বাকপটু ব্যক্তিদের বলবো আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন, নিজের তরুন দিনের কর্মকান্ডের মূল্যায়ন করুন, আজকের তরুন সমাজের কাছে নিজের অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চান তারপর উপদেশ দিতে আসেন। ড জাফর ইকবালদের মত লোকদের বলবো সুবিধা আদায়ের জন্য সুশীল না সেজে নিজের দায়িত্বহীনতার জন্য অনুতপ্ত হোন। ১৯৭৫সালে কি অবদানটা রেখেছিলেন যে আজ বঙ্গবন্ধুর গুনকীর্তন করে শেখ হাসিনার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে কর্মক্ষেত্রে এবং বুদ্ধিবিক্রির বাজারে নিজেকে মূল্যবান করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন??
আমাদের দেশের প্রধান দুই দলেই জাফর ইকবালের মত অনেক সুশীল লোক পাওয়া যায়, যারা সুসময়ে বকবক করেন আর দুঃসময়ে লেজ গুটিয়ে ঘরে বসে ভুনা খিচুরী আর গোমাংস চিবান। আজকের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর গুনকীর্তন করতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, হাসিনার চেয়েও বেশী কান্নাকাটি করতে চান, তাদের বলবো ১৯৭৫ সালে কোথায় ছিলেন?? কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ হানিফেরমত নেতারাতো তখন তরুন ছিলেন কি করেছিলেন?? কাদের সিদ্ধিকীকে নিয়ে ব্যঙ্গ মন্তব্য করেন, কাদের সিদ্দিকী যে সাহসিকতার পরিচয়ে দিয়ে সেনা প্রসাশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন আপনারা কি তা করেছিলেন?? করেননি, ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। হানিফ কামরুল রাজনীতি করছেন,যারা রাজনীতি করতে পারছেন না তারা সুশীল সেজে জ্ঞানের বানী শুনান। আপনাদের লজ্জাবলে যদি কিছু থাকে নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে তরুনদের উপদেশ দিতে আসেন। যে কাজ নিজে করতে সাহস পাননি সেই কাজ অন্যকে করার উপদেশ দিবেন না। যারা সাহসী তরুন, তারা জানেন কখন কি করতে হয়। ১৯৫২সালে সেটা দেখিয়েছে, ১৯৭১ সালেও দেখিয়েছে,১৯৯০ সালেও দেখিয়েছে, সম্প্রতি ২০১৩সালেও দেখাচ্ছে এবং আশা করি ভবিষ্যতেও দেখাবে। সুতরাং বড় বড় কথা না বলে পূর্বের ন্যায় ঘরে বসেই দেখুন তরুনরা কি করতে পারে। জ্ঞান দিতে আসবেন না। আপনাদের জ্ঞানের কথা শুনলে, আপনাদের অতীত জীবনের কথা মনে পড়ে যায়, তার জন্য আপনাদের যথাযথ সম্মান দেখাতেও কষ্ট হয়।
=========
তারিখ: ২৫ই আগষ্ট, ২০১৩