লিওনার্দ কোহেনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল জন বন জোভি। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। একদিন কনসার্টে তাঁকে গাইতে দেখলাম: ‘‘If you want a lover, I’ll do anything you ask me to / And if you want another kind of love, I’ll wear a mask for you’’ কথাগুলো শুনতে সাধারণ কিন্তু অন্যধরণের। আমার আগ্রহের কারণে পরবর্তীতে জানতে পারলাম, আসলে এটা তাঁর গান নয়। এই গানের মালিক লিওনার্দ কোহেন। কবি এবং গীতিকার। শুধু তা-ই নয়, ভদ্রলোক দ্য ফেভরিট গেম (১৯৬৩) ও বিউটিফুল লুজারস (১৯৬৬) নামে দুটো উপন্যাসও লিখেছেন। বর্তমানে আমাদের দেশে যারা গান করেন, তারা এসব দিক এড়িয়ে যা-ন। লেখালেখিতেও তাদের খুব একটা পাওয়া যায় না।
সে সময় প্রথমবারের মত ‘‘আই এম ইয়ুর ম্যান’’ অ্যালবামটি আবিস্কার করি। অথচ, এটি প্রকাশিত হয়েছিল ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮তে। কী অদ্ভুত সব লিরিক, আর সুর ছড়িয়ে ছিল সেখানে! সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম, তাঁর ঈর্ষা করার মত কণ্ঠস্বর শুনে। একদিন কথাপ্রসঙ্গে ইমরোজ ভাই বলেছিলেন, এরকম কণ্ঠ ২০০ বছরে একটা পাওয়া যায়। যদিও এর সত্যি-মিথ্যে জানি না। অবশ্য, ওই অ্যালবামে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানে কোহেন বলেছেন: ‘‘Everybody knows the good guys lost’’
তাঁর গানের মধ্যে বিষাদের পাশাপাশি ছড়িয়ে আছে তীক্ষ্ণ রসবোধ। আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি অকপটে নিজের কথা বলে গিয়েছেন। আমি তাঁর মধ্যে গায়কের চেয়েও বেশি কবিসত্ত্বাকে খুঁজে পেয়েছি। তা না হলে কেন বলবেন: ‘‘let me see your beauty when the witnesses are gone / Let me feel you moving like they do in Babylon.’’
গীতিকার হিসেবে তাঁর প্রথম সফল গান ‘‘সুজান।’’ যা গেয়েছিলেন জুডি কলিন্স। ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কে তাদের আলাপ হয়। পরবর্তীতে তাঁর অনুপ্রেরণায় গান গাওয়া শুরু করেন কোহেন। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘‘সংস অব লিওনার্দ কোহেন’’ অ্যালবামটি।
অদ্ভুত লাগে, আমার পরিচিতজনদের মধ্যে অনেককে বব ডিলান, জন লেননকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখেছি, কিন্তু কারও মুখে লিওনার্দ কোহেনের নাম শুনিনি। প্রতীক আর ইঙ্গিতের ব্যবহারের কারণে তাঁকে অনেকে মিনিমালিস্ট কবি বলেন। মনে আছে, এর কিছুদিন পর নোমান ভাই আমাকে কোহেনের অনেকগুলো অ্যালবাম যোগাড় করে দিয়েছিলেন। ভাগ্য ভাল, ভদ্রলোক টাকা-পয়সা জমানোর মত অ্যালবাম জমিয়ে আনন্দ পান। লিওনার্দ কোহেনের আরেকটি গান আমার কাছে গুরত্বপূর্ণ। “দ্য ফিউচার।” ১৯৯২তে প্রকাশিত এই গানে যে বাক্যটি ঘুরে ফিরে এসেছে, তা হল: “I’ve seen the future .. it is murder”. যতবার শুনি, আঁচড় দেয়।
পাঁচ দশক ধরে গান করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থামেনি এই যাত্রা। তাঁর বিখ্যাত গান “হালেলুইয়া” এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শ শিল্পী গানটি রেকর্ড করেছেন। তাঁর শেষ অ্যালবাম “ইউ ওয়ান্ট ইট ডার্কার।” এটি গত মাসে প্রকাশিত হয়। সেখানেও বলেছেন: “Hineni, hineni I’m ready, my lord”. দ্য টেলিগ্রাফ অ্যালবামটিকে মাস্টারপিস উপাধি দিয়েছে।
গত ৭ই নভেম্বর লিওনার্দ কোহেন ৮২ বছর বয়সে থেমে গেলেন। এই গোপন খবর যেদিন প্রকাশ পেল, আশ্চর্যজনকভাবে সেদিন ১০ নভেম্বর। সকাল সাতটায় আমাকে এই দুঃসংবাদ দিলেন নোমান ভাই। মনে আছে কিছুদিন আগে আমিও তাঁকে খোকন ভাইয়ের চলে যাওয়ার খবর দিয়েছিলাম। হৃদয়ের খুব কাছের একজন মানুষ নেই, ভাবতেই এক ধরণের বিষাদ আঁকড়ে ধরে। কিন্তু সেটি প্রকাশ করতে পারি না। কম্পিউটারে তাঁর গান ছেড়ে দিই। একটি লাইন নতুন করে ওঠে আসে। খানিকক্ষণের জন্যে বিষাদ ভুলে আমিও গলা মেলাই: “love’s the only engine of survival”
১১ নভেম্বর, ২০১৬