এক সন্ধ্যাবেলায় খেয়াল করলাম, আড্ডার ভেতর একটি বই ঘুরছে। সাধারণত, একই বই নিয়ে সবার আগ্রহ থাকে না। তাই, প্রথমবারের মত নিয়মভঙ্গ হতে দেখে— আমিও যেনো খানিকটা আগ্রহী হলাম। হাতে নেওয়ার পর বুঝতে পারলাম, আসলে এটি একটি উপন্যাস। দ্য এ্যালকেমিস্ট (O Alquimista). লেখক পাওলো কোয়েলহো। জন্মঃ ২৪ আগস্ট, ১৯৪৭। ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরো'তে। ছেলে অল্পবয়সে লেখক হতে চেয়েছিল শুনে তাঁর মা বলেছিলেন, "My dear, your father is an engineer. He's a logical, reasonable man with a very clear vision of the world. Do you actually know what it means to be a writer?"
অবশ্য, এর পরের ইতিহাস বিস্ময়কর। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, তাঁর দ্য এ্যালকেমিস্ট উপন্যাসটি এখন পর্যন্ত ৮০টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আর, এমন একটি রেকর্ডের কারণে স্বাভাবিকভাবেই জীবিত লেখক হিসেবে গিনেস-বুকে ওঠে গেছে ঔপন্যাসিকের নাম। আর, এই বইয়ের বিক্রি? ৮৩ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
এই উপন্যাসটির মূল চরিত্র সান্তিয়াগো। আন্দালুসিয়ান এই রাখাল ছেলেটি বই পড়তে জানে। তার বাবা-মা চেয়েছিলো সে যাজক হবে। কিন্তু সে পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে চায়। তাই, স্বপ্নে দেখা গুপ্তধনের খোঁজে মিশরের দিকে যাত্রা শুরু করে। এর মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়, স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারী এক মহিলা ও নিজেকে সালেমের রাজা দাবি করা এক বৃদ্ধের সঙ্গে। যার নাম মেলসিজেদেক। সে-ও বলে, স্বপ্নকে অনুসরণ করা উচিত। আর, বিদায়কালে দিয়ে যায় সাদা ও কালো রঙের দুটো পাথর। যার প্রথমটার নাম উরিম আর দ্বিতীয়টার নাম থুমিম। যারা তাকে সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের পথ বাতলে দিতে পারে।
এদিকে, যাত্রা পথে সে হারিয়ে ফেলে তার সঞ্চয়। এ জন্য সান্তিয়াগোকে দু'বছর ধরে একটি স্ফটিকের দোকানে কাজ করতে হয়। এই সময়ের বিরতি তাকে দিয়েছিলো অভিজ্ঞতা ও কিছু সঞ্চয়। যা দিয়ে সে মিশরের পথে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সফরসঙ্গী হিসেবে দেখা হয় এক ইংরেজের সঙ্গে, যার উদ্দেশ্য এ্যালকেমিস্টকে খুঁজে বের করা। কারণ, তারা সিসাকে স্বর্ণে পরিণত করতে পারে, অন্যদের রোগমুক্ত করতে পারে, এবং দীর্ঘায়ু দান করতে পারে।
আগে, সান্তিয়াগো ভাবতো সে ভেড়াদের কথা বুঝতে পারে, ঠিক সে রকম ভাবেই সে মরুভূমিতে উঠের ভাষাও আয়ত্ব করে নেয়। ওখানে, গোত্র-যুদ্ধের কারণে কিছু সময় সান্তিয়াগোকে মরূদ্যানে থাকতে হয়। আর, সেখানে ফাতিমাকে খুঁজে পেয়ে সে বুঝতে পারে, ভালোবাসা মানুষের সপ্নকে পাল্টে দেয় না। ফাতিমা তাকে জানায়, মরুভূমি তাদের কাছ থেকে আপনজন কেড়ে নেয়। মাঝে মাঝে আর ফিরে আসে না তারা। আরও বলে, ''কেউ কেউ সত্যি ফিরে আসে। তখন আশায় বুক বাঁধে অন্যেরা। আমি হিংসা করতাম সে সব মেয়েকে। এখন থেকে আমিও একজনের অপেক্ষায় থাকব।''
অন্যদিকে, ইংরেজ লোকটা যার খোঁজ করছিলো, সেই এ্যালকেমিস্টের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সান্তিয়াগোর। সে-ও তাকে জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। অতঃপর যাত্রাপথে আবারও বিপত্তি। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে বাতাস আর সূর্যের কথা হয়। অবশেষে, অনেক নাটকীয়তা শেষে সান্তিয়াগো তার গুপ্তধন খুঁজে পায়।
জাদুবাস্তবতা আর অভ্যান্তরীণ লক্ষ্যের দিকে পৌঁছে দেওয়ার প্রচুর দিকনির্দেশনা আছে উপন্যাসটিতে। কয়েকটি কিস্তিতে লেখক রীতিমত ঝড় তুলে দিয়েছেন। যা দেখে ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ হয়েছি। উনিশ শতকের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসটির সংলাপগুলো অনেক বেশী তীক্ষ্ণ। যা সহজেই পাঠকের মনোজগত বদলে দিতে পারে। এখানে আরেকটি তথ্য যোগ করি, হলিউড অভিনেতা উইল স্মিথ ও গায়িকা ম্যাডোনার প্রিয় উপন্যাস এটি।
আসলে, পর্তুগিজ ভাষায় এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৯৮৭-তে। তার ঠিক পরের বছর, মানে, ১৯৮৮-তে ব্রাজিলের ছোট একটি প্রকাশনা সংস্থা উপন্যাসটি প্রকাশ করে। অবশ্য, তারা ৯০০ কপি বের করার পর আর রিপ্রিন্ট করে নি। তখন সফলতা না পেলেও, পাওলো কোয়েলহো 'দ্য এ্যালকেমিস্ট' নিয়ে ভীষণ রকম আশাবাদী ছিলেন।
নব্বই পরবর্তী সময়ে বড় একটি প্রকাশনা সংস্থা উপন্যাসটি আবারও প্রকাশ করে। তারপরেই বইটি আন্তর্জাতিক বেষ্টসেলার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। নিজের লেখার প্রতি পাওলো কোয়েলহোর এমন বিশ্বাস, অনেক লিখিয়েদের জন্যে উদাহরণ হতে পারে।
তবে, এই লেখকের জীবন যাপন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানা ধারায় প্রবাহিত হয়েছে।
এখন, এই উপন্যাস ও এর ঔপন্যাসিককে নিয়ে দুটো তথ্য দিয়ে রচনাটি শেষ করবো। প্রথম তথ্য, পাওলো কোয়েলহো বছরের অর্ধেক থাকেন জন্মভুমিতে, বাকি অর্ধেক থাকেন বাইরে। আর, শেষ তথ্যটি হল, দ্য এ্যালকেমিস্ট উপন্যাসটি মাত্র দু'সপ্তাহের মধ্যে লেখা হয়েছিলো।
পাদটীকাঃ বইটি এখনও না পড়ে থাকলে, সান্তিয়াগোর অভিযানে সঙ্গী হোন।
লেখাটি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত