আড়ালে থাকাটাও যে সম্পাদনার সংস্কৃতি, সে কথাটা বার বার প্রমাণ করে গিয়েছেন সাগরময় ঘোষ। তিনি মনে করতেন, লেখক হওয়ার জন্যে প্রচুর বিদ্যা-বুদ্ধি, বিচিত্র অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কতোখানি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কতোটুকু কল্পনার মিশেল দিলে সে লেখা সাহিত্য পদবাচ্য হবে সে বিষয়ে টনটনে জ্ঞান থাকা চাই।
আর এই তিনটি গুণের একটিও তাঁর নেই। কিন্তু তাঁর লেখা ‘হীরের নাকছাবি’ (প্রথম প্রকাশ ১৩৬৮) একজন দক্ষ গদ্যশিল্পীর রচনা।
১৯৫৫ সালের দিকে দেশ পত্রিকাকে ঘিরে একটি লেখকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। সে সময় ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের অনুর্বরা ভূমিকে উর্বরা করার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। তখনকার কংগ্রেস সরকারের সেচমন্ত্রী স্থির করলেন, কাজকর্ম যতটুকু হয়েছে তা এম-এল-এ ও সাহিত্যিকদের ঘুরিয়ে দেখানো হবে, যাতে তাঁরা ভবিষ্যৎ বাংলার একটি উজ্জ্বল চিত্র দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারেন।
এ-সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার অগ্রজ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে কে কে যাবেন তার তালিকা নির্ধারণ করতে দিলেন। তো, তাঁর দেয়া তালিকা অনুসারে প্রচার দপ্তর থেকে আমন্ত্রণলিপি এল, তাতে দেশ পত্রিকার লেখক গোষ্ঠীর সকলেই ছিলেন, যেমন বিমল মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীসহ অনেকে। শুধু সাগরময় ঘোষ বাদ।
গোপাল ভৌমিক ফোনে তারাশঙ্কর বাবুকে বিষয়টা নিয়ে বলতেই তিনি বললেন, ‘সাগর কি লেখক? সে কি এক লাইন কখনও কিছু লিখেছে যে তাকে লেখক শ্রেণীভুক্ত করে আমন্ত্রণ জানাতে হবে?’
এর কিছুদিন পরেই ক্ষিতীশ সরকার ‘জলসা’ পত্রিকার জন্য সাগরময় ঘোষের লেখা চাইলেন। টানা তিন বছর মাসের পর মাস ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ নামের এই লেখাগুলো ছেপে ক্ষিতীশবাবু তাঁকে লেখক বানিয়ে দিলেন।
একদিন কানাইলাল সরকার হঠাৎ এসে বললেন, জলসা পত্রিকার লেখাগুলো তিনি বই করে ছাপবেন। এভাবে সাগরময় ঘোষ গ্রন্থকারও হয়ে গেলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘লেখক হবার দুর্মতি আমার হয়েছিল শ্রদ্ধেয় শিল্পীস্রষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্ররোচনায়।’
মাইনে পাবার দিন বাদল বলল, শুনেছি, ব্রজদাকে মাস্টার অব গুল খেতাব দেবার জন্যে রাষ্ট্রপতির কাছে রেকমেন্ডেশন গেছে। আমাদের ইচ্ছে তার আগে আপনাকে ওই খেতাবে ভূষিত করব। এ কথায় ভোম্বলদা ছি ছি করে বললেন, ব্রজদা হল বাঙালির গৌরব। ওই সব কাগজী সম্মান আর খেতাব ওর দরকার নেই। তবে ওর চেয়েও বড় দাদা আছে যিনি পরোক্ষভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।
তারপর তিনি বলা শুরু করলেন।
প্রবাদ আছে বার্লিনের রাস্তায় বেরিয়ে তুমি যদি একটা ঢিল ছোড়, হয় সেটা ডগ-এর গায়ে লাগবে নয় তো ডক্টরেটের। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ভারতবর্ষে ডক্টরেটের ছড়াছড়ি ছিল না। সেই যুগে ভারতবর্ষেরই এক কৃতী সন্তান ‘গুল’ বিষয়ে থিসিস তৈরি করে প্রায় সবখানেই সাবমিট করলেন, যথারীতি সবাই তা ফেরত পাঠাল। কেউ মর্যাদা দিতে রাজি নয়। হতাশায় তিনি পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলতে গিয়েও ফেললেন না। এরপর তিনি ফ্রান্সের সরবর্ণে থিসিস পাঠিয়ে দিলেন।
হঠাৎ একমাস পর কেবল এসে হাজির, তাকে প্যারিস যেতে হবে। সেখানে তারা গুল নিয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য তাকে ডক্টরেট দিলেন। আর ওদের প্রেসিডেন্ট সভাপতির ভাষণে তাকে ‘মশিঁয়ে গুল ফ্রাসেঁ’ উপাধি দিলেন। এরপর ইউরোপজুড়ে বিরাট হইচই।
গুল বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিটি ইতালির ‘সিনর গুলোনিনি’, জার্মানির ‘হের ফন গুলেন্বের্গ’, রাশিয়ায় ’কমরেড গুলেন্কভ’, চীনে ‘গুলিয়াৎসেন’, জাপানে ‘গুলে কাওয়া’, তিব্বতে ’গুল্চেন্ লামা’ ইরানে ’গুলেন শাহ্’ উপাধি পেলেন। এসময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের টনক নড়ল। তারা কেবিনেট মিটিং ডাকলেন। এক ভারতীয় প্রজাকে যে সম্মান দেয়া হচ্ছে তাতে ভারত কে তো আর পরাধীন রাখা চলে না। সদস্যরাও রাজি হলেন।
এদিকে নেহেরুকে কৃষ্ণমেনন স্বাধীনতা প্রাপ্তির গোপন খবরটি জানান। সঙ্গে সঙ্গে তার দেশে ডাক পড়ল। তারপর মাদ্রাজবাসী তাকে পেয়ে বললেন, ’আপনি অগাধ গুণসম্পন্নই শুধু নহেন, অপার গুলসমুদ্রে আপনি নির্ভীক নাবিক।’
এসব কথা শেষ করে ভোম্বলদা যখন থামলেন, শ্রোতারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন। অথচ পুরো গল্পে একবারও ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করেননি। জানতে চাইতেই বললেন, ওঁর নাম ডক্টর গুজারিলাল নন্দা, আর বই আকারে থিসিসটির নাম ‘ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা।’
এমন সময় বেয়ারা এসে খবর দিল ক্যাশিয়ারবাবু মাইনে নেবার জন্যে ডাকছেন। ভোম্বলদা উঠতেই বাদল বলল, গুল্মাবতার উপাধিটা ব্রজদাকে না দিয়ে আপনাকেই দেব।
ভোম্বলদার অসাধারণ গুল ছাড়াও বইটিতে উঠে এসেছে চাঁদপুরের ব্রাহ্মণের গল্প, লেখক জরাসন্ধকে (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) আবিষ্কারের গল্প। জেলজীবন নিয়ে লেখা ওই রচনাগুলো আমরা ’লৌহকপাট’ নামে চিনি। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, কয়েদীদের কাছ থেকে শোনা কাহিনী, আর সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনে সুনিপুণভাবে লেখা হয়েছিল বইটি। যা পরে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। সাগরময় ঘোষ তা না পড়েই চার-পাঁচ মাস ফেলে রেখেছিলেন।
এছাড়াও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাটানো স্মৃতি ও তাঁর রসবোধের কিছু নমুনাও আছে বইটিতে। যারা এখনও পড়েন নি, তারা পড়ে দেখতে পারেন হীরের নাকছাবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করা এই বইটি পড়তে পড়তেই বোঝা যাবে সম্পাদক সাগরময় ঘোষ লেখক হিসেবে কেমন ছিলেন।
নাজমুস সাকিব রহমান
৩০ আগস্ট, ২০১৬
হীরের নাকছাবিও অন্যান্য, দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত