আমার এক বন্ধু স্কুলের রি-ইউনিউনে যোগ দেয়ার জন্যে ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। সে জন্যে সকালবেলা তাকে বললাম, ‘চলেন, একসাথে অনুষ্ঠানে যাই।’ কিছুক্ষণ পর সে যখন এলো, আমার চোখ কপালে ওঠে গেল। কারণ, ওর প্যান্টের রঙ। কোলকাতার নায়কদের এরকম প্যান্ট পড়ে নাচানাচি করতে দেখা যায়। সমস্যা হল, আমার এই বন্ধুটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আমি আগ্রহ থেকেই প্রশ্ন করলাম, ‘এই বিশেষ প্যান্ট কোথায় পেলেন?’ তিনি মুখ অনেকটা গম্ভীর করে জানালেন, ‘হাসবেন না। এটি ঢাকা থেকে খরিদ করেছি, আর চট্টগ্রামে এসে ইস্ত্রি করেছি।’
অর্ধযুগ আগে স্কুল ছেড়েছি। মনে আছে, গতবছর আমরা যখন রি-ইউনিয়ন করার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম— তখন অনেকের প্রচণ্ড অসহযোগিতা পেয়েছি। সে সময় একজনের দুঃখ পাওয়া দেখে বলেছিলাম, ‘চল, ছাত্র ইউনিউন করি। ওদের মিছিলে যে পরিমাণ মানুষ হয়, আমার রিইউনিউনে বোধ হয়— তাও হবে না।’
এটা ঠিক যে ওই সময় আমরা সফল হইনি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে— আমাদের হাজী মুহম্মদ মহসীন সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৪৩ বছরের ইতিহাসে ছাড়া ছাড়া ভাবে অনেক অনুষ্ঠান হলেও এটিই প্রথম রি-ইউনিউন। যদ্দুর জানি, এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।
যা হোক, রেজিস্ট্রেশনের কাজ শেষ হওয়ার পর আমি একটি টি-শার্ট পেলাম। সেই টি-শার্টের বুকের ওপর স্কুলের যে লোগোটি আছে, তার বানান দেখে চমকে গেলাম। সেখানে যে মহসীন থেকে হসীন হয়ে আছে!
আমরা ভেতরে ঢোকার আগে থেকেই বক্তৃতা পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি হতাশ দৃষ্টিতে অনুষ্ঠানের ব্যানারের দিকে তাকালাম। সেখানে নানারকম ক্যাটাগরিতে (প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি) সাত-আটজন মানুষ নাম লেখা— যারা বক্তব্য দেবেন। শুক্রবার বন্ধের দিন। আমি নিশ্চিত— কাজ না থাকায় অনেকে চলে এসেছেন। সুযোগ পেলে বক্তব্য রাখতে সমস্যা কোথায়? আমি অবশ্য একজনের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। কারণ, তাঁর কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাকিদের বক্তব্য শুনি নি কিংবা শোনার সৌভাগ্য হয় নি। কারণ, মানসিকভাবে আমি টাকা খরচ করে বিষ কিনতে রাজি আছি, কিন্তু বক্তৃতা শুনতে রাজি নই।
ঘণ্টাখানেক পর আলোচনা শেষ হয়েছে। আমাদের অনুষ্ঠানে প্রচুর প্রাক্তন শিক্ষক এসেছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। সত্যিকার অর্থে ওঁদের হাসিমুখ দেখতে ভাল লাগছিল খুব। তবে, একজনকে দেখলাম, এক ছাত্রকে বলছেন, ‘তোরা যে আমাকে এখানে আনলি, ব্যানারে আমার নাম নেই। ভাল করে বক্তৃতাও দিতে দিলি না। ষ্টেজে বসিয়ে রাখলি। এ'রকম হলে আমাকে দাওয়াত দেয়ার তো প্রয়োজন ছিল না।’ সেই ছাত্রটি তাঁকে জানাল, সে আয়োজনের সঙ্গে জড়িত না। তা-ই তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দৃশ্যটি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
২.
আশেপাশে সব পরিচিত মুখ। চাইলে সবার সঙ্গেই কথা বলা যায়। যেদিকে তাকাই— ছোটভাই- বড়ভাই এর অভাব নেই। হঠাৎ একজন জানাল, ‘জানিস, ১৯৮৩ ব্যাচ হতেও একজন এসেছে।’ এই খবর শোনার পর যে দীর্ঘশ্বাসটা খানিক আগে জমেছিল— তা পুরোপুরি মুছে গেল। আসলে, দু'হাজারের আগের ব্যাচের কাউকে আমরা আশা করি নি। তবুও, অনেকেই এসেছেন। নস্টালজিয়ার টানেই যে এসেছেন— তা তো নিশ্চিত করেই বলা যায়। এবার একটি গল্প বলিঃ
ভদ্রলোকের চোখ তীক্ষ্ণ, কিন্তু খানিকটা উচ্ছ্বাস এসে সে-ই তীক্ষ্ণতা বারবার ঢেকে দিচ্ছে। আমাদের রি-ইউনিয়নে তার ব্যাচের আর কেউ আসে নি। তাতেও সমস্যা হচ্ছে না, তিনি একা'ই সবার প্রতিনিধিত্ব করছেন। স্কুল জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি থাকে প্রবাসে, চাইলেও আসতে পারেন নি। তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে সে-ই বন্ধুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন। আর কিছুক্ষণ পর পর ক্যামেরাটি একেকজনের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, সবাইকেই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
একসময় আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেটি দশ ব্যাচের। কত ছোট আমাদের!’
বাক্যটি বলার সময় তার গলা ধরে এলো।
তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘ও আমাদের রি-ইউনিউন দেখবে বলে আজ কাজে যায়নি। ভাইয়াকে হ্যালো বল।’
আমি হ্যালো বললাম।
তারপর তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। হয়তো নতুন কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। উনার চলে যাওয়া দেখে আমি মনে মনে বললাম, ‘আহারে।’
জুমার নামাজ ও খাওয়া দাওয়ার পর শেষ দুপুরে শুরু হল গানের আসর। বেশ কয়েকটি ব্যান্ড পারফর্ম করবে। কিছুক্ষণ পর এখানকার শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যান্ড ষ্টেজে ওঠে প্রথম গানটি করল। গান শেষ হতে পারল না— আমার এক বন্ধু বলল, ‘লাস্ট গানটা অনেক ভাল গেয়েছ ভাইয়া, এবার ষ্টেজ থেকে নেমে যাও।’
আমরা হাসিতে ফেটে পড়লাম। সবার গান শোনা হয় নি। তবে, এটুকু বুঝতে পারলাম— এখন নতুন ব্যান্ডগুলো ট্রিবিউট দিতে খুব পছন্দ করে। এদেরই একজন জেমসের সুলতানা বিবিয়ানা গানটি করছিল। আমার মনে হল, জেমস ভাই এই কাভারটি শুনলে মানহানির মামলা করতেন।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপকদের একজন খুব চিৎকার করছিল। তখন একজন আমাকে বলল, ‘এই জুনিয়র ছেলেটি এরকম করছে কেন?’ আমি এক স্যারের নাম নিয়ে বললাম, ‘ওই স্যারের মার খায় নি তো তাই। আমরা চলে যাবার পরেই উনি বদলি হয়ে যা-ন।’ এমন উত্তর শুনে সে হাসতে লাগল। আমার এখনও মনে আছে— ওই স্যার মারার আগে জিজ্ঞেস করতেন, ‘ভেতরে কিছু পরেছিস?’ উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে বলতেন, ‘তাহলে প্যান্ট খুলে টেবিলের নিচে মাথা দে।’
তারপর বলার কিছু থাকতো না, যা থাকতো— তা শুধুই দেখার। আ-হা! কত বিষাদ-সুন্দর দিন কাটিয়েছি স্কুলে! বালকবেলার স্মৃতিগুলো নেড়েচেড়ে রি-ইউনিউন অবশেষে শেষ হয়ে যায়। তবুও, সব কী আর শেষ হয়।?
২৬ আগস্ট, ২০১৬