কলেজ জীবন শেষ হয়ে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, অথচ লাইব্রেরীতে যাওয়া হয় নি। অনেকদিন ধরেই চিন্তা করছিলাম লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়বো। অবশ্য শুধু বই পড়ার জন্য এই যাত্রা নয়; একটি ক্ষুদ্র কারণও আছে। বাসা থেকে বেরোলেই যানবাহনের হর্ন, আর মানুষের চেঁচামেচিতে দু’কান ব্যথা করে। লাইব্রেরীর পরিবেশ শান্ত, কোলাহলমুক্ত; তাই কিছুটা স্বস্তির খোঁজ করা।
আজ পড়লাম ‘বিভূতিবীথিকা’ নামের একটি বই। নাম শুনেই নিশ্চয়ই লেখকের নাম বুঝতে পারছেন? হ্যাঁ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙলা সাহিত্যের অনেক বড় একজন লেখক। একটি উপন্যাস, কিছু ছোটগল্প, ছ’টি প্রবন্ধ, কিছু চিঠি, দুটি ভাষণ আর কয়েকটি শিশুতোষ লেখা নিয়েই ‘বিভূতিবীথিকা।’ অনেক পুরনো বই, পাতাগুলো প্রায় ছেঁড়া, মলিন। ওঁর ছোটগল্প বা উপন্যাসের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও প্রবন্ধ পড়া হয় নি।
প্রথম প্রবন্ধের নাম― ‘আমার লেখা’, চলিত ভাষায় রচিত অতি সুখপাঠ্য গদ্য। লেখক হওয়াকে তিনি মনে করছেন অদ্ভুত ঘটনা হিসেবে। যেমন কারো কারো নিজের জীবনের অতি তুচ্ছতম অভিজ্ঞতাও অপূর্ব মনে হয়। এটা না হলে নাকি লেখক জাতটার’ই সৃষ্টি হতো না।
কি সরল ভাবে গভীর কথাটা বলে ফেললেন!
কীভাবে একজন লেখকের সৃষ্টি হয়― লেখক তারও বর্ণনা করেছেন। নিছক কথার কথা নয়; যাকে বলা যায় চিন্তার অনেক গভীরে গিয়ে সামান্য কয়েকটি শব্দের আঁচড়ে গভীরতা প্রকাশ।
‘এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাঁদের চোখে কল্পনা সব সময়েই মোহ অঞ্জন মাখিয়ে দিয়ে রেখেছে। অতি সাধারণ পাখির অতি সাধারণ সুরও তাদের মনে আনন্দের ঢেউ তোলে, অস্তদিগন্তের রক্তমেঘস্তুপ স্বপ্ন জাগায়, আবার হয়ত তারা অতি দুঃখে ভেঙে পড়ে। এরাই হয় লেখক, কবি, সাহিত্যিক। এরা জীবনের সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক। এক যুগের দুঃখ বেদনা আশা আনন্দ অন্য যুগে পৌঁছে দিয়ে যায়।’
পরের দুটো লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। এই দুটো মূলত ভাষণ। সেখানে তিনি বলেছেন,― ‘রবীন্দ্রনাথের দানের তুলনা নেই, জীবনের এমন কোনো দিকও নেই, যেদিকে তাঁর দৃষ্টি পড়েনি, যার সমন্ধে তিনি কিছু না কিছু নতুন কথা শুনিয়েচেন।’ কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর একটি লেখায় বালক কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি বর্ণনা করেছিলেন। তখন নাকি তাঁর মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের বয়স সতেরো আঠারো। বিভূতি সে-ই লেখাটির কিছুটা উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রবি ঠাকুরের বয়স তখন মাত্র পনেরো বছর। নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন তাঁর দাদার বন্ধু। এই গল্পটি রবীন্দ্রজীবনীতেও আছে। এছাড়াও সাহিত্যও বাস্তবতা, আর সাহিত্যও সমাজকে নিয়ে দুটো প্রবন্ধ আছে।
লেখক নিজেও অনেকগুলো ছোটগল্প লিখেছেন, তাই হয়তো ছোটগল্পের ইতিহাসের সঙ্গে পাঠকের সামান্য পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি বরং আমার মতো করে বলছি। বইটি তো আমার কাছে নেই; লাইব্রেরীতেই রেখে এসেছি। তবুও মনে হয় না তথ্যের এদিক ওদিক হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসি সাহিত্যে ‘Conte’ নামের এক শ্রেণীর ‘কথা’ বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিল, মোপাসাঁ, ব্যালজাক, আলফাঁস দোদে প্রভৃতি কথা লেখকের স্পর্শে। এটি ফরাসি থেকে ক্রমেই ইউরোপে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সেদিকে দৃষ্টি দিতেই বুঝলেন, এটি উনবিংশ শতাব্দীর অদ্ভুত সৃষ্টি। ফরাসি ‘Conte’ বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন লেখকের হাতে একটু একটু অদল বদল হতে হতে মূল কৌশল সকলেই বুঝে নিলেন। এই মূল কৌশল হল ‘মুহূর্ত’ ; এটিই ছোটগল্পের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছোটগল্প বের হয় ভারতী পত্রিকায়; ১২৮৪ সালে। গল্পের নাম ‘ভিখারিনী।’
কঠিন কথা হয়ে যাচ্ছে না ? তাহলে, এবার একটু সহজ কথা বলি। বইটিতে বিভুতির বেশ কিছু চিঠি আছে। বেশিরভাগ চিঠিই স্ত্রী’কে পাঠানোর জন্যই লেখা হয়েছিল। এর ভেতর দুটো চিঠি বিয়ে না করার আগে হবু স্ত্রীকে পাঠানো। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,― ‘ …/ ধুমকেতু দেখার সুযোগ ঘটে নি। ছেলেবেলায় হ্যালির ধুমকেতু উঠেছিল শুনেচি মাত্র, কিন্তু তখন খুব ছেলে মানুষ, পাড়া গাঁয়ে থাকি― কেউ দেখায়নি। সে আজ ত্রিশ বছর আগের কথা। তোমার ভালো লাগবে বলে তোমার ফরমাস মতো তো ধুমকেতু উঠতে পারে না। এখনও ৪৫ বছর দেরী আছে আবার সেটা ফিরে আসতে। ততদিন অপেক্ষা কর। এখন তোমার বয়স ১৫ তো, ১৫্+৪৫=৬০ বছর যখন তোমার বয়স হবে …’
চিঠির ভাষা অদ্ভুত না ? আরও অদ্ভুত একটি বাক্য লিখেছেন এই চিঠির শেষের দিকে, সংযুক্তি দিয়ে।
‘… তোমার জন্য ভালো কাঁচের চুড়ি নিয়ে যাবো। হাতের মাপ দরকার হবে না ? সুতো দিয়ে হাতের মাপ পাঠালে কেমন হয়? এসব কারবার কখনও করিনি, জানা নেই মোটেই। তাই পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করো লক্ষ্মীটি। …’
এতো সাধারণ বাক্যটি পড়লে কি কেউ কখনও বুঝবে, এই চিঠি স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকের লেখা? আমার মনে হয় না। তাঁর ভেতর চিরকালই একজন ‘অপু’ ছিল। স্বস্তির খোঁজে বের হয়ে আমি মনে হয় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি। সে অনুভুতি থাকতেই লেখাটা লিখে ফেললাম। অনেককিছুই লেখার ছিল, লেখা হল না।
*৩০.০৩.২০১৬