ভীষণ প্রিয় অভ্যাসও বোধ হয় একসময় আর প্রিয় থাকে না, কিছুটা বিরক্তিকর লাগে। কেন লাগে তা জানি না। আমার নিজের ক্ষেত্রেও ইদানীং এমন কিছু প্রভাব পড়ছে। সিগারেট টানতে ভালো লাগছে না। কিছুদিন ধরেই অভ্যাসটি বন্ধ করে রেখেছি। কতো দিন রাখব জানি না। অথচ আগে রাতের বেলা সিগারেটের প্যাকেট ভর্তি না থাকলে অস্থিরতায় ঘুমাতে পারতাম না। পুরো রাত কীভাবে কাটবে?— এই চিন্তাতেই রাত ফুরিয়ে ভোর হয়ে যেতো। আর এখন ভালো লাগছে না! কোন মানে হয়?
ভালো না লাগার তালিকা মনে হয় দিন দিন বাড়ছে। নাকি বয়সের সাথেই বাড়ে? আচ্ছা, বয়স কি কিছু হয়েছে? ‘তেইশ’ কি খুব বেশি বয়স? জানিনা। যেমন, মাথায় অনেকগুলো গল্প নিয়ে ঘুরছি, কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে না। মাথার ভেতর পুরো তৈরি না হলে, লিখতে ইচ্ছে করে না। লেখালেখির জন্য স্বতঃস্ফূর্ততা জরুরী। অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলি। এই মুহূর্তে এসব নিয়ে পড়ছি, ভাবছি। তাই সেই অনুভূতিগুলো ভাগ করা যেতে পারে।
এক সময় প্রচুর গান শুনতাম। নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করার জন্য প্রথম যে কাজটি করতে হয়, তা হল— ব্যান্ডের গান শোনা। আমিও শুনেছি। দেশ বিদেশের কতো গান শুনেছি আর কতো গান শুনিনি। শোনার কি আর শেষ আছে! রক-ব্লুজ-সাইকোডলিক-অলটারনেটিভ কতো রকমের গান শুনেছি আর কান নষ্ট করেছি। এখন নয়েজ নিতে পারি না, কেন জানি কান ব্যথা করে। তাই নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করার চেষ্টাও শেষ! বাকি রইল রবীন্দ্রসঙ্গীত। অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের দু’একটি ভালো দিক আছে। প্রথমটি হল, এখানে চিৎকার নেই। দ্বিতীয়টি হল, মস্তিস্ক উত্তেজিত করার মতো উপাদান এর সুরের ভেতর নেই। তাই মাথা ঠাণ্ডা— আর মন নির্ভার থাকে।
গান ছাড়া কি মানুষ থাকতে পারে? আমার মনে হয় না। কেননা সবকিছুরই তো একটা সুর আছে। তাছাড়া জীবন একটা গতিময় ব্যাপার, অনেকটা পৃথিবীর মতো। সেও সূর্যের চারপাশে একটা ছন্দ নিয়ে ঘুরছে। গান বা সুরেও কিন্তু গতিকে অনুভব করা যায়। তাই মনে হয়, যখনই গতি হারিয়ে ফেলব, তখনই মৃত্যু। বিভূতিভূষণ-এর কথা বলি— আমার অতি প্রিয় লেখকদের একজন। গজেন্দ্রকুমার মিত্র তাঁর ‘দেবযান’ উপন্যাসটির ভুমিকায় লিখেছিলেন, ‘ছেলেমেয়েদের অটোগ্রাফের খাতায় চিরদিন তিনি একই মটো লিখে গেছেন—‘গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু।”
যারা পথের পাঁচালী পড়েছেন, বা যাঁদের এখনো মনে আছে, তাঁদের বলছি— ওই উপন্যাসের শেষ হয়েছে সেই অসীম পথের ইঙ্গিত দিয়ে— ‘পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে … দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে ….. চল এগিয়ে যাই।’ মানুষ হবার একটা অসুবিধা আছে। আমরা সহজেই এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যেতে পারি। আমিও গান থেকে উপন্যাসের কাছাকাছি চলে এলাম। যাক, আবার গানের দিকে ফিরে যাই।
এ’সময়ের গান আমাকে টানছে না। আমি শুধু শোনার জন্য শুনি না। ভাবার জন্য শুনি, লেখার জন্য শুনি। আমাকে টানছে না। ভালো সুর কিছু কিছু হয় কিন্তু ভাবে এসে ভালো লাগে না। বাঙলা গানের প্রাণ হল বাণী, তারপর সুর। আর এখন, সময়ের জোয়ার অনুযায়ি সুর করা হয়। তাই আমার কাছে পেছনে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কবিগুরু ‘সঙ্গীতও ভাব’ প্রবন্ধে সেইসব সঙ্গীতব্যক্তিত্বদের প্রতি বলেছেন, ‘কী কী সুর কিরূপে বিন্যাস করিলে কী কী ভাব প্রকাশ করে, আর কেনই বা তাহা প্রকাশ করে, তাহার বিজ্ঞান অনুসন্ধান করুন।’ লেখাটির এক পর্যায়ে তিনি এও বলেছেন, ‘এমন দিন কি আসিবে না যেদিন সকলে বলিবেন, “বাঃ, কী সুন্দর ভাব!’
ওই গদ্য থেকে সামান্য একটু তুলে দিই। লোভ সামলাতে পারছি না বলেই কিছুটা তুলে দিচ্ছি।
‘আমাদের সংগীত যখন জীবন্ত ছিল, তখন ভাবের প্রতি যেরূপ মনোযোগ দেওয়া হইত সেরূপ মনোযোগ আর কোনো দেশের সংগীতে দেওয়া হয় কি না সন্দেহ। আমাদের দেশে যখন বিভিন্ন ঋতু ও বিভিন্ন সময়ের ভাবের সহিত মিলাইয়া বিভিন্ন রাগরাগিণী রচনা করা হইত, যখন আমাদের রাগরাগিণীর বিভিন্ন ভাবব্যঞ্জক চিত্র পর্যন্ত ছিল, তখন স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, আমাদের দেশে রাগরাগিণী ভাবের সেবাতেই নিযুক্ত ছিল। সে দিন গিয়াছে। কিন্তু আবার কি আসিবে না!’
গানের ভেতর ভাবের অনুপস্থিতি তাঁকেও পীড়া দিয়েছে। আমি কোন ছার! আমিতো গানের কিছুই বুঝি না। যাকে বলে শুধু মাত্র শ্রোতা। আমাকে এতো কথা মানায় না। তাই এই প্রসঙ্গ বাদ থাকুক। অন্য কথা বলি। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে পারস্য ভ্রমণ করেছিলেন, তা নিয়ে তাঁর চমৎকার স্মৃতিগদ্য থাকবে, সেটাই বরং স্বাভাবিক। তো তিনি সেই গদ্যের এক জায়গায় লিখেছেন—
‘সাধুতা ও সন্ন্যাস যদি নিজের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য হয় তা হলে সাজ পরবার বা নাম নেবার দরকার নেই, এমন-কি, নিলে ক্ষতির কারণ আছে; যদি অন্যের জন্য হয় তা হলে যথোচিত পরীক্ষা দেওয়া উচিত। ধর্মকে যদি জীবিকা, এমন-কি লোকমান্যতার বিষয় করা যায়, যদি বিশেষ বেশ বা বিশেষ ব্যবহারের দ্বারা ধার্মিকতার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তবে সেই বিজ্ঞাপনের সত্যতা বিচার করবার অধিকার আত্মসম্মানের জন্য সমাজের গ্রহণ করা কর্তব্য এ কথা মানতেই হবে।’
সেই সময়ের এই চিন্তাভাবনা তো এখনো সমসাময়িক। আমার ধারণা, আমরা অনেকেই নিয়মিত এ’রকম চিন্তা করি। রবীন্দ্রনাথকে বোধ হয় এই জন্যই চিরসবুজ বলা হয়। যতই দিন যাচ্ছে, এই মানুষটাকে যেন একটু একটু করে আবিস্কার করছি আর ভীষণ রকম অবাক হচ্ছি। একটা মানুষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এতো সমসাময়িক কীভাবে হতে পারেন?
একটা ব্যাপার নিয়ে প্রায়ই ভাবি, তা হল— আমরা যারা এইসময়ে লেখালেখি করার চেষ্টা করছি, তাঁদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে চলি। আমি নিজেও এই দলের ভেতর। স্কুলজীবনে পাঠ্যবইয়ে যেসব লেখকদের সাথে পরিচিত হয়েছি, আমরা তাঁদের অনেকটাই এড়িয়ে চলি। এই মুহূর্তে প্রায়ই মনে হয়, ইশ! যদি ভালো মতো রবীন্দ্রনাথ পড়া যেতো! তাহলে আর কিছু লাগত না। সাহিত্যের অনেকটাই এই একটা লোক থেকেই জানা যেতো। যা হোক, এই এড়িয়ে চলার উত্তর পাইনি। সবকিছুর উত্তর হয় না। নজরুলকেও আমরা পছন্দ করি, কিন্তু নজরুল পাঠে আমাদের অনীহা অনেকখানি বেশি। অস্বীকার করার উপায় নেই। এসবের উত্তর না থাকার একটা কারণ হতে পারে, আমরা হয়তো তাঁদের পুরনো ভাবছি। কিন্তু ‘ভাব’ কি কখনো পুরনো হয়? আমার মনে হয় না।
বর্তমান সময়ে রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রভক্তদের বাইরে যতোটুকু চর্চা করা হয়, তার অনেকটাই হুমায়ূন আহমেদের কারণে— এ’রকম বলা যায়। তিনি তাঁর গান থেকে পঙক্তি তুলে নিয়ে উপন্যাসের নাম দিতেন। এখন, এটা একটা চর্চায় গিয়ে দাড়িয়েছে। এই বইমেলাতেও দেখেছি, অনেকে বইয়ের নাম দিচ্ছেন— রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি থেকে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। ‘প্রেম করেছি বেশ করেছি’র চেয়ে রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি ভালো। যা হোক, একটি ভয়ংকর কথা বলি। অনেকেই হয়তো জানেন না। হুমায়ূন আহমেদ একবার নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানকে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি লাইন আমার মনোযোগ দিয়ে পড়া।’
এভাবে ক’জন মানুষ বলতে পারেন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁকে যদি বনবাসে দেয়া হয়, তিনি অবশ্যই ‘গীতবিতান’ নিয়ে বনবাসে যাবেন। অথচ রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে তাঁর পরিচিতি প্রথমদিকে কিংবদন্তীতুল্য ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর, ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’— নামে একটি বই বেরিয়েছে। ওঁর সমস্ত সাক্ষাৎকার ওখানে পাওয়া যাবে। তো সেখানে এক সাক্ষাৎকারে ওঁকে বলতে দেখলাম, ‘আমি অন্ততপক্ষে একহাজার রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্থ বলতে পারব।‘
যা হোক, রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণের লেখা থেকেই সামান্য তুলে দিয়ে এই লেখাটি থেকেই শেষ করি। এটা নিয়ে সামান্য চিন্তা করা যেতে পারে, কারণ কথাটা আমার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
‘ভারতবর্ষে কোটি কোটি মানুষ পুরো পরিমাণ অন্ন পায় না। অভুক্তশরীর বংশানুক্রমে অন্তরে-বাহিরে সকল রকম শত্রুকে মাশুল দিয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত। মনে প্রাণে সাধনা করে তবেই সম্ভব হয় সিদ্ধি, কিন্তু আমাদের মন যদি-বা থাকে প্রাণ কই? উপবাসে ক্লান্তপ্রাণ শরীর কাজ ফাঁকি না দিয়ে থাকতে পারে না, সেই ফাঁকি সমস্ত জাতের মজ্জায় ঢুকে তাকে মারতে থাকে। আজ পশ্চিম মহাদেশে অন্নাভাবের সমস্যা মেটাবার দুশ্চিন্তায় রাজকোষ থেকে টাকা ঢেলে দিচ্ছে। কেননা, পর্যাপ্ত অন্নের জোরেই সভ্যতার আন্তরিক বাহ্যিক সব রকম কল পুরোদমে চলে। আমাদের দেশে সেই অন্নের চিন্তা ব্যক্তিগত, সে চিন্তার শুধু যে জোর নেই তা নয়, সে বাধাগ্রস্ত। ওদের দেশে সে চিন্তা রাষ্ট্রগত, সে দিকে সমস্ত জাতির সাধনার পথ স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত, এমন-কি, নিষ্ঠুর অন্যায়ের সাহায্য নিতেও দ্বিধা নেই। ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তার দৃষ্টি হতে আমরা বহু দূরে, তাই আমাদের পক্ষে শাসন যত অজস্র সুলভ অশন তত নয়।’
পাদটীকাঃ এই লেখাটি অনেকের ভালো লাগবে না, আমি জানি। তাহলে কেন লিখলাম? তার দুটি কারণ আছে। প্রথমত, গত কয়েকদিন কিছু লেখা হয়নি। অভ্যাস হারিয়ে ফেলার ভয়—যাকে বলে। সেই ভয় থেকে আর দ্বিতীয়ত, সেদিন আড্ডায় একজন কবি বন্ধুকে বললাম, ‘দেখিস, বেঁচে থাকলে আমিও বলবো, রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি লাইন আমারও পড়া।’ এবার বলি, উদ্দেশ্যটা কেন প্রকাশ করলাম। কারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে।’
১৭.০৩.২০১৬