পরীক্ষার হলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সবচে বড় আতংক হল, কর্তব্যরত শিক্ষক-শিক্ষিকা। জানি— কথাটার সাথে সবাই একমত হবেন না, আমিও ঠিক একমত নই। অথচ হাসানের ধারণা তাই। পরীক্ষার হলে ওঁদের আচরণ দ্যাখলে হাসানের নাকি প্রায়ই মনে হয়, পরীক্ষা দিতে আসলাম নাকি যুদ্ধ করতে? কর্তব্য পালনের নামে ওঁরা চিৎকার করেন আর নিয়মিত অস্থিরতা সৃষ্টি করেন। যার কারণে শান্তিমতো পরীক্ষা দেয়া যায় না। হাসান আমার সবচে প্রিয় বন্ধু। আমরা প্রায় ছায়ার মতো একসাথে ঘোরাঘুরি করি। ওর কথার সাথে একমত না হওয়াতে সে বোধ হয় দুঃখ পেলো। সে জন্যই বোধ হয় হাসান নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগল।
'বুঝলি, একদিন পরীক্ষা দিচ্ছি। হঠাৎ প্রাকৃতিক ডাক পড়ল। প্রচণ্ড প্রেশার। স্যারকে বললাম, স্যার বাথরুমে যাবো। তিনি বললেন, যাও, তবে দু'মিনিটের ভেতর আসবে। আমি ওনাকে বললাম, স্যার আমি ম্যাগি নুডুলস রান্না করতে যাচ্ছি না। দু'মিনিটে ম্যাগি বানানো যায়। প্রেশার কমানো যায় না। ওনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন উত্তর দেওয়াতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমি ইংরেজি কমোড ব্যবহার করতে পারি না। বাংলা কমোড ব্যবহারের জন্য যেতে হবে নিচের তলায়। যেতে আসতে অনেকক্ষণ লাগবে। সবচে অদ্ভুত ব্যাপার কি জানিস? পরীক্ষা শুরু'র সময় তাঁরা প্রায়ই বলেন, একঘণ্টার আগে বাথরুমে যাওয়া যাবে না। পায়খানা প্রশ্রাব ঘড়ি মেনে আসে, তুই কি কখনো এমন শুনেছিস ?' আমি বললাম, 'না। তবে তাঁরা মনে হয়, পায়খানা প্রশ্রাব ঘড়ি মেনেই করেন। ওঁদের জন্য অসম্ভব কিছু-না।'
হাসানের কথা ওড়িয়ে দেবার কারণেই বোধ হয়, সে দ্বিতীয় গল্প বলা শুরু করল। 'আমাদের এক ম্যাডাম পরীক্ষার হলে ফেসবুক ব্যবহার করেন। তাঁর চিৎকারিত কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয়, কাঁচাবাজারে এসেছি। পরীক্ষার হলে নয়।' আমি বললাম, 'তিনি বোধ হয় নিজেকে লতা মুঙ্গেশকর মনে করেন।' হাসান আগুন চোখে তাকিয়ে বলল, 'তিনি যদি লতা মুঙ্গেশকর হন, তাহলে আমাদের আরেক ম্যাডাম আনারকলি।' ওর উত্তর শুনে প্রচণ্ড হাসি এলো। হাসবো কি-না বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, 'আনারকলি কি করেন?' সে বলল, 'তাঁর প্রধান কাজ হল, সহকর্মীকে নতুন জামা পড়তে দ্যাখলেই জিজ্ঞেস করা, 'ম্যাডাম, এটা কোথা থেকে কিনেছেন? ব্লকটা তো খুবই সুন্দর।''
সেলফোন প্রসঙ্গটা হয়তো ঠিক। প্রায় শিক্ষক-শিক্ষিকা'ই পরীক্ষার হলে সেলফোন বন্ধ করেন না। কেন করেন না, কে জানে! তবে আমার নিজের কাছে সেলফোন একটা শিকলের মতো মনে হয়। যত দূরেই যাই, কল করেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। নিজেকে তখন শিকলে বাঁধা মনে হয়।
আমি ওকে বললাম, 'বাথরুমে যেতে না দেবার কারণটা মনে হয় নকল, তাই না?' সে বলল, 'হ্যাঁ। তবে সবাই তো নকল করে না। হাজারে কয়েকজন। কয়েকজনের জন্য সবাইকে কষ্ট দেয়া কি 'শিক্ষা'র ভেতর পড়ে?' আমি জবাব দিলাম না। এর উত্তর আমার কাছে নেই। সে বলল, 'আমি একবার বাথরুম থেকে এসে হলে ঢুকেছি। ঢোকার পর এক শিক্ষক বলল, বাথরুমে নকল করতে গিয়েছিলে? ওঁর কথা শুনে আমি চুল পোড়া গন্ধ পেলাম। মানে আমার কিছু একটা জ্বলে গেলো। তুই তো জানিস, আমি জীবনেও নকল করিনি। তাই প্রচণ্ড গাঁ'য়ে লাগল কথাটা। আমি বললাম, স্যার আপনার যদি মনে'ই হয়, বাথরুমে সবাই নকল করতে যায়, তাহলে আপনি এখানে গার্ড দিচ্ছেন কেন? বাথরুমে গিয়ে গার্ড দেন।' এই জবাবের পর ওই স্যারের কি অবস্থা হয়েছিল ভেবে বিমর্ষিত বোধ করলাম। না, ওর এভাবে বলা ঠিক হয়নি। আমি বললাম, 'ওঁরা সম্মানী মানুষ। এঁদের এভাবে বলতে নেই।'
এতো কিছু বলার পরেও টলছি না দ্যাখে হাসান আমাকে বলল,' আরেকটা কাহিনী বলি। শোন। ইথিকসে্র পরীক্ষা চলছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। পাস-ফেলের জন্য নয়। যে শিক্ষকটি আমাদের এই বিষয় পড়ান, তিনি অসাধারণ একজন শিক্ষক। তাই ওই বিষয়ের পরীক্ষাতে প্রশ্ন বুঝতে পারাটাই সবচে বড় পরীক্ষা। আমাদের অনেকে পারছে না। অলস বসে আছে। এমন সময় থ্রিপল ই'র এক শিক্ষক(!) বললেন, 'হেডলাইন, রিপোর্ট এসব লিখে দাও। আমিও একসময় পত্র-পত্রিকায় লিখেছি।' ইথিক্স কি এমন তাচ্ছিল্যের বিষয়, যে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একজন মানুষ অহেতুক জ্ঞান দিবে? শিক্ষক মানেই যে সব জেনে বসে আছে, তা তো নয়। তাঁরা তো মহামানব না। তাঁদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। এটা মনে রাখলে কি হয়? আমি ওনাকে বললাম, 'স্যার, আপনি যেসব পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন, ওইসব নিশ্চই বন্ধ হয়ে গেছে। তাই না?' হলের ছেলেমেয়েরা হেসে ওঠল। সে জন্য তিনি কিছু বলতে পারলেন না।'
কারো সেন্স অব হিউমার যে এতো মারাত্মক হতে পারে, তা আমার কখনো চিন্তায়ও আসেনি। আমাদের দেশে হিউমারওয়ালা লোকেরা প্রচুর বিপদে পড়ে। এঁদের একটা সমস্যা আছে, এরা আরেকজনের ক্ষুদ্রতা নিতে পারে না। এই নিতে না পারার কারণে অনেকের শত্রু হয়ে যায়। হাসানের কথা যে পুরোপুরি অসত্য তা-ও নয়। আমি ওকে বললাম, 'যাঁদের নিয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে এসব বলছিস, পৃথিবীতে তাঁদের চাইতে ক্ষমতাবান কোন পেশা নেই। এই পেশার লোকজন চাইলে এক মুহূর্তেই একটা মানুষকে বদলে দিতে পারেন। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এতো বেশি ক্ষমতা যাঁদের দেয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকেই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না। জানেন না বলেই নিজেদের ক্ষুদ্রতা প্রকাশ করেন।'
* ১০ই মার্চ
নাজমুস সাকিব রহমান
( পাদটীকাঃ এই গল্প অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে নেবেন। কেন নেবেন জানি না। বাংলাদেশের মানুষ দায় নেবার সময় আগ্রহী না হলেও ব্যক্তিগতভাবে নেওয়াতে আগ্রহী। তাঁদের বলছি— সবাই একরকম না। কেউ কেউ আলাদা। এখানে একরকম’দের গল্প বলা হয়েছে। ধন্যবাদ। )