তাপস'দা খেয়ালী মানুষ। কিছুদিন ধরেই দেখা হলে বলে, 'বুঝলি একদিন হুট করে শিলং যাবো, যাবি নাকি?' মেঘালয়ের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ না থাকলেও তাপস'দার প্রতি আকর্ষণ আছে। তার চলাফেরা আমার ভালো লাগে। ভেবেচিন্তে কিছু করেন না। মুখে যা আসে তাই বলেন। যা হোক, কোন এক অদ্ভুত দিনে তার সঙ্গে মেঘালয়ের পথ ধরলাম।
এটি যে প্রথম বিদেশ সফর তা না, এর আগে আমরা নেপাল গিয়েছিলাম। নেপাল দেখে তাপস'দা বলেছিল, 'শালা’রা তো বাড়ি বানাতেই সব প্রতিভা নষ্ট করে দিছে, ধুর! এটা কোন দেশ!'— এমন মন্তব্য শুনে আমার নেপালের প্রতি বিতৃষ্ণা আসে নি, আমি অবাক হয়েছি। তাপস'দা কিছুদিন আগেও অন্য গালি দিতো, এখন শালা ছাড়া কথাই বলে না।
সিলেট পৌঁছে তামাবিল বর্ডারের দিকে এগিয়ে গেলাম। মনে হয়, দেড় ঘণ্টার মতো লেগেছিল। পথের দু'পাশে সবুজ পাহাড়। কিছু কিছু সৌন্দর্য মানুষকে বদলে দেয়। একটু আগে হাসন রাজার দেশে ছিলাম, এখন নেই। সে কারণেই বোধ হয় হাসন রাজার গান ছেড়ে তাপস'দা পাহাড়ি গান ধরেছেন। তামাবিল বর্ডার সম্পর্কে বলা যায়, এটি বোধ হয় বাংলাদেশের সবচে সহজ বর্ডার। তাই তেমন কোন ঝামেলা হয় নি।
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং— ওদের বাড়িঘর দেখতে নেপাল-ভুটানের মতোই। পথে আমরা অনেকগুলো চার্চ দেখলাম। তাপস'দার খুব ইচ্ছে চার্চে ঢুকবেন। ওনি উদারমনা মানুষ। তাই তিনি ঢুকলেন, আর বের হয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, 'সাকিব, ওদের নিয়ম কানুন ভালো রে, অযু করার সিস্টেম নেই।'
বলাবাহুল্য, ওখানে খ্রিস্টান ধর্মের লোকজন অনেক।
শিলং পিকে ওঠলে শহরটা ভালোভাবে দেখা যায়। এটার উচ্চতা ১৯৬৫ মিটার। উমিয়াম লেকও খুব চমৎকার। ওটা দেখে হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাসের নাম মনে পড়ল— 'দীঘির জলে কার ছায়া গো ?।' এছাড়া ভুতের গুহা! দুর্দান্ত কিন্তু খুবই সরু। অনেক কষ্ট করলে হয়তো গুহার এদিকে ঢুকে ওদিকে বের হওয়া যায়। আমার কষ্ট করার কোন ইচ্ছে নেই, তাপস'দা ও যেন কষ্ট না করে— সে জন্য বললাম, এটা আমাদের দেশে হলে এটার নাম হতো— 'হাগু গুহা।' আমাদের লোকজন সেখানে ঢুকে পায়খানা করতো, এটা নিশ্চিত।
চেরাপুঞ্জি অদ্ভুত একটা জায়গা। চোখের সামনেই মেঘ, কিন্তু ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। পাহাড়ের ওই উঁচুতে মেঘের জন্য কিছুই দেখা যায় না। পায়ের নিচে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে দেখে নিজেকে আউলা মনে হল। আমি গান ধরলাম, 'আউলা কে বানাইলো রে, নাজমুস সাকিব’রে আউলা— কে বানাইলো রে ?' হাসন রাজা অবশ্য বাউলা হয়েছিলেন। আমি মেঘ স্পর্শ করতে পারি নি, হাসন রাজা কি সেই বাউলকে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন ? জানি না। তবে ইতিহাস জানাচ্ছে, চেরাপুঞ্জি সবচে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা।
এরপর কোরবান ব্রিজ (অমিতাভ বচ্চন এখানে কোরবান সিনেমার শুটিং করেছিলেন। ভাগ্য ভালো কোরবানের শুটিং করেছিলেন, অন্য কিছু করেন নি।), সেভেন সিস্টার ফলস, নআলিকাই ফলস, লেডী হায়দারি পার্ক ইত্যাদি। শোনা যায়, লেডী হায়দারি আসামের এক গভর্নরের স্ত্রী ছিলেন। তাপস'দা বলল, 'আমাদের দেশে হলে বউয়ের নামে পার্কের নাম দিতো না।' আমি বললাম, আমাদের দেশে বউয়ের কথা শুনলে বা মানলে মানুষ তাকে বউপাগলা বলে। পুরুষ মানুষ এটা ঠিক নিতে পারে না। তাই নাম দেয় না।
লাইভ রুট ব্রিজ খুব সুন্দর। অনেক গাছের শিকড় জড়িয়ে একটা ব্রিজের মতো হয়েছে। নিচে ঝর্না, মাটি ধুয়ে নেমে গেছে। দেখতে খুব অদ্ভুত দ্যাখায়। আমার মনে হচ্ছিল, টারজানের কথা। কল্পনায় দেখলাম, তাপস’দা সেই টারজান। গাছের শিকড়ে বসে শরীরে কলাপাতা মুড়িয়ে পাহাড় শাসন করছেন। ফেরার পথে একটি ঝর্না দেখেছিলাম, এলিফেন্টফলস। এতো শ্রোতধারা অন্য কোন ফলসে দেখিনি।
কীভাবে যেন তিনদিনের ভ্রমণটা শেষ হয়ে গেলো! সময় মনে হয় এমনই, হুট করে ফুরিয়ে যায়। ফেরার পথে তাপসদাকে বললাম, 'মেঘালয় কেমন লাগল?', ওনি তখন আনমনা অবস্থায় আছেন। হঠাৎ করেই বলে ফেললেন—‘মেঘাকে আমার এমনিতেই ভালো লাগে, শুধু শালাটাই সমস্যা।’
* ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
[ সামুতে কেউ একজন শিলং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার আছে, কিন্তু ওদিকটায় যাওয়া হয়নি। তাই তাঁর সে অভিজ্ঞতাকে পুজি করেই আমার গল্প ফাঁদা। মাঝে মাঝে গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, গল্প নিজেই চলে আসে। এটি তেমন একটি লেখা। আশাকরি ভালো লাগবে। — নাজমুস সাকিব রহমান ]