মনটা ভাল যাচ্ছিল না অনেক দিন। বিষাদময় সময় কাটছিল আমার। তখনই জানলাম আমার অফিসের কয়েক কলিগ দার্জিলিং যাবে। নিজে মনে মনে ঠিক করলাম আমি ও যাব। হয়তো ভাল লাগবে। তাদের সাথে শেয়ার করলাম। জেনে তারাও বেশ খুশি হল। অবশেষে একটা সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করলাম আমরা। শুরু হয়ে গেল আমাদের ৫ কলিগের ( হাসান আসকারি, নিয়াজ মোহাম্মদ খান, আমি আজিজ, হারুন অর রশিদ মুকুল ও সজিব) দার্জিলিং যাবার প্রস্তুতি। বন্ধুরা এবার শেয়ার করব আপনারা কিভাবে যাবেন ও দার্জিলিং ভ্রমনের টুকিটাকি বিষয়।
দার্জিলিং যাবার আগের কাজঃ
শুরু হয়ে গেল পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে আলাপ আলোচনা। কিন্তু আমাদের ৫ জনেরই পাসপোর্ট আছে। খোজ খবর নিলাম যাবার ব্যাপারে, ইন্ডিয়ান ভিসার জন্য আবেদন করলাম। মনে রাখবেন এখন অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদন করতে গেলে যদি আপনি দালাল মাধ্যম যান তবে হয়ত তাড়াতাড়ি সিরিয়াল পেতে পারেন এ ছাড়াও এভাবেই পাওয়া যায়। সিরিয়াল পাওয়ার পর অনলাইনে পূরণ করা ফরম নিয়ে ভিসা অফিসে যেতে হয়। ফরম জমা দেবার সময় ৪০০ টাকা লাগে। ফরম জমা দেবার সময় বলে দেয় কবে ভিসার জন্য যেতে হবে। এভাবে ভিসা নিতে হয়।
ভিসা পাওয়ার পর দার্জিলিং যেতে হলে বাস বা এয়ার দু ভাবেই যাওয়া যায়। ও হ্যাঁ ভুলে গেছি, আপনি কিভাবে যাবেন তা ভিসা আবেদনের সময় ফরমে উল্লেখ করতে হয়। আমরা অবশ্য বাসে গিয়েছিলাম।
আমরা বুড়িমাড়ি হয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে যাবার জন্য ৫০০ টাকা ভ্রমন ট্যাক্স দিতে হবে তা ঢাকা থেকে সোনালি ব্যাংকে জমা দিয়ে গেলে সবচেয়ে ভাল।না হলে আপনাকে কাস্টমসে ঝামেলা পোহাতে হবে।
যাতায়াতঃ
আপনি যদি বাসে বুড়িমাড়ি হয়ে যান তবে কমলাপুর থেকে শ্যামলী বাসে যেতে পারেন। এটা শিলিগুড়ি পর্যন্ত যায়। আমাদের কাছে ভালই লেগেছে। এ ছাড়া এস আর ট্র্যাভেলস্ যায়, এটা বুড়িমাড়ি পর্যন্ত। শ্যামলী গাড়ি কমলাপুর থেকে রাত সাড়ে আটটা (৮।৩০) বাজে ছেড়ে কল্যাণপুর হয়ে যায় এবং ভোর চারটা থেকে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছে। তারপর সকাল নয়টায় বাংলাদেশি ইমিগ্রেশন চালু হয়, সেখানে আপনাকে আপনার ডাটা চেক ও ছবি তোলার কাজ গুলো করতে হয় এবার আপনি বাংলাদেশ বর্ডার পার হবেন তখন আপনাকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা (ঘুষ) সম্মানী দিতে হয় এটা দুই বর্ডার মিলে খায়। আপনি এখন ভারতে ঢুকে গেলেন । সেখানে আপনার লাগেজ বা অন্যান্য বেগ চেক হবে তারপর ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে আবার আপনাকে এন্ট্রি সহ ছবি তুলতে হবে। আপনি সেখান থেকে ডলার ভাঙিয়ে নিবেন এখানে রেট একটু বেশি পাওয়া যায়। সেখান থেকে আবার শ্যামলী পরিবহনে শিলিগুড়ি, সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। আপনি চাইলে শিলিগুড়ি একরাত থাকতে পারেন। মনোরঞ্জনের জন্য মাল্টিপ্লেক্সে একটা মুভি দেখতে পারেন। মনের ক্লান্তি চলে যাবে। এছাড়া যারা ড্রিঙ্কস করার একটু অভ্যাস আছে তারা যেতে পারেন -বার, ডিস্কু ও নাইট পার্টিতে।
আর না থাকলে, শিলিগুড়ি থেকে সুমু জিপে যাবেন স্বপ্নের দার্জিলিং। ভাড়া পড়বে জন প্রতি ১৮০ রুপি থেকে ২৫০ রুপি, আর সবচেয়ে ভাল হয় ৭-৯ জনের একটা টীম হলে। কারন ঐ সুমু জীপের ভাড়া পিক সিজনে ১৫০০-২০০০ রুপি আর অফ পিক সিজনে ১২০০-১৩৫০ রুপি। এটা কারন ভেদে। আমি ২০১৪ সালের কথা বলছি। যদি আপনারা কম মানুষ হন তাতে সমস্যা নাই কারন শিলিগুড়ি নামার পর অনেক মানুষ পাবেন আপনার মত পার্টনার খুঁজছে, নিয়ে নিবেন
যাবার সময় আপনি দুটি রোডে যেতে পারেন একটি মিরিখ হয়ে আরেকটি রুহিনি হয়ে। মিরিখ হয়ে গেলে সময় বেশি লাগবে। তবে প্রকৃতির অপরূপ সুন্দরতম দৃশ্য আপনি উপভোগ করতে পারবেন মিরিখ হয়ে গেলে। কারন মিরিখ এরিয়া টা যেমন বড়। তেমন যেতে ডান পাশটা পাহাড় আর বাম পাশটা ঢালু। ঢালুর সাইটে সুন্দর ডিজাইনের গড়া বাড়ি গুলো আপনার মন কাড়বে। আপনাকে শিহরিত করবে পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে।
যেতে যেতে যখন আপনি মিরিখ লেকে পৌঁছবেন তখন বিকাল যদি আপনি দুপুরে শিলিগুড়ি থেকে রওনা দেন। আপনি পুলকিত হবেন বিকালের মুহূর্তটা। কি অসাধারণ দৃশ্য। খাবার জন্য অনেক টং দোকান আছে। বিভিন্ন জাতের পিঠা খেতে পারেন, এছাড়া চাওমিন নামে এক ধরনের খাবার (নুডুলস্ এর মত) বেশ প্রসিদ্ধ। বিকালের মুহূর্তটা কাটাতে পারেন, সাথে আপনি কেনা কাটাও করতে পারেন।পাশেই বাজার আছে। তার জন্য আপনাকে রাত কাটাতে হবে মিরিখে।
মিরিখ থেকে যাবার পথে আপনি দেখবেন পাহাড়ে রাতের দার্জিলিং এর চোখ জুড়িয়ে যাওয়া অপরূপ দৃশ্য। জোনাকির আলোর মত মিটিমিটি জ্বলছে পাহাড়ের পাদদেশে থাকেথাকে সাজানো বাড়ি গুলো।
আর যদি আপনি রুহিনি হয়ে যান তবে বিকালেই পৌঁছে যাবেন আপনার স্বপ্নের দার্জিলিং শহরে। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বের হতে পারেন। মুভি দেখতে পারেন, অথবা মলে গিয়ে কেনাকাটা করতে পারেন।
বেড়ানোঃ
ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ২১টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে।
১) পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ‘ঘুম’
২) সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা।
৩) পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা-স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি।
৪) ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ।
৫) বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি বাঘ Snow Lupard খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা।
৬) পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’।
৭) সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ।
৮) কেবল কারে করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।
৯) হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎক্ষণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পানের অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
১০) যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেলপ্ সেন্টার।
১১) সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত মনোরম খেলাধুলার স্থান দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম।
১২) নেপালি জাতির স্বাক্ষর বহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম।
১৩) পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল
১৪) ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কাউন্সিল হাউস ‘লাল কুঠির’
১৫) অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন খ্যাত ‘আভা আর্ট গ্যালারি’।
১৬) শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির ‘দিরদাহাম টেম্পল’।
১৭) পাথর কেটে তৈরি ‘রক গার্ডেন’
১৮) রোমাঞ্চিত করবে মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা ‘কাঞ্চন-জংঘা’
১৯) বিশুদ্ধ পানির অবিরাম ঝর্ণাধারা ‘ভিক্টোরিয়া ফলস্’
২০)মেঘের দেশে বসবাসরত এক সুসভ্য জাতির সংস্কৃতি।
২১) অসাধারণ সুন্দর কল্পনার মত প্রাকৃতিক ঝর্না রক গার্ডেন।
কেনাকাটাঃ
আপনি দার্জিলিং থেকে বেশ কিছু কেনাকাটা করতে পারেন। প্রিয়জনের জন্য আনতে পারেন কাশ্মেরি শাল (১৫০-১৭৫০), শীতের জামা(২০০-৩৭৫০), থ্রি পিস (৮৫০-৫৫০০), শো পিস(৫০-৭০০), আনতে পারেন বন্ধু বান্ধবের জন্য কিংবা প্রিয়জনদের মন খুশি করতে বিভিন্ন ধরনের গিফট আইটেম দাম (২০-৩০০) রুপি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৫:০৭