এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক।
সবাই রেটিনা,উদ্ভাস,থ্রি ডক্টরস,ইউসিসি নাম না জানা আরো কত কোচিং সেন্টারে দৌঁড়াচ্ছে।
কিন্তু আমি আজ সপ্তাহ খানিক শুয়ে।
.
ইচ্ছা ছিল পরীক্ষা শেষে,সপ্তাহ খানিক ঘুরে তারপর কোচিং-এ ভর্তি হবো।কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে বিছানায় শুয়ে আছি,কাহিনী এখানে শেষ হলেও পারত কিন্তু হয়নি।
.
সেদিন ভরা বর্ষায় ছাতা নিতে ভুলে গেছিলাম,উপায় না পেয়ে এক টং দোকানের নিচে দাঁড়ালাম।বৃষ্টি আমার মন টা সবসময় বিষিয়ে দেয়,আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।হঠাৎ নীলুর কথা মনে পড়ল,মনে পড়তেই মুখে একটা হাসি চলে এসো।ও আমার সাথে এক গুচ্ছ কমদ হাতে ভিজতে চাই,যদিও ও জানে আমার বৃষ্টি পছন্দ না।পাগল মেয়ে একটা।
এমন আকাশ-পাতালই ভাবছিলাম,কোথা হতে এক ট্রাক এসে মেরে দিলো এবং তারপর আর কিছু মনে নেই।চোখ খুলেছি হাসপাতাল বেডে।আমি নাকি ৭২ ঘণ্টা বাদে চোখ খুললাম।
মা পাশে বসে আছে,অবাক হয়নি অবশ্য এতে আমি।
মনে হলো,মাথায় আঘাত পেয়েছি।তার বেশি কিছুই তো মনে হলো না,হালকা কাঁটা ছেঁড়া ছাড়া।
.
সপ্তাহ খানিক বাদেয় রিলিজ করে দিলো,শরীর প্রচন্ড দূর্বল।হুইল চেয়ার আনা হয়েছে।ঘরের ভেতরে কদাচিৎ চলাফেরার জন্য। মায়ের কাছে শুনতে ইচ্ছে করছিলো নীলু আমার খোঁজে এসেছিলো কি না?ঘরে গেলাম, খাটে শুয়ে দিলো।মায়ের কাছে মোবাইল চাইলাম,আহ!মা কি সুন্দর করে মোবাইল টা দিলো।
মোবাইল অফ,হয়ত চার্জ নেই।আম্মু চার্জে লাগিয়ে দিলো। আমি চোখ বুঝলাম,ঘণ্টা খানিক বাদে চোখ খুলল,দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
আম্মুকে বলতেই আম্মু মোবাইল দিয়ে গেলো,নীলুকে ফোন দিতে ইচ্ছে করলেও ফোন দেওয়া হলো না।মাথা যন্ত্রণা শুরু হলো,প্রচন্ডভাবে।
.
বাড়ি এসেছি আজ দু'দিন,মাকে বললাম বন্ধু বা ক্লাসমেট কেউ আসলে।কদিন পরে আসতে বলো,আপাতত দেখা করব না কারন ওদের দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যাবে।
.
তৃতীয় দিন,বিকালে ঘুম থেকে চোখ খুলতেই দেখি নীলু বসে আছে।
চোখদুটো ওর অদ্ভুতভাবে ছলছল করছে,আমি মুচকি হাসলাম।
নীলু কিছুই বলছে না,খুব কষ্ট পেলে বা খারাপ লাগলে ও চুপ হয়ে যায়।
স্বাভাবিক হতে সময় দিলাম,মিনিট পাঁচেক বাদে বলল,"কতবার বলেছি সাবধানে চলাফেরা করতে?নিজের খেয়াল নিতে?"
আমি নির্বিকারচিত্তে বললাম,"আরে বাবা,কিছু হয়নি।কয়দিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।"
নীলু তো কাঁদে না কখনো,তবে আজ তার চোখে জল দেখলাম।
মাথাযন্ত্রণা আবার শুলো হলো,নীলুকে যেতে বললাম আপাতত।কোনো কথা না বলে আস্তে উঠে চলে গেলো।
.
তারপর দু'দিন আর আসেনি,আমি এখন হাঁটতে পারছি।মাকে বলে ছাদে চেয়ার রাখার ব্যবস্থা করেছি।খুব অবসাদ লাগলে,আস্তে আস্তে ওখানে যায়।
.
তবে আজকাল বাড়ি কেমন একটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
বাবাকে কোচিং এর কথা বলায় বলল,"আগে সুস্থ হও।পরীক্ষা সামনের বছর দিলেও চলবে।"
আজকাল বাড়ির সবকিছুই আমার পছন্দমতো হচ্ছে,অস্বাভাবিক ব্যাপার।
.
আজ বাসার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে,ওয়ার-ড্রব এর উপর একটা ফাইল।আমার হসপিটালে,কি মনে করে খুললাম।না খুললেই হয়ত ভালো করতাম,আঘাতের ফলে মস্তিষ্কে ড্যামেজ হয়েছে।ফলে রক্তক্ষরণ দেখা দিচ্ছে,আস্তে আস্তে এটা নাকি বৃদ্ধি পাবে।আর আমাকে অজানার পথে ধাবিত করবে।
(এবার বুঝলাম,বাড়ির পরিস্থিতি থমথমে হওয়ার কারণ,নীলুর চোখে পানির কারন,আমার ইচ্ছামতো সব হওয়ার কারন)
.
মাকে ডেকে বললাম যে,আমি জানি।মা কাঁদছে,আমি বললাম,"মা,ভেবো না।সবাইকে একদিন যেতে হবে।"
ওর পরের দিন নীলু এলো।আজ বেশ হাসি হাসি ভাব,মা হয়ত বলে দিয়েছে যে আমি সবটা জানি যেন সে স্বাভাবিক থাকে।
বললাম,"নীলু,তোমার সাথে কদম হাতে মনে হয় আমার ভেজা কপালে নেই।"বলেই হাসলাম,মেয়েটা অদ্ভুতভাবে চোয়াল শক্ত করে নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসি দিলো।
"শুভ্র,ওটা ব্যাপার না।তুমি ঠিক হলেই আমরা ভিজব।"
এবার আমি জোরে জোরে হাসলাম।
(খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,নীলু ভুলে যাও।নতুন করে সব শুরু করো।কিন্তু আমি পারিনি,হয়ত প্রচন্ড রকমের ভালবাসি তাই।কিন্তু আমার বলা উচিত।)
নীলু স্বাভাবিক দু-একটা কথা বলে চলে গেলো।
.
মাথা যন্ত্রণা বাড়ছে দিন দিন,মাঝখানে হাসপাতে ভর্তি ছিলাম দিন তিনেক।তারপর বাড়ি এসে ছাদে বসে থাকি।আজকাল আমার সবই ভালো লাগে,এমনকি বৃষ্টিও।হয়ত বেশিদিন নেই এসব কপালে,তাই সবই ভালো লাগছে।মা খুব কান্নাকাটি করে,আমি বলার মতো কিছুই পাই না।
.
ব্যালকনি থেকে নদী দেখা যায় আমাদের,নীলু পাশের চেয়ারে বসা।নিজ হাতে কফি বানিয়ে নিয়ে বসেছে পাশে।কথা বলছে না,আজ প্রথম খুব ভয় করছে ওর হাত ধরতে।ও নিজেও বাড়িয়ে দিচ্ছে না,শরীর আমার অনেক শুকায় গেছে।মাথা টাক করা,হয়ত অদ্ভুত রকমের বাজে দেখতে হয়ে গেছি।নীলুকে আজও বলতে পারলাম না কথাগুলো,তবে নীলু হয়ত বুঝতে পেরেছে।
.
আজকাল কিছুই খেতে পারি না।যাই খাই বমি হয়ে যাচ্ছে।
ইশশশ!কত ইচ্ছে ছিলাম এবার কাশফুলে হাঁটব নীলুর হাত ধরে,কিন্তু বিধাতা হয়ত সেটা চান না।
.
শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে,গোধূলি দেখি না কতদিন,আমার কুয়াশাবিলাস করা হবে না আর হয়ত,ইশশ!কত বই পড়ার বাকি ছিল,নদীর ধারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো হবে না আর,এই শুভ্র বলে হয়ত নীলু আর ডাকবে না।
.
মৃত্যু সন্নিকটে,শুধু বেঁচে থাকার প্রহর গুনে চলেছি:।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৮ সকাল ৮:৩৫