বর্তমান আন্দোলনে সহযোগিতা হতে পারে বিবেচনায় গণআদালতের রায় এখানে তুলে ধরলাম। যদিও এটা অনেকেই জানেন।
বাংলাদেশ গণআদালত-১, ঢাকা
গণআদালতের সদস্যবৃন্দ
১• জাহানার ইমাম চেয়ারম্যান, গণআদালত
২• গাজীউল হক এডভোকেট সদস্য, গণআদালত
৩• ড. আহমদ শরীফ ”
৪• স্থপতি মাজহারুল ইসলাম খান ”
৫• ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ”
৬• ফয়েজ আহমদ ”
৭• কবীর চৌধুরী ”
৮• কলিম শরাফী ”
৯• মওলানা আবদুল আউয়াল ”
১০• লে. কর্নেল(অব.) কাজী নূরউজ্জামান ”
১১• লে. কর্নেল(অব.) আবু ওসমান চৌধুরী ”
১২• ব্যারিস্টার শওকত আলী খান ”
গণআদালত মোকদ্দমা নং ১/১৯৯২
বাংলাদেশের গণমানুষ, অভিযোগকারী
বনাম
জনাব গোলাম আযম
পিতাঃ মওলানা গোলাম কবির
সাকিনঃ পাকিস্তান
বর্তমান অবস্থানঃ ১১৯, কাজী অফিস লেন, মগবাজার, থানাঃ রমনা, জেলা - ঢাকা,
অভিযুক্ত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জনপদ ধ্বংস, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধজনক কাজে মদদকারী এবং স্বয়ং শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে রাজাকার বাহিনী গঠন করার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জনপদ ধ্বংস, নারী ধর্ষণের ন্যায় জঘন্য অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, প্ররোচিতকরণ, বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে, নিজস্ব বাহিনী আলবদর, আলশামসকে দিয়ে তাদের হত্যা করানো এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে বিদেশী শত্রুর চর হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অপরাধ সংঘটন করার অভিযোগে অভিযুক্ত।
অভিযোগকারীর পক্ষ কৌসুলিবৃন্দঃ
১। এ্যাডভোকেট জেড আই পান্না
২। এ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন বাবুল
৩। এ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম রেখা
অভিযুক্তের পক্ষে গণআদালত নিযুক্তীয় কৌসুলিঃ
১। এ্যাডভোকেট মোঃ নজরুল ইসলাম
রায়
বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কবি সৈয়দ শামসুল হক, ড. আনিসুজ্জামানের উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে অত্র গণআদালতে এই মোকদ্দমার সূত্রপাত :
অভিযোগের বিবরণে প্রকাশ, জনাব গোলাম আযম, পিতা মরহুম মওলানা গোলাম কবির একজন পাকিস্তানি নাগরিক। বহু দিন ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশে, ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অন্তর্গত মগবাজার এলাকায় ১১৯ নম্বর কাজী অফিস লেনে অবস্থানরত। গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে হানাদার তথা দখলদার বাহিনীকে সর্বতোভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ত্রিশ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা এবং দুই লক্ষ নারী অপহরণ ও ধর্ষণের সহায়তা করে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। উক্ত সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস গঠন করে তাদের এবং তার অনুগত রাজাকার বাহিনী দিয়ে সাহায্য করে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক দুই লক্ষ নারীকে অপহরণ, ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানিতে প্ররোচিত করে হীন অপরাধ সংঘটন করিয়েছেন, উক্ত সময়ে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তার অনুগত আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করিয়েছেন এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে গণহত্যার উসকানি, প্ররোচনা এবং সাহায্য দান করেছেন এবং তার উক্ত কার্যের ফলে বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু নিহত হয়েছে, উক্ত সময়ে অভিযুক্ত গোলাম আযম তার গঠিত ও অনুগত আলবদর, আলশামস বাহিনী ও শান্তি কমিটি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরীহ পরিবার পরিজনের ওপর সশস্ত্র ধ্বংসযজ্ঞ অভিযান পরিচালনা করে, উক্ত সময়ে অভিযুক্ত গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ানোর লক্ষ্যে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে এবং এই দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং আজো এই দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে বিকৃত করা এবং শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রসমূহ ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে, অভিযুক্ত গোলাম আযম ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করার জন্যে বিদেশী দেশসমূহকে প্ররোচিত করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, অভিযুক্ত গোলাম আযম বিদেশী নাগরিক হয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংবিধানবিরোধী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচার চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরে অভিযুক্ত গোলাম আযম তার নিজস্ব অনুগত বাহিনী আলবদর, আলশামস এবং রাজাকার বাহিনী দিয়ে লুটতরাজ এবং নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের ঘরে অগ্নিসংযোগ করে অসংখ্য জনপদ ধ্বংস করেছে, ১৯৭১ সালে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যা করে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ সংঘটন করে।
উপরোক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১২(বার)টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রচনা করা হয়। গণআদালতের বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অনুপস্থিত থাকায় ন্যায়বিচারের জন্যে অভিযুক্ত গোলাম আযমের পক্ষে এ্যাডভোকেট মোঃ নজরুল ইসলামকে গণআদালত কৌসুলি নিযুক্ত করেন এবং গোলাম আযমের পক্ষে নিযুক্ত কৌসুলিকে অভিযোগসমূহ পাঠ করে শোনান। অভিযুক্ত গোলাম আযমের পক্ষে নিযুক্ত কৌসুলি তার মক্কেল গোলাম আযমকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।
বিচার্য বিষয়সমূহ "
১। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে ত্রিশ লক্ষ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা এবং দু’লক্ষ নারী অপহরণ ও ধর্ষণের সহায়তা করে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন?
২। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি ২৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আলবদর, আলশামস গঠন করে এবং তার অনুগত রাজাকার বাহিনী দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে ২ লক্ষ নারীকে অপহরণ এবং ধর্ষণে ও শ্লীলতাহানিজনক অপরাধ সংঘঠন করতে সাহায্য করেছেন?
৩। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি পাকিস্তানি বাহিনীকে গণহত্যার উসকানি এবং প্ররোচনা দান করেছেন?
৪। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরীহ পরিবার-পরিজনের উপর সশস্ত্র ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছেন?
৫। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ানোর লক্ষে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মের নামে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছেন এবং এই দেশের শিল্প-সংসস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন?
৬। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি তার নিজস্ব অনুগত বাহিনী আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনী দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করে অসংখ্য জনপদ ধ্বংস করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন?
৭। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত করে এই দেশে ১৯৭১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে তার অনুগত বাহিনী আলবদর ও আলশামসকে দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটন করেছেন?
৮। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করেছেন?
৯। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচারকার্য চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন?
১০। অভিযুক্ত গোলাম আযম কি স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তার অনুগত আলবদর, আলশামস বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন?
বিচার্য বিষয়সমূহের পর্যালোচনা এবং সিদ্ধান্ত
বিচারের সুবিধার্থে সমস্ত বিচার্য বিষয়সমূহ এক সঙ্গে পর্যালোচনা করা হল। গণআদালত এই মোকদ্দমায় ফরিয়াদি পক্ষ মোকাদ্দমা প্রদানের জন্য মোট ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ফরিয়াদি পক্ষের ১ নং সাক্ষী ড. আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি তাঁর লিখিত জবানবন্দিতে বলেন যে, অভিযুক্ত গোলাম আযম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনী, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন এবং তার প্ররোচনায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আলবদর এবং আলশামস বাহিনী হত্যা করে। এই সাক্ষী তার সাক্ষ্যে আরো বলেন যে, অভিযুক্ত গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র এবং প্রবন্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল, সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছে। ড. আনিসুজ্জামান মৌখিক সাক্ষ্যের সমর্থনে গোলাম আযমের মুদ্রিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি, প্রচারপত্র এবং প্রবন্ধসমূহ দলিলরূপে গণআদালতে দাখিল ও প্রমাণ করেন। (গণআদালত প্রদর্শনী পর্ব)
ফরিয়াদি পড়্গের দ্বিতীয় সাড়্গী ড. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি তাঁর লিখিত জবানবন্দিতে ১ নং সাড়্গী ড. আনিসুজ্জামানের বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করেন। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীকে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং জনপদ ধ্বংসের কাজে সহায়তা দান করেছে। ড. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে দৈনিক পূর্বদেশ ৫ এপ্রিল, ২৭ জুন (গণআদালত প্রদর্শনী ‘খ’ পর্ব), দৈনিক পাকিস্তেন ৭ এপ্রিল, ১৬ এপ্রিল, ২০ এপ্রিল, ১৬ আগস্ট, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২৪ নভেম্বর, ১৯ জুন, ১৯ আগস্ট, ১৭ সেপ্টেম্বর সংখ্যাসমূহ (গণআদালত প্রদর্শনী ‘গ’ পর্ব), দৈনিক আজাদ ২১ জুন (গণআদালত প্রদর্শণী ‘ঘ’ পর্ব) দৈনিক সংগ্রাম ১৭ জুন, ২১ জুন, ২২ জুন (গণআদালত প্রদর্শনী ‘ঙ’ পর্ব) আদালতে প্রমাণ করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ৩ নং সাক্ষী ড. মেঘনা গুহ ঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিষয়ের শিক্ষক। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে ড. আনিসুজ্জামান এবং ড. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীরকে পুরোপুরি সমর্থন করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ৪ নং সাক্ষী সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, কবি এবং নাট্যকার। তিনি তাঁর লিখিত জবানবন্দিতে ফরিয়াদি পক্ষের ১ ও ২ নং সাক্ষীকে পুরোপুরি সমর্থন করেন। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে সক্রিয় ছিল। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে আরো বলেন, গোলাম আযম পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করে, মদদ দান করে বাঙালি জাতিকে সর্ব অর্থে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নীলনকশা প্রণয়ন করে। তিনি আরো বলেন, গোলাম আযম বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের যে ধর্ম বিশ্বাস সেই ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন করেছে এবং লাখ লাখ মানুষের প্রাণ হরণ করেছে। তিনি গোলাম আযম কর্তৃক কার্যকে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর অমানবিক পৈশাচিক কাজের সঙ্গে তুলনা করেন। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সাক্ষ্যে ১/২/৩ নং সাক্ষীকে পুরোপুরি সমর্থন করেন এবং বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্যে গোলাম আযমকে দায়ী করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ৫ নং সাক্ষী শাহরিয়ার কবির একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসীবাদ অনুসরণের অভিযোগ উত্থাপন করেন। গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ফ্যাসিস্ট দর্শনের অনুসারী হয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে নানাভাবে প্ররোচিত করে গণহত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। গোলাম আযমের পক্ষে তাকে জেরা করা হয় কিন্তু তিনি তাঁর সাক্ষ্যে অবিচল থাকেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ৬ নং সাক্ষী বেগম মুশতারী শফী বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখিকা। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে ফরিয়াদি বাদে ১-৫ নং সাক্ষীদের বক্তবের পুরোপুরি সমর্থন করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ৭ নং সাক্ষী সাইদুর রহমান শহীদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমানের পুত্র। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামীর দলীয় লোকগণ তার বাবা, মা এবং তিন বড় ভাইকে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। তিনি তার জবানবন্দিতে গোলাম আযমকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। অভিযুক্ত গোলাম আযমের জন্যে নিযুক্ত কৌসুলি তাকে কোনো জেরা করেন নি।
ফরিয়াদি পক্ষের ৮ নং সাক্ষী অমিতাভ কায়সার, বিখ্যাত সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের পুত্র। সে তার জবানবন্দিতে ডিসেম্বর মাসে ১৪ তারিখে গোলাম আযমের নেতৃত্বে পরিচালিত আলবদর বাহিনীর সদস্য এ বি এম খালেক মজুমদার (বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য) এবং আরো কয়েক সশস্ত্র আলবদর শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাড়ি থেকে হত্যার উদ্দেশ্যে বলপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। শহীদুল্লাহ কায়সার আর ফিরে আসেন নি। পিতার অপহরণ এবং হত্যার জন্যে অমিতাভ কায়সার গোলাম আযমকে এবং তার নেতৃত্বে গঠিত আলবদর বাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামী দলকে দায়ী করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ৯ নং সাক্ষী হামিদা বানু মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোলাম আযমের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতায় এই দেশে দু’লক্ষ্ নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানি করে এই সর্ম্পকে সাক্ষ্য প্রদান করে। তিনি তাঁর অভিযোগে দু’লক্ষ্ মহিলার ওপর পাশবিক নির্যাতনের জন্যে এবং নারী হত্যার জন্যে এবং গণহত্যার জন্যে গোলাম আযমকে হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ১০ নং সাক্ষী মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ তাঁর সাক্ষ্যে পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে গোলাম আযম এবং তার দল জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন এবং এই দেশে গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা এবং অগ্নিসংযোগ, জনপদ ধ্বংসের জন্যে গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করেন এবং আলেম সমাজের পক্ষ্ থেকে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
ফরিয়াদি পক্ষের ১১ নং সাক্ষী জনাব আলী যাকের বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি হত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারী হিসেবে গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে গোলাম আজমের গোপন বৈঠকের একটি আলোকচিত্র প্রদর্শন করেন (গণআদালত প্রদর্শনী ‘চ’ পর্ব)।
ফরিয়াদি পক্ষের ১২ নং সাক্ষী ডা. মুশতাক হোসেন ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের ডাক্তারদের হত্যা করার জন্যে গোলাম আযম সহায়তা দিয়েছেন বলে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৩-১৫ নং সাড়্গীগণ অন্যান্য সাক্ষীদের সমর্থন করেন।
গণআদালত উপরে বর্ণিত সাক্ষ্য প্রমাণাদি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেন। ১-৬ এবং ৯-১৫ নং সাক্ষীগণ পণ্ডিত এবং সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ৭ ও ৮ নং সাক্ষীদ্বয় শহীদ পিতার পুত্র। তাদের সাক্ষ্য এত সহজ-সরল এবং এমন প্রত্যয়ী যে, তাদের সাক্ষ্য বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক করেনা। আমরা সাক্ষীদ্বয় প্রদত্ত সাক্ষ্য সত্য এবং দাখিলকৃত প্রদর্শনীসমূহ অকাট্য বিবেচনা করে সর্বসম্মতভাবে অভিযুক্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করি এবং আনীত প্রতিটি অভিযোগের প্রত্যেক অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করছি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে উপরোক্ত অপরাধ দৃষ্টান্তমূলক মৃতুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
যেহেতু গণআদালত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর করে না, সেহেতু অভিযুক্ত গোলাম আযমকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।
স্বাক্ষরঃ