সমাজে এতো বৈষম্য কেন, এতো অবিচার কেন? কেন সমাজের অল্প কিছু মানুষ আরামে-আয়েশে থাকে আর বেশিরভাগ মানুষের জীবনে অভাব-দারিদ্র্য-অপমান নিত্য সঙ্গী? সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হওয়ার পর থেকেই যুগ যুগ ধরে এসব প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়েছে, আজো ভাবাচ্ছে। মানুষ এর উত্তর খুঁজেছে, সামাজিক বৈষম্য আর অবিচারের প্রতিকার সন্ধান করেছে। কখনো মানুষ ধর্মের আশ্রয় নিয়ে পরকালে সব শোষণ-বঞ্চনার অবসান কামনা করেছে, কখনো শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে। একটা সময় পর্যন্ত মানুষের বিদ্রোহে-বিক্ষেভেও ধর্মচিন্তার প্রাবল্য ছিল। মানবজাতির ইতিহাসে আধুনিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ইহজাগতিক বা স্যেকুলার সংগ্রামের নাম ফরাসি বিপ্লব।
অষ্টাদশ শতকের অন্তিমপর্বে সমাজ পরিবর্তনের উদ্বেলিত তরঙ্গ ফ্রান্সের বুকে গমকে গমকে আছড়ে পড়েছিল। ফ্রান্সের মানুষ রাজতন্ত্র, যাজকতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্র উচ্ছেদ করে আধুনিক স্যেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে সংগ্রামের সূচনা করেছিল, তাকে আধুনিক মানবসভ্যতার ঊষা বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ ফরাসি বিপ্লবের অভিঘাত, তার সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার (Liberty-Equality-Fraternity) বাণী শুধু ফ্রান্সের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পুরো ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকা এমনকি সুদূর এই বাংলার বুকেও স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছিল। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডিরোজিয়ো এবং তার ‘ইংয় বেঙ্গল’ শিষ্যসহ তৎকালীন বিভিন্ন মনীষীর চিন্তায় ফরাসি বিপ্লবের ছাপ পড়েছিল।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা থেকে আমরা জানি যে বিবর্তনের ধারায় মানুষের আবির্ভাবের পর দীর্ঘ সময় মানুষ আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন-যাপন করেছে। তখন কোনো শ্রেণী ছিল না, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। এক সময় সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে এসেছে দাসসমাজ এবং সামন্তসমাজ। সামন্তীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে মানুষে মানুষে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নারীমুক্তির আকুতি সমাজ মননে ক্রমাগত নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপে, বিশেষত ফ্রান্সে ওই সংগ্রাম মূর্ত রূপ লাভ করে।
রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্ট
রেনেসাঁ (Renaissance) এবং এনলাইটেনমেন্ট (Enlightenment) বলে দু’টি শব্দ আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল খ্রিস্টান ধর্মের প্রবল প্রতাপ। মানব চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ঈশ্বর এবং ধর্মবিশ্বাস। রেনেসাঁ কথাটার মানে নবজন্ম। ইটালিতে এর সূচনা, যা পরে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। রেনেসাঁ ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়ে মানুষকে নিয়ে এল চিন্তা ও শিল্পকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে, যাকে আমরা বলি মানবতাবাদ। অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে নিয়ে এল যুক্তি। এ ক্ষেত্রে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, বতিচেল্লি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের ভূমিকা অনেকেরই জানা। চিন্তার জগতে নতুন ধারা নিয়ে এলেন পিকো দেলা মিরানদোলা (১৪৬৩-১৪৯৪), ম্যাকিয়েভেলি (১৪৬৯ - ১৫২৭), টমাস মুর (১৪৭৮-১৫৩৫)।
এনলাইটেনমেন্ট শব্দটার অর্থ আলোকায়ন, যার সাহায্যে চিন্তার নবজাগরণ বোঝায়। এর পটভূমি ছিল ফ্রান্স। ফরাসি বিপ্লবের আগে প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফ্রান্স আলোড়িত হয়েছে পুরনো আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্বে। গোড়ার দিকে ছিলেন সংস্করপন্থী অভিজাত চিন্তাবিদ বস্যুয়ে (১৬১২-১৭০৪), মঁতেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫); পরে বিপ্লবী ভাবধারা নিয়ে এলেন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮), রুশো (১৭১২-১৭৭৮), কন্ডসেট (১৭৪৩-১৭৯৪)-এর মতো বহু দার্শনিক-চিন্তাবিদ। এসেছেন প্যাসকেল (১৬২৩-১৬৬২), ব্যুঁফ (১৭০৭-১৭৮৮), ল্যাভয়সিয় (১৭৪৩-১৭৯৪)-এর মতো বিজ্ঞানসাধক। এর পরই আমরা পাই এনসাইক্লোপিডিস্ট (Encyclopedist বা মহাকোষ-সংকলক) নামে একদল চিন্তাবিদ যার মধ্যে আছেন দেনিশ দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪), দালেমব্যার, দোলবাশ্, এলভেতিয়াস প্রমুখ। বিপ্লবের পূর্ব এবং বিপ্লবের সময়টাতে ফিজিওক্রেট (Physiocrats) নামে একদল অর্থবিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে যাদের মধ্যে আছেন লেজে-ফেয়ার (Laissez-fair বা অবাধ প্রতিযোগিতা) তত্ত্বের উদ্গাতা ভ্যাঁসাঁ দ্য গুরনে (১৭১২-১৭৫৯), মার্কিস দ্য মিরাবোঁ (১৭২৭-১৭৮১) যিনি বিপ্লবেরও নেতা ছিলেন; তুর্গো, নেমুর প্রমুখ। এঁরা গড়ে তুলেছিলেন যুক্তি ও বিজ্ঞান-নির্ভর ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির মুক্তি তথা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার মানবতাবাদী চিন্তার জগৎ। এনলাইটেনমেন্ট-এর প্রবক্তারা সনাতন ও ঐতিহ্যগত সব কিছুর ভিত্তি ও কার্যধারা সম্পর্কে তীব্র ঘৃণার সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এর সাথে আরো একটি ঘটনা ফরাসি জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেটি আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমেরিকা তখন ব্রিটেনের উপনিবেশ। ১৭৭৬ সালে আমেরিকা ব্রিটেনের বিরম্নদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা করে। বহু ফরাসি এ সময় আমেরিকানদের পড়্গে লড়তে সে-দেশে গিয়েছিল। তারা দেশে ফিলে এল স্বাধীনতার চেতনা বুকে নিয়ে।
আজো কেন তোমরা জেগে উঠছো না, হে পরাধীন চাকর-নফরের দল!
ভলতেয়ার অন্ধ বিশ্বাসের বিপরীতে তুলে ধরেছিলেন যুক্তির হাতিয়ারকে, “খোদা পাখির যেমন পালক দিয়েছেন, দিয়েছেন ভালুকের সূক্ষ্ম লোম, তেমন আমাদেরও দিয়েছেন এক সর্বজনীন আদর্শ, তাহলো যুক্তিজ্ঞান, এবং এ আদর্শ এতো দীর্ঘস্থায়ী যে সমস্ত ভাবাবেগের সংঘাত সত্ত্বেও এবং কুসংস্কারমগ্ন ভণ্ডদের এ আদর্শ নির্মূল করার সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটা থাকবে অটুট।”
ফ্রান্সের সমাজে ঘনায়মান পরিবর্তনের আভাস তুলে ধরে ১৭৬৭ সালে তিনি লিখেছিলেন, “গত ১৫ বছরে মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে এক মানসিক বিপ্লব; এরই পরিণতি হবে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিদগ্ধ-জনের সোচ্চার-কণ্ঠ এ মহাপরিবর্তনের আগমনবার্তা বয়ে আনছে - পাখির কলকাকলী যেমন ঘোষণা করে শুভ আবহাওয়ার আগমন। ... আগামী দশ বছরের মধ্যে বিপ্লব হবে, যদি ‘হাজার জন মানুষও’ বেঁচে থাকে। আমার সমবয়সী কেউ হয়তো তা দেখবে না, কিন্তু আমরা এ আশা নিয়ে মরবো যে, মানুষ অধিকতর আলোকপ্রাপ্ত হবে, হবে আরো মর্যাদাসম্পন্ন, ... সান্ত্বনা আমার এখানে যে বিশ্ব যখন ছেড়ে যাব পেছনে রেখে যাব সৎউদ্দেশ্য-প্রণোদিত সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পরাজির মতো অপূর্ব ক্ষুদ্র এক জন-মানুষের দল; সংখ্যায় ও সামর্থ্যে এ দল বলবান হয়ে উঠবে দিনদিন; নির্বোধ আর ধর্মান্ধদের কণ্ঠরোধ করে তবেই সম্পূর্ণ হবে এদের কাজ। সেই মনোরম দিনে আমি থাকবো না, কিন্তু সে দিন যে আসন্ন তা আমি প্রত্যক্ষ করছি।”
রুশো তুলে ধরেছিলেন সাম্য, স্বাধীনতা ও মানবতার পতাকা, “স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, কিন্তু তবু সর্বত্রই মানুষ শৃঙ্খলিত। মানুষ মাত্রেই অন্যের উপর প্রভুত্ব দাবি করে বটে, কিন্তু সে ভুলে যায়, সেও অন্যের চাইতে কম পরাধীন নয়।” “মানুষ আজন্ম স্বাধীন ও স্বীয় সত্তায় অধিষ্ঠিত বলে কেউ কখনও তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোলামির জিঞ্জির পরাতে পারে না। ‘গোলামের সন্তান গোলাম’, এ অভিমত যারা প্রকাশ করেন, তারা কি বলতে চান যে, গোলামের সন্তান জন্মমুহূর্তে মানব-সন্তান হিসেবে জন্মায় নি?”
সামাজিক বৈষম্য, ধনী-গরিবের পার্থক্যকে অমানবিক ও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে রুশো তুলে ধরেছিলেন সাম্যের দাবি, “প্রকৃতির বিধান কিন্তু একেবারে নিরপেক্ষ : প্রকৃতি কাউকে রাজা, ধনবান বা অভিজাত করে সৃষ্টি করে নি।” “গরিবদের উদরের চাইতে ধনীর উদর তো আর বড় নয়, ভৃত্যের চাইতে প্রভুর বাহু দীর্ঘতর বা অধিকতর সবল নয়; বড় লোকও সাধারণ মানুষের চাইতে অধিকতর লম্বা নন। বস্তুত সব মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন সমরূপ এবং এ প্রয়োজন মেটাবার উপকরণও সমভাবে সবার নাগালে থাকতে হবে।” ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সমাজ-প্রগতির প্রতিবন্ধক হিসাবে চিহ্নিত করে তিনি লিখেছিলেন, “মানুষ এবং নাগরিক মাত্রের সমাজে সম্পত্তি বলে কিছু নেই, আছে শুধু নিজের সত্তা, এছাড়া সব বিষয়-সম্পদের মালিক হয়েছে সমাজ ...।”
সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করে রুশো ১৭৬২ সালে বলেছিলেন, “আমরা দ্রুত এগিয়ে চলেছি একটা সঙ্কটপূর্ণ এবং বিপ্লবী শতাব্দীর দিকে। ... আজো কেন তোমরা জেগে উঠছো না, হে পরাধীন চাকর-নফরের দল!”
... ... ... ... চলবে ... ... ... ... ...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৬