আগের পর্ব
Click This Link
উপনিবেশের অভ্যন্তরে অভাবনীয় ঘটনা
দুনিয়া জুড়ে তখন অনেক উপনিবেশ। কিন্তু কোনো উপনিবেশেই শিল্পপুঁজি বা ব্যাংক পুঁজির জন্মের ঘটনা ঘটেনি, যা ভারতের বুকে ঘটেছে। ঘটনা কিন্তু সেখানেই থেমে থাকল না। এরা ইনসিওরেন্স কোম্পানিও গড়ে তুলল। যেমন বিড়লারা গড়ে তুলল হিন্দুস্তান ইনসিওরেন্স কোম্পানি।
এখানে ব্যাংক ও ইনসিওরেন্সের কাজ সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া দরকার। এদের কাজ হল পুঁজি সঞ্চয় করা। দেশে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদে পুঁজিগুলোকে তারা একত্রিত করে শিল্পপতি বা উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজির যোগান দেয়। আর এ প্রক্রিয়া চলতে চলতেই শিল্পপুঁজি আর ব্যাংক পুঁজির মিলন ঘটে। জন্ম নেয় লগ্নীপুঁজি (Finance capital)।
এ সময়ে, অর্থাৎ ১৯৩০-এর সময়টাতে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা মহামন্দার কবলে পতিত হয়। এ ঘটনা ভারতীয় পুঁজিপতিদের জন্য অভাবনীয় সুযোগ এনে দেয়। ভারতের বুকে শিল্পপুঁজি আর ব্যাংক পুঁজির মিলনের মধ্য দিয়ে আবির্ভাব ঘটে লগ্নীপুঁজির। এ ঘটনা, নিঃসন্দেহে অভাবনীয়। এ সম্পর্কে লেডকস্কি বলছেন :
"Thus the development of capitalism in India during the general crisis of Capitalism led to the formation of a small stratum of indigenous monopolies. In this respect India was unique, because, nowhere else in the world did monopolies spring up under conditions of colonialism.” (Capitalism in India : Basic Trends and Its Development’; People Publishing House-1966, page – 379)
ভারতের পুঁজির বিকাশের এ দিকটি নজরে পড়েছিল কমরেড স্ট্যালিনের। ১৯২৫ সালে 'কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব দি টয়লার্স অফ দি ইস্ট'-এ প্রাচ্যের উপনিবেশগুলির মুক্তি আন্দোলনগুলো সম্পর্ক বক্তৃতা দিতে গিয়ে স্ট্যালিন দেখিয়েছেন, সেই সময়ের ভারতবর্ষ প্রাচ্যের সমস্ত উপনিবেশগুলির মধ্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের দিক থেকে সবচাইতে অগ্রসর এবং শক্তিশালী। এখানকার বুর্জোয়ারা একটা অখণ্ড শ্রেণীসত্ত্বা (homogeneous class) হিসাবে বিরাজ করছে।
স্ট্যালিনের এ কথাটি বোঝার জন্য আমাদের আগের কথায় ফিরে যেতে হবে। আমরা আগেই দেখেছি যে ভারতের পুঁজির দুইটি অংশ ছিল : comprador এবং nationalist বা স্বরাজিস্ট। ১৯৩০-এর আগ পর্যন্ত এ দু' অংশের বিরোধ ছিল, এরপর তারা একীভূত হতে শুরু করে। এবং এভাবে, ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই একচেটিয়া পুঁজির আবির্ভাব ঘটে যায়।
স্বাধীন ভারত
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশে অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত, সুরক্ষাকবচ সম্পন্ন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হল। ভারতের শাসকদের পক্ষ থেকে এটাকে বলা হল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতি। কিন্তু এ আসলে ছিল ভারতের জাতীয় পুঁজিকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা। এ সম্পর্কে লেডকস্কি তার বিশ্লেষণে বলছেন, এ নীতির উদ্দেশ্য ছিল -- (১) উপনিবেশিক আমলের বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত পুঁজি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত সংগঠিত হতে দেওয়া, যাতে এরা একটি সংহত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে গড়ে উঠতে পারেঠ। (২) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো, নতুন নতুন ক্ষেত্র তার প্রসারণ, এবং (৩) পুঁজিবাদের সামগ্রিক অগ্রগতির স্বার্থে ব্যক্তিপুঁজির মধ্যকার দ্বন্দ্বকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ ও কমিয়ে আনা। (পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৭৬)
ভারতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরাও এ সত্যকে স্বীকার করেছেন : “Public sector acts as a guarantor of private enterprise.” (The Times of India, April, 3, 1959)
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ভারতের বুর্জোয়ারা লগ্নীপুঁজি রপ্তানি শুরু করেনি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা লগ্নীপুঁজি রপ্তানি শুরু করে। এখানে সব খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে লেখাটি ভারাক্রান্ত করতে চাই না। আমার ধারণা, শুধু মূল প্রবণতাগুলো তুলে ধরতে পারলেই বিষয়টি বোঝা যাবে।
১৯৫৫-৫৬ এর পর থেকেই লগ্নীপুঁজির রপ্তানি ভারতের অর্থনীতিতে একটা লক্ষণীয় দিক হিসাবে পরিস্ফূট হয়। ৭০-এর দশকে বিদেশের বাজারে পুঁজি লগ্নীর হার ও ব্যাপ্তি দুই-ই বাড়িয়ে তোলো। ১৯৭০ সালে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় পুঁজিপতিদের ৩৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তৎকালীন বাজার মূল্যে যার দাম প্রায় ৪৪২ মিলিয়ন টাকা।
১৯৭৫ সালে এসে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টি, বিনিয়োজিত টাকার পরিমাণ কমপক্ষে দ্বিগুণ হয়। ৮০-র দশকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯১টি, আর বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ তখনকার বাজার মূল্যে ২০৩০ মিলিয়ন টাকা।
ভারতের পুঁজির এ বিকাশমান দিকটি সম্পর্কে সেখানকার বিখ্যাত একটি সাপ্তাহিক 'ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি'-তে (Economic and Political Weekly) নাগেশকুমার একটি প্রবন্ধ লিখেন ১৯৯৫ সালে। সেখানে তিনি বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ সন্নিবেশ করে দেখিয়েছেন --
“By the beginning of 1980’s India had emerged as a significant among developing countries of capitalist goods, including turnkey plants, consultancy services, licensing of know-how. The 1970’s also marked the emergence of out ward FDI (Foreign Direct Investment) by enterprises in a significant manner.”
অর্থাৎ ৭০-এর সময়টা বিদেশের মাটিতে ভারতীয় পুঁজির লগ্নী চোখে পড়ার মতো জায়গায় এসেছে, আর ৮০-তে এসে ভারত শুধু পণ্য রপ্তানি নয়, প্রযুক্তি এবং পরামর্শক পর্যন্ত রপ্তানি করছে।
শুধু তাই নয়। ওই সময় ভারতীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। এতদিন যেখানে কেবল উন্নয়নশীর হিসাবে খ্যাত দেশগুলোতে ভারত বিনিয়োগ করত, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতেও বিনিয়োগ করছে। তাদের ৯১টির মধ্যে ২৭টি গড়া হয়েছে ওইসব শিল্পোন্নত দেশগুলোতে।
এরপর ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর এক বিশাল বাজার উন্মুক্ত হয়। ভারতের পুঁজি সে সুযোগ নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওই সময়টাতে মুক্তবাজার নীতি গ্রহণ করে ভারত তার বাজার যেমন খুলে দেয় বিদেশী পুঁজির জন্য, আবার সে নিজেও বিদেশের বাজারে অবাধে প্রবেশের সুযোগ নেয়।
নব্বুই পরবর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরে নাগেশকুমার, Economic and Political Weekly-তে লিখেছেন :
“The removal of these restriction as well as improved transparency of policy regime perhaps explains a record 345 outward investments being approved with a projected Indian equity of Rs. 11.65 billion. Thus 57.3 percent of 600 ventures abroad at the end of 1993 accounting for 7.7 percent of total Indian outward FDI have been committed between 1991 and 1993.”
অর্থাৎ শুধু ১৯৯১-৯৩ সালে এসে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০টিতে যার মধ্যে ৩৪৫টি গড়ে উঠেছে ওই তিন বছরে। যার মূল্যমান ১১.৬৫ বিলিয়ন রুপি।
১৯৯৬ সালের হিসাবে আমরা দেখতে পাই, পশ্চমি এশিয়ায় অর্থাৎ লগ্নী পুঁজির পরিমাণ মোট এফডআই-এর ২৫%। এর প্রায় পুরোটাই প্রেট্রোল প্রজেক্টে। ইসরাইলে আছে সার কারখানা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ৬৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ মোট এফডিআই-এর ২৪%। আফ্রিকায় আছে ২৭টি প্রজেক্ট, মোট বিনিয়োগের ৭.৮৬ ভাগ সেখানে।
ওই সময়, সালে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী চিদাম্বর রাও গর্ব করে বলেছিলেন, ভারতের ১৪৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে যাদের বহুজাতিক হয়ে ওঠার সুযোগ আছে। বলা বাহুল্য, ভারত তার ওইসব সম্ভবনাময় বহুজাতিকদের স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছে।
ক্রমশ ...
পরের পর্ব
Click This Link