ষড়যন্ত্রের সূতিকাগার। পরিচিতি 'ফজল মসজিদ' নামে। অবশ্য কাদিয়ানীদের কেউ কেউ 'লন্ডন মসজিদ'ও বলে থাকেন এটিকে। অবস্থান লন্ডনের সাউথফিল্ডস এর ওয়ান্ডসওয়ার্থ এ। ১৯৮৪ ইং সাল পর্যন্ত এটি কাদিয়ানীদের মিথ্যাচারের প্রধান, তাদের ভাষায়, তাদের খলিফার বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হত এবং তাদের হেড কোয়ার্টার হিসেবেও এটি সুবিদিত।
কাদিয়ানীদের ভেতরে গ্রুপিং
পাক ভারতের মুসলমানদের ভেতরে স্থায়ীভাবে ধর্মীয় দ্বন্ধ-সংঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইংরেজদের হাতে গড়া কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ভেতরেও রয়েছে গ্রুপিং সমস্যা। তারা তাদের মূল উদ্দেশ্য (মুসলমানদের ভেতরে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দ্বন্ধ-সংঘাত সৃষ্টির কাজ) থেকে সরে গিয়ে নিজেদের ভেতরেই দল উপদলে বিভক্ত হয়ে হানাহানিত লিপ্ত হয়েছে। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্য দু'টি ধারা হল- ০১. কাদিয়ানীদের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বংশধরগন পরিচালিত কাদিয়ানী সম্প্রদায় এং ০২. লাহোরের কাদিয়ানী নেতা মোহাম্মাদ আলীর নেতৃত্বে কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপ।
কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপ কথন
কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অবশেষে পায়খানায় পরে গিয়ে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর লজ্জাজনক মৃত্যু (২৬ মে, ১৯০৮ ইং) -র পর ২৭ মে, ১৯০৮ সালে কাদিয়ানীদের প্রথম নেতা (তাদের ভাষায় প্রথম খলিফা) নির্বাচিত হন হাকিম নূর উদ্দীন (জন্ম: ০৮ জানুয়ারি ১৮৪১, মৃত্যু: ১৩ মার্চ, ১৯১৪ ইং)। হাকিম নূর উদ্দীন ১৯১৪ সালের ১৩ মার্চ মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্তের প্রশ্নে সর্বপ্রথম তাদের ভেতরে মতানৈক্যের সূচনা হয়। কাদিয়ানীদের ভাষায় তাদের দলে হাকিম নূর উদ্দীনের পরে শিক্ষিত ও যোগ্য লোক হিসেবে মোহাম্মাদ আলী (জন্ম: ১৮৭৪, মৃত্যু: ১৩ অক্টোবর, ১৯৫১ ইং) সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাই তাদের ভাষায়, শিক্ষিত লোকদের অধিকাংশের মনোভাব ছিল, মোহাম্মাদ আলীই তাদের নেত নির্বাচিত হবেন। অন্য দিকে, সাধারন ভক্তরা তাদের তথাকথিত নবীপুত্র মির্জা বশীর উদ্দীন মাহমুদ আহমদ (জন্ম: ১৮৮৯, মৃত্যু: ১৯৬৫ ইং) কে স্থলাভিষিক্ত করার পক্ষপাতি ছিল। এমনিতে কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গেলাম আহমদ কাদিয়ানীর ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা কোন রুচিশীল ব্যক্তির পক্ষে মুখে উচ্চারন করা দুষ্করই বটে। একই ধারাবাহিকতায় মির্জা বশীর উদ্দীন মাহমুদের চারিত্রিক অধ:পতন সম্পর্কে কাদিয়ানী মহলেও বহুল প্রচারনা ছিল বলে তাদের শিক্ষিত লোকেরা তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে সম্মত হয় নি। কিন্তু সাধারন মূর্খ ভক্তদের দল ভারী ছিল। তারা তাকে নেতা মনোনীত করে নেয়। ১৯১৪ সালের ১৪ মার্চ মির্জা বশীর উদ্দীন মাহমুদ আহমদ কাদিয়ানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে নেতা মনোনীত হন। অত:পর ১৯১৪ সালের ২২ মার্চ মোহাম্মদ আলী তার দলবল নিয়ে লাহোর চলে এসে এ দলের নেতা মনোনীত হন। এভাবে কাদিয়ানী ধর্মমতাবলম্বীরা দু'টি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথমোক্ত দলটি 'কাদিয়ানী' নামে পরিচিতি লাভ করে। আর অপর দলটি 'লাহোরী কাদিয়ানী' নামে আখ্যায়িত হয়। (তথ্য সূত্র: কাদিয়ানী ধর্মমত, পৃষ্ঠা-১০৫, উইকিপিডিয়া)।
'কাদিয়ানী' এবং 'লাহোরী কাদিয়ানীদের' মধ্যে পার্থক্য:
হাকিম নূর উদ্দীনের নেতৃত্বের দীর্ঘ ছয় বছরে তাদের যেসব পুস্তক-পুস্তিকা ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, ঐ সবগুলোতে মির্জা কাদিয়ানীকে নবী-রাসূল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা সকলে তাকে নবী-রাসূল হিসেবে মান্য করে এসেছে। পরবর্তীতে সৃষ্ট লাহোরী গ্রুপের নেতা মোহাম্মাদ আলী কাদিয়ানীদের ইংরেজী পত্রিকা 'রিভিউ অফ রিলিজিয়াস' এর সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এসব দিনগুলোতে উক্ত পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম ও মোহাম্মাদ আলী কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে মোহাম্মাদ আলী তাকে শুধু নবী-রাসূল হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষান্ত হন নি, বরং নবী-রাসূলের সকল বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী হিসেবে প্রমান করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। (তথ্য সূত্র: কাদিয়ানী ধর্মমত, পৃষ্ঠা-১০৫, উইকিপিডিয়া)।
মোহাম্মাদ আলী লিখেছেন, 'আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা যাই বলুক না কেন, আমরা কিন্তু এ বিশ্বাসের উপর স্থির ও অটল আছি যে, আল্লাহ তাআ'লা এখনও নবী সৃষ্টি করতে পারেন। সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ এর মর্যাদা দান করতে পারেন। তবে মর্যাদা লাভের আগ্রহী থাকতে হবে। .... আমরা যে ব্যক্তিত্বের হাতে হাত মিলিয়েছি (মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) তিনি সত্যবাদী ছিলেন এবং আল্লাহর মনোনীত পবিত্র রাসূল ছিলেন।' (তথ্য সূত্র: কাদিয়ানী ধর্মমত, পৃষ্ঠা-১০৩-১০৪, আহমদিয়া মিলনায়তনে মোহাম্মদ আলীর ভাষন, কাদিয়ানী পত্রিকা আল হাকাম, ১৮ জুলাই এবং কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত মাসিক ফোরকান, ১ম খন্ড, ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা-১১)।
এসকল উদ্ধৃতি দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয় যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মানার দিক থেকে কাদিয়ানীদের উভয় গ্রুপের ঐকমত্য ছিল। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন দ্বিমত ছিল না।
কাদিয়ানীদের দু'দলে বিভক্তি ধর্মীয় আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের কারনে নয়। বরং উভয় দলের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল এক ও অভিন্ন। মূলত: নেতৃত্বের প্রশ্নে সৃষ্ট কোন্দলের ফলশ্রুতিতেই তারা দু'দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে, উভয় দলের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, কাদিয়ানীরা মির্জা কাদিয়ানীকে স্পষ্ট ভাষায় নবী বলে প্রকাশ করেন। আর লাহোরী কাদিয়ানীগন বলেন, 'আমরা তাকে আভিধানিক ও রূপক অর্থে নবী মান্য করি।' এটাও তাদের বহুবিধ প্রতারনার একটি।
যেহেতু কাদিয়ানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মির্জা কাদিয়ানীর পুত্র মির্জা বশীর উদ্দীন মাহমুদ আহমদকে নেতা মেনে নিয়েছিল। আর লাহোরী গ্রুপ যাদের নেতা মনোনীত হয়েছিলেন মোহাম্মাদ আলী, তারা পূর্বোক্ত দলের তুলনায় একটি ক্ষুদ্রতম দল ছিল। একারনে লাহোরী কাদিয়ানীদের জন্য এমন দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, এ দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় লাহোরী গ্রুপটি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মুসলমানদের সহানুভূতি লাভ করা তাদের জন্য অত্যাধিক প্রয়োজনীয় মনে করে পরিভাষায় কিছুটা শাব্দিক পরিবর্তন এনে প্রচার করতে আরম্ভ করল, 'আমরা মির্জা সাহেবের জন্য 'নবী' শব্দটির ব্যবহার বর্জন করেছি। আর যদি কোথাও এ শব্দটির ব্যবহার আমাদের লেখনী কিংবা উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে, তবে 'নবী' শব্দটিকে আমরা আভিধানিক কিংবা রূপক অর্থে ব্যবহার করে থাকি'। তারা কাদিয়ানীদের মূল এবং জঘন্য বিশ্বাস- 'কাদিয়ানী বাদে সবাই কাফের' সরে এসে আরও বলতে আরম্ভ করল, 'আমরা গাইরে আহমদীদেরকে 'কাফের' বলার পরিবর্তে 'ফাসেক' মনে করি।' (তথ্য সূত্র: কাদিয়ানী ধর্মমত, পৃষ্ঠা-১০৭, মাওকিফিল ইমামাতিল ইসলামিয়্যাতি মিনাল কাদিয়ানিয়্যাহ, উইকিপিডিয়া)।
মোটকথা কাদিয়ানী গ্রুপ কুরআন, হাদীস ও উম্মতে মুসলিমার সর্ববাদী মতে কাফের ও মুরতাদ সাব্যস্ত হয়েছে। তেমনি কাদিয়ানীদের লাহোরী গ্রুপও নি:সন্দেহে কাফের ও মুরতাদ বলে গন্য। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে তারা কাদিয়ানীদের ন্যায় ব্যাপক অর্থে নবী বলে প্রচার না করলেও তাদের প্রামান্য পুস্তকাদি দ্বারা প্রমানিত হয়েছে, কাদিয়ানীদের এ গ্রুপটিও তাকে যিল্লী নবী ও উম্মতি নবী বলে মান্য করে। তাছাড়া প্রকাশ্যে তারা মির্জা কাদিয়ানীকে মাসীহে মাওউদ বলে ব্যাপকভাবে দাবী করে থাকে। এ দাবীও কুরআন, হাদীস ও উম্মতের ইজমা (ঐকমত্য) পরিপন্থী হওয়ায় এটাও তাদের কাফের ও মুরতাদ সাব্যস্ত হওয়ার অন্যতম কারন।
বাংলাদেশে কাদিয়ানী অপতৎপরতা
অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে কাদিয়ানীদের ধর্মমত প্রচার রাষ্ট্রীয়ভাবে বেআইনী ঘোষনা করায় কেবল বাংলাদেশেই তাদের ধর্মমত প্রচারের সুযোগ রয়েছে। তাই বর্তমানে তাদের শকুন দৃষ্টি এখন সবুজ-শ্যামল, সুফলা-সুজলা বাংলাদেশের প্রতি। বাংলাদেশে সরকারিভাবে তাদের অমুসলিম ঘোষনা না করার কারনে কাদিয়ানীগন বাংলাদেশকে তাদের ধর্মমত প্রচারের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। সেমতে কাদিয়ানীগন বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও কেন্দ্র স্থাপন করে নানা ধরনের পুস্তক-পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ ও বিলি করে দেশে মারাত্মক ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছে। পুরনো ঢকায় ৪ নং বকশীবাজারে তাদের প্রধান কেন্দ্র। এছাড়া ঢাকা মহানগরে তাদের আরও ৬ টি ছোট কেন্দ্র রয়েছে বলে জানা গেছে। কিছু দিন পূর্বেকার এক জরিপ মতে বর্তমানে সারা বাংলাদেশে তাদের ১২৩ টির মত সেন্টার রয়েছে।
এতদ্ব্যতীত তাদের উইকিপিডিয়াতে দেয়া তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ১২০ টি লোকাল চ্যাপ্টার দ্বারা ৪২৫ শহর ও গ্রামে তারা তাদের ধর্মমত প্রচারে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তাদের রয়েছে ৬৫ মিশনারী, এমটিএ (মুসলিম টেলিভিশন আহমদিয়া) নামে ঢাকাতে একটি টেলিভিশন স্টুডিও এবং জামিয়া আহমদিয়া (মিশনারী ট্রেনিং কলেজ)। এছাড়াও মুসলমানদের নানা ছল-ছলনায় মুরতাদ বানানোর জন্য তাদের রয়েছে পাঁচটি পৃথক সংগঠন। সংগঠনগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি।
০১) মজলিসে আনসারুল্লাহ:
চল্লিশোর্ধ বয়সের লোকেরাই কেবল এ সংগঠনের সদস্য হয়ে থাকে। সাধারন মুসলমান, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রচার করে থাকে এরা। এ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও সংবাদপত্র সেবীদের কাদিয়ানী ধর্মমতের দিকে আকৃষ্ট করা।
০২) মজলিসে খোদ্দামে আহমদিয়া:
এ সংগঠনের সদস্য তারা হয়ে থাকে যাদের বয়স পনের বছরের উর্ধ্বে এবং চল্লিশের কম। এ সংগঠন যুবকদের কাদিয়ানী বেড়াজালে আবদ্ধ করার তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। বেকার যুবকদের কাদিয়ানী অফিসারদের মাধ্যমে চাকরি দানের প্রলোভন এবং শিক্ষিত বেকারদের বৃটেন, আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরনের প্রলোভন দেখিয়ে কাদিয়ানী ধর্মমতে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালায় এই সংগঠনের সদস্যগন। এ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হচ্ছে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্রদের শিক্ষা সহায়তা প্রদান ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে প্রেরনের প্রলোভনে কাদিয়ানী ধর্মমতে দীক্ষিত করার অপপ্রয়াস। এ সংগঠন শিক্ষার্থীদের ভেতরে কাদিয়ানী বই পত্র ইত্যাদি বিলি বিতরন করে থাকে।
০৩) মজলিসে আতফালুল আহমদিয়া:
এ সংগঠনের সদস্যদের বয়সের সীমারেখা অনধিক ১৫ বছর। এ সংগঠন দ্বারা কাদিয়ানীগন তাদের কম বয়সী ছেলেদের দ্বারা সমবয়সী মুসলমান কঁচি-কাঁচাদের নিকট 'এসো ভাল মুসলমান হই' জাতীয় প্রচারপত্র বিলি করে মুসলিম শিশুদের অন্তরে কাদিয়ানী মতবাদের প্রতি আকর্ষন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে শহরের তথাকথিত অভিজাত একটি শ্রেনির মুসলমানরা তাদের সন্তানদের ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক শিক্ষা দান করাটা অপ্রয়োজনীয় মনে করে থাকে। এদের সন্তানদের অন্তরে ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারনাই থাকে না। এদের মধ্যে পূর্বোক্ত প্রচার পত্রসমূহ বিলি করে তাদের অন্তরে কাদিয়ানী ধর্মমতের বীজ বপন করা হয়।
উপরোক্ত তিনটি সংগঠন পুরুষ ও কিশোরদের মধ্যে কাজ করে থাকে। আর মহিলাদের মধ্যে কাদিয়ানী ধর্মমত প্রচারের জন্য রয়েছে নিম্নোক্ত পৃথক দু'টি সংগঠন।
০৪) লাজনা ইমায়িল্লাহ:
১৫ বছরের উর্দ্ধ বয়সী মহিলাগন এ সংগঠনের সদস্য হয়ে থাকেন। এ সংগঠনের মহিলা সদস্যগন শহর, বন্দর ও গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের মধ্যে কাদিয়ানী ধর্মমতের পুস্তকাদি বিলি করে থাকে এবং সুযোগ পেলে তাদের ধর্মমতে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে মহিলাদের লোভ-লালসা ও প্রলোভন দিয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে এ সংগঠনের ৩০/৩৫ টি কেন্দ্র কার্যকর রয়েছে বলে জানা গেছে।
০৫) নাসেরাত:
অনুর্ধ্ব ১৫ বছরের কিশোরীদের মধ্যে প্রচার কার্য্য পরিচালনার জন্য নাসেরাত নামের সংগঠনের সদস্যরা কাজ করে থাকেন। সমবয়সী কিশোরীদের কাদিয়ানী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করে থাকে। সমবয়সী কিশোরীদের সাথে শিক্ষালয়ে বন্ধুত্ব পেতে, কাদিয়ানীদের বিশেষ বিশেষ গোপন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে কাদিয়ানী মতবাদকে খাঁটি বলে বুঝানো হয়ে থাকে। (সূত্র: কাদিয়ানী ধর্মমত, মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী)।
কাদিয়ানী ধর্মমত বনাম ইসলাম, বিরোধ কোন পর্যায়ের?
কাদিয়ানীদের সাথে মুসলমানদের বিরোধ শাখাগত বিরোধ নয়। কাদিয়ানী ফিতনা কোন শাখাগত ফিতনা নয়। স্বয়ং কাদিয়ানীরাও এরূপ বলেছে: 'আমাদের এবং অকাদিয়ানীদের মধ্যকার বিরোধকে কোন শাখাগত (ফুরূয়ী) বিরোধ মনে করা নির্জলা ভুল। .... আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত রাসূলকে অস্বীকার করা কুফরী। আমাদের বিরোধীগন মির্জা সাহেবের আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হওয়াকে অস্বীকার করে। এটা শাখাগত বিরোধ হয় কেমন করে?' (সূত্র: কাদিয়ানী মাজহাব (নতুন সংস্করন), ইলিয়াছ বরনী, পৃষ্ঠা-৫৬৪)।
সুতরাং ইসলামের নামে যেমন আরও অনেক ফিতনা রয়েছে তেমন ধরনের কোন সাধারন ফিতনা এটা নয়। বরং, এটি একটি মৌলিক ফিতনা। এটি ইসলাম এবং অনৈসলামের বিরোধ। মুসলিম উম্মাহ কাদিয়ানীদের মুসলমানদের তালিকাভূক্তই মনে করেন না। স্বয়ং কাদিয়ানীগনও মুসলিমদের তাদের দলভূক্ত মনে করেন না। এ বিষয়টি কাদিয়ানী নয় এমন লোকদের সম্পর্কে কাদিয়ানীদের ধারনা কি, তা জানলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে কাদিয়ানীদের মত ও বিশ্বাস:
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার বিরুদ্ধবাদীদের তার ভাষায়, 'অমুসলিম', 'কাফের', 'জাহান্নামী' ইত্যাদি সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন: 'নি:সন্দেহে আমার শত্রুরা অরন্যের বানরে পরিনত হয়েছে এবং তাদের স্ত্রীরা কুকুরীর চেয়েও বেশি সীমাতিক্রম করেছে।' (সূত্র: খতমে নবুওয়াত, নাজমুল হুদা, পৃষ্ঠা-১০, দর সামীন, পৃষ্ঠা-২৯৪)।
তিনি আরও বলেছেন: 'যে ব্যক্তি আমার বিরোধী সে খৃষ্টান, ইহুদি, মুশরিক এবং জাহান্নামী'। (সূত্র: খতমে নবুওয়াত, নুযূলুল মাসীহ, পৃষ্ঠা-০৪, তাবলীগ ও রেসালাত, খন্ড-০৯, পৃষ্ঠা-২৭, তাজকিরাহ, পৃষ্ঠা-২২৭)।
তিনি আরও বলেন: 'সমগ্র মুসলমান যারা মাসীহে মাওউদের নিকট বাইআত করে নি, যদি কেউ মাসীহে মাওউদের নাম না ও শুনে থাকে, তবু তারা সকলেই কাফের ও ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত। (সূত্র: আহমিয়াতে সাদাকাত, পৃষ্ঠা-৩৫)।
কাদিয়ানীর দ্বিতীয় পুত্র এবং পরবর্তীতে তার স্থলাভিষিক্ত মির্জা বশীর আহমদ বলেন: 'যে লোক মূসা নবীকে মানে কিন্তু ঈসাকে মানে না, অথবা ঈসা নবীকে মানে কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে মানে না, অথবা মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে মানে মাসীহে মাওউদকে মানে না, সে যে শুধু কাফের তা নয়, বরং কট্টর কাফের ও ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত।' (সূত্র: কাদিয়ানী মাজহাব (নতুন সংস্করন), ইলিয়াছ বরনী, পৃষ্ঠা-১১০)।
কাদিয়ানীদের অপর দল লাহোরী কাদিয়ানীদের নেতা মোহাম্মাদ আলী লিখেছেন: 'আহমদী আন্দোলন (কাদিয়ানী ধর্মমত) এর সাথে ইসলামের সম্পর্ক অনুরূপই যেরূপ খৃষ্টানদের সাথে ইহুদি মতবাদের সম্পর্ক রয়েছে।' (সূত্র: কাদিয়ানী ধর্মমত, মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, পৃষ্ঠা-৯৬, বরাত- মুবাহাসা রাওয়াল পিন্ডি, পৃষ্ঠা-২৪০, তাবলীগে আকায়েদ, মোহাম্মদ ইসমাঈল, পৃষ্ঠা-১২)।
উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াহুদি ধর্ম, খৃষ্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম যেমন পৃথক পৃথক ধর্ম, তেমনি কাদিয়ানী ধর্মমতও অনুরূপ পৃথক একটি ধর্মমত। স্বয়ং কাদিয়ানীদের উভয় দলের স্বীকৃতিও অনুরূপ। বস্তুত: কাদিয়ানী ধর্মমত ইসলাম হতে সম্পূর্ন পৃথক একটি ধর্মমত। ইসলামপন্থীরা কোনক্রমেই কাদিয়ানীদের মুসলিম জাতির অন্তর্ভূক্ত মনে করতে পারে না।
জীবনে মক্কা-মদীনা প্রবেশের অনুমতি পেলেন না আহমদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা!
প্রকৃত মুসলিম মাত্রেরই নাড়ীর টান প্রিয়তম রাসূল আখেরী নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের স্মৃতিধন্য পবিত্র ভূমি মক্কাতুল মুকাররমা আর মদিনাতুল মুনাওওয়ারার প্রতি। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কথা না হয় না ই বললাম, একজন অতি সাধারন, দীন হীন মুসলমানেরও হৃদয়ের আকুল আঁকুতি থাকে রব্বুল আলামীনের পবিত্র ঘর বাইতুল্লাহর যিয়ারতে মক্কাতুল মুকাররমার পানে জীবনে একটিবারের জন্য হলেও ছুটে যাওয়া! মদিনাতুল মুনাওওয়ারার সবুজ গম্বুজের পাশে দাড়িয়ে প্রিয়তম রাসূলের রওজায়ে আতহারে সালামের নজরানা পেশ করে দু'ফোটা অশ্রুর ভাষায় কথা বলা! কিন্তু, জানা যায়, এই সৌভাগ্য নসীব হয় নি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর। এই হাল আমলের মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের জন্য মক্কা-মদীনার দরজা আল্লাহ পাক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং অবশ্যই যথাযথ। প্রশংসা কেবল তাঁরই। শুরু এবং শেষে। সিরিজটি সম্পূর্ন করতে পেরে কৃতজ্ঞতা মহান মালিকের প্রতি। অগনন বেশুমার শুকরিয়া তাঁর।
যে কারনে এই ধারাবাহিকটি:
অন্য সকল পর্বের মত এই পর্বেও অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা আমার ভাই ব্লগার নাঈমুর রহমান আকাশকে। তার কারনেই মূলত: এই পোস্টের বিষয়টি প্রথমত: চিন্তায় আসে। ইসলাম এবং মুসলমানদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার তার এবং সম্ভবত: সমস্ত কাদিয়ানীদের যে বৈকল্যপূর্ন মানসিকতা সাম্প্রতিক আমাদের দেখতে হয়েছে, এক কথায় বলতে গেলে এই সিরিজটি সেই মিথ্যার বেশাতির মোকাবেলায় তত্ত্ব, তথ্য এবং যুক্তিপূর্ন দাঁতভাঙ্গা দলীল। নাঈমুর রহমান আকাশকে আল্লাহ পাক এর উপযুক্ত বিনিময় দান করুন। সত্য পথের সন্ধান দিন তাকে।
পূর্বের মতই আমরা এই সিরিজের প্রতিটি লেখায় প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র সংযুক্ত করার চেষ্টায় ত্রুটি করি নি। এরপরেও আমাদের অনিচ্ছাকৃত কোন তথ্য বিভ্রাট কারও নজরে এলে সহৃদয়তার পরিচয় দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে, আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানাব। একজন ব্যক্তিও যদি এই সিরিজটিতে উপস্থাপিত তথ্যাদি দ্বারা উপকৃত হন, তাহলেই শ্রম স্বার্থক মনে করব। আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষুদ্রতা, সীমাবদ্ধতা ও জ্ঞানের স্থুলতা ক্ষমা করুন।
আল্লাহ পাক বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী প্রত্যেক আপদ থেকে আমাদের ঈমান এবং আমল হেফাজত করুন। আমাদের সত্যের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। তাঁর দ্বীনের সামান্য খেদমত হিসেবে এই শ্রমকে তিনি কবুল করুন।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্ব সহৃদয় যেসব ব্লগার বন্ধুগন মনযোগ সহকারে পড়েছেন, কাদিয়ানীদের ভিত্তিহীন অসারতা অনুধাবন করেছেন এবং প্রেরনা দিয়ে, সাহস দিয়ে পাশে ছিলেন, থাকছেন সকলের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা। সকলের মঙ্গল হোক।
পূর্বের পর্বগুলোতে যেতে-
কাদিয়ানী আহমদীদের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হলে তাদের অসারতা অনুধাবন অপরিহার্য্য পর্ব-০১।
কাদিয়ানী আহমদীদের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হলে তাদের অসারতা অনুধাবন অপরিহার্য্য পর্ব-০২
কাদিয়ানী আহমদীদের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হলে তাদের অসারতা অনুধাবন অপরিহার্য্য পর্ব-০৩
কাদিয়ানী আহমদীদের ধোঁকা থেকে বাঁচতে হলে তাদের অসারতা অনুধাবন অপরিহার্য্য পর্ব-০৪
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:১০