সবুজের লেশহীন একটা মাঠ। বৃক্ষছায়া বলতে কিছু নেই। অযত্নে এদিকে সেদিকে বেড়ে উঠেছে কিছু লতাগুল্ম। রোদে পোড়ার স্বাক্ষর বহন করা হলদে পাতা।চারপাশ আবর্জনায় আকীর্ণ । তার এক প্রান্তে গাধার আস্তাবল। অন্য প্রান্তে মসজিদ। মাঝ বরাবর কংক্রিটে তৈরি দুটি ‘বাইশ গজ’। ওপর থেকে দেখলে ইংরেজি বর্ণ—‘T’ বলে মনে হয়। ইংরেজিতে ‘টেপ টেনিসে’র প্রথম অক্ষরটিও কিন্তু-‘টি’!
এ মাঠ কল্পনা করে নিতে পারলে, করাচির নাদিম সারোয়ার পার্কে আপনাকে স্বাগতম। ‘নাইন জিরো’— মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট রাজনৈতিক দলের সদর দফতর থেকে গাড়িতে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। জায়গাটা শুধু নামেই পার্ক। সাহারা মরুভূমিকে পার্ক ভেবে নিতে পারলে এটাও পার্ক! তবে প্রাণহীণ নয় মোটেও। নাদিম সারোয়ার পার্কের প্রত্যেক বিকেলে চলে টেপ টেনিস ক্রিকেটের আনন্দযজ্ঞ। তারিক বরাবরই সেই উৎসবের মধ্যমণি। পেশায় দুধ বিক্রেতা হলেও, এমসিজিতে যেমন ব্রাডম্যান, এসএসসিতে জয়াবর্ধনে, নাদিম সারোয়ার পার্কে তেমনি শুধুই তারিকের রাজত্ব। ব্যাট হাতে তার ভেলকিবাজির চাক্ষুষ সাক্ষী পাকিস্তানের সাংবাদিক আবিদ হুসেইন।
৫ ওভারে ৬১ রানের টার্গেট। পান চিবুতে চিবুতে ব্যাট হাতে স্ট্যান্স নেয় তারিক। শুরুটা স্রেফ সুপারসনিক! প্রথম দুই ওভারেই ২০ আর ২৩! ঝামেলার শুরু পরের ওভার থেকে। শোয়েব আখতার কায়দায় রানআপ নেয়া এক লেফটি পেসারের বল হঠাৎ করেই রিভার্স সুইং করতে শুরু করে। চার বলের ব্যবধানে দুই উইকেট নেই! পঞ্চম বলে তারিক স্ট্যান্স নেয়ার আগে বলটা পরীক্ষা করে দেখার অনুরোধ জানায় আম্পায়ারকে। তার অনুমান সঠিক। টেনিস বলের একপাশে মোড়ানো টেপ খানিকটা ছিলে গেছে। বাতাসে ছেঁড়া টেপের প্রতিবন্ধকতার ফলাফল— রিভার্স সুইং। সহসাই বলের টেপ পাল্টানো হয় এবং এর পর তারিকের তাণ্ডব অনুমিতই ছিল। চার নম্বর ওভারেই জয়ের বন্দরে নোঙর করে তার দল।
টেপ পাল্টানোর হেতু কী? তারিকের ব্যাখ্যা, ‘ফাটে হুয়ে টেপ ছে বোলিং ক্যর রাহে থে, ব্যাটিং কাহা সে হোতি।’
তারিকের কথার ঢংয়ে ইকবাল কাসিমকে মনে পড়ে আবিদ হুসেইনের। রাস্তার ক্রিকেট খেলে পাকিস্তানের জাতীয় দলে উঠে এসেছিলেন সাবেক এ বাম হাতি স্পিনার। ছেলে থেকে বুড়ো, সবাই তাকে ‘কাকা’ বলে ডাকত। কথা প্রসঙ্গে সেই কাকার কাছ থেকেই আবিদ হুসেইন প্রথম জানতে পারেন, ব্যাটসম্যানদের রান উৎসব ঠেকাতেই টেপ টেনিস ক্রিকেটের উদ্ভব।
সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু টেনিস বলের সঙ্গে ইলেকট্রনিক টেপের এ আঠালো পরিণয়ের রূপকার কে?
বোধহয় সাদামাটা গোছের কোনো ছোকরা। ইতিহাসে তাদের জায়গা হয়নি কোনো দিনই। তবে আবিদ হুসেইনের মতো গোটা দুনিয়া জানে, টেপ টেনিস ক্রিকেটের জন্মভূমি পাকিস্তান। আরো খোলাসা করে বললে, জায়গাটা করাচির প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টার থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরের শহরতলি নাজিমাবাদ। পাকিস্তানের প্রথম ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট খাজা নাজিমুদ্দিনের নামে এ উপশহর। স্থানীয়দের বেশির ভাগই উর্দুভাষী অভিবাসী মধ্যবিত্ত ‘মুহাজির’।
************************************
উপমহাদেশ দ্বিখণ্ডিত হওয়ারও দুই দশক পর করাচিতে ক্রিকেট খেলাটা শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল। সদ্দর, জাহাঙ্গীর পার্ক, পোলো গ্রাউন্ডের মতো কিছু পুরনো জায়গা আর কয়েকটা স্কুলে খেলাটা চলত সাহেবি ঢংয়ে। অর্থাৎ ব্যাট প্যাড গ্লাভস বল থেকে শুরু মোটামুটি ক্রিকেটের আনুষঙ্গিক সবকিছুই থাকত। দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্রথম তিনটি আদমশুমারি অনুযায়ী— ১৯৫১ থেকে ১৯৭২ এ ২১ বছরে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে করাচির জনসংখ্যা। ১৯৫১ সালে যে শহরের জনসংখ্যা ছিল ১১ লাখ ছুঁইছুঁই, ১৯৭২ সালে সেটিই ৩৫ লাখ! এ সময় করাচির ভেতরে বাইরে আবাসিক এলাকা বেড়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো। নাজিমাবাদের গোড়া পত্তন ঘটে ১৯৫২ সালে। এখানকার মধ্যবিত্ত সমাজের স্ফুরণই টেপ টেনিস ক্রিকেটের প্রসব বেদনার নেপথ্য অনুঘটক। কেতাবি ঢংয়ের ক্রিকেটে খরচ বেশি পড়ত। অপেশাদার কিংবা স্রেফ আগ্রহীদের এ খরচ নির্বাহে হাপিত্যেশ উঠে যেত। অতএব ক্রিকেট বলের দুধের স্বাদটা ঘোলে মেটানোর বিকল্প পথ— টেপ টেনিস। পাকিস্তানের ন্যাশনাল ব্যাংক দলের কোচ ইশাক প্যাটেল— নাজিমাবাদের বাসিন্দা— প্রথম রাবার কর্কের বলে ক্রিকেট খেলেন ষাটের দশকের শেষ দিকে। এর পর এল শক্ত টেনিস বল, সেটাও কিছু একটা দিয়ে পেঁচিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো ওজন আর পেস বাড়াতে। নাজিমাবাদের আরেক বাসিন্দা পাকিস্তানের খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার ইকবাল মুনিরের মতে, ভেজা জবজবে সেই টেনিস বল ছিল ‘ক্রিকেট বলের স্বস্তা কিন্তু সেরা বিকল্প।’
পাকিস্তানে টেপ টেনিস ক্রিকেটের প্রচলন ঘটে কখন— এ অনুসন্ধানের জবাবে ১২ বছরের একটা সীমারেখা টেনে দেয় সবাই। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৯— এ ১২ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় মধ্যে টেপ টেনিস ক্রিকেটের প্রচলন ঘটে পাকিস্তানে। স্কুলজীবনে তুখোড় ক্রিকেটার, পরবর্তীতে সিনেমা পরিচালক হাসান জাঈদির টেপ টেনিসে হাতেখড়ি ঘটে ১৯৮০ সালে। পাকিস্তানের খ্যাতিমান ক্রিকেট লিখিয়ে ওসমান সামিউদ্দিন তার ‘দ্য আনকুইট ওয়ানস’ বইয়ে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে টেপ টেনিস ক্রিকেট শুরুর কথা জানান। অনেকে আবার মনে করেন, ১৯৮৬ সালে শারজায় শেষ বলে জাভেদ মিয়াঁদাদেও সেই বিখ্যাত ছক্কার পর পরই টেপ টেনিস ক্রিকেট পৃথিবীর আলো দেখে পাকিস্তানের মাটিতে।
পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার ও পরবর্তীতে আম্পায়ার শাকিল খানের দেয়া তথ্য বেশ চমকজাগানিয়া। টেপ টেনিস ক্রিকেটের জন্মভূমির সন্ধানে আবিদ হুসেইনকে নাজিমাবাদের ‘গল’ মার্কেটে নিয়ে যান শাকিল খান। বিপণন কেন্দ্রটির সামনের রাস্তাটা দেখিয়ে শাকিল খানের মন্তব্য, ‘এখানেই আমি প্রথম টেপ টেনিস বলে খেলেছি। সময়টা সম্ভবত ১৯৭৮।’ টেনিস বলকে প্রথম টেপের আবরণে লুকিয়ে ফেলা ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিগোষ্ঠীর ব্যাপারেও একটা গল্প বলেন শাকিল খান। তবে এর সঠিক কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। পাকিস্তানের সাবেক প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার ও করাচির ‘স্ট্রিট ক্রিকেট’ কিংবদন্তি নাদিম মুসা সে সময় টেনিস বল এমনভাবে গ্রিপ করতেন যে, বলটা দুমড়ে যেত। এর ফলে স্পিন ধরত অস্বাভাবিক। ওসমান সামিউদ্দিনের ‘দ্য আনকুইট ওয়ানস’— বইয়ে নাদিম মুসা জানান, টেনিস বলে প্রথম টেপ প্যাঁচানো রীতির প্রবর্তনে তিনি অংশত দায়ী। সে সময় নাজিমাবাদ কয়েকটি মহল্লায় বিভক্ত ছিল। নাদিমদের মহল্লার সঙ্গে বাকি দলগুলো কোনোমতেই কুলিয়ে উঠতে পারত না, বিশেষ করে ওই জ্যাক আইভারসন মতো গ্রিপিংয়ের জন্য। অস্বাভাবিক স্পিন ধরায় ব্যাট করাটা বিভীষিকার পর্যায়ে চলে যায়। নাদিম মুসার মতে, তাকে ঠেকাতেই নাজিমাবাদ মহল্লার কোনো এক অপেশাদার ক্রিকেটারের মাথায় প্রথম খেলেছিল কৌশলটা— ‘চলো বলে কয়েক পরত টেপ প্যাঁচাই। তাহলে বলটা বেশ শক্ত হবে এবং স্পিন ধরবে কম।’
করাচিতে ‘স্ট্রিট ক্রিকেটে’র রমরমা মৌসুম চলে পবিত্র রমজানজুড়ে। কোথাও মধ্যরাত থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত, আবার কোথাও দুপুর থেকে ইফতার পর্যন্তও উৎসবের আমেজে চলে টেপ টেনিস টুর্নামেন্ট। সেই আশির দশক থেকে নাজিমাবাদের ঈদগাহ ময়দানে চলে আসছে এ ধারা। পেশাদার, আধা-পেশাদার কিংবা পাড়ার ক্রিকেটাররা এসব টুর্নামেন্টে খেলে থাকে জান বাজি রেখে। লোভনীয় অঙ্কের প্রাইজমানির হাতছানিটা কেউ সামলাতে পারে না। পাকিস্তানের গণমাধ্যম ‘নিউজ’-এর প্রতিবেদক ফাইজান লাখানির হিসাব অনুযায়ী, গত বছর প্রায় ১ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি মুনাফা লুটেছে পাকিস্তানের ‘স্ট্রিট ক্রিকেট’। করাচির নানা প্রান্তে একযোগে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় প্রত্যেক রমজানে। এর মধ্যে ঈদগাহ মাঠ এবং নাদিম সারোয়ার পার্কের টুর্নামেন্ট দুটির প্রাইজমানি বাকিদের ছাপিয়ে যায়। চ্যাম্পিয়ন দল পেয়ে থাকে দেড় লাখ রুপি। ৭৫ হাজার রুপি পেয়ে থাকে রানার্সআপ দল। সিরিজ সেরার হাতে তুলে দেয়া হয় মোটরবাইকের চাবি।
সময়ের পালাবদলে করাচির রাস্তাগুলো এখন আরো বেশি ব্যস্ত। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে প্লান্ট বসায় হোন্ডা এটলাস কোম্পানি। তখন শহরটির জনসংখ্যা ছিল কুড়ি লাখের কাছাকাছি। সে সময় আর এ সময়ের একটা তুলনামূলক চিত্র আবিদ হুসেইনের কাছে তুলে ধরেন ইকবাল কাসিম, ‘আমরা যখন রাস্তায় ক্রিকেট খেলতাম, তখন প্রতি চার ওভারে একবার খেলা থামাতে হতো গাড়ির যাতায়াতের জন্য। কিন্তু এখন মাঝে মধ্যে পথচলার সময় দেখি, এক ওভারেই চার থেকে পাঁচবার খেলা বন্ধ হচ্ছে সেই একই কারণে।’
টেপ টেনিস ক্রিকেটের খরচটাও আর আগের মতো থাকেনি। করাচিতে উন্নত মানের তিনটি টেনিস বলের একটি প্যাকেটের দাম পড়ে ৩০০ রুপি। একটা ভালো ব্যাট কিনতে কমপক্ষে ১২০০ রুপি খরচ করতে হয়। তবে যে জিনিসটা স্ট্রিট ক্রিকেটের ‘প্রাণ’— সেই টেপের দামটা কিন্তু থেকে গেছে আগের মতোই। ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানে ইলেকট্রিক টেপ উৎপাদন শুরু করে ‘ওসাকা’। তখন এক প্যাকেটে ওসাকা টেপের দাম ছিল ৩০ রুপি। এখনো ঠিক তাই। এ সময়ে মধ্যে দোর্দণ্ডপ্রতাপে জাঁকিয়ে বসার পর একসময় বাজার থেকে হারিয়ে গেছে ‘নিট্টো’ টেপ।
ইসলাম ধর্মে ‘মক্কা’ একটাই, কিন্তু করাচিতে সেই ধর্মেরই ক্রিকেটমোদীদের কাছে টেপ টেনিস ক্রিকেটের ‘মক্কা’ দুটি— নাদিম সারোয়ার পার্ক আর পোলো গ্রাউন্ড। সদ্দরে গভর্নর হাউজের পেছনেই পোলো গ্রাউন্ড। পুনঃসংস্কারের পর ২০১৩ সালে ২০ একরের এ জমিনটি জনস্বার্থে খুলে দেয়া হয়। পোলো গ্রাউন্ডে কোনো সকাল বিকাল নেই! এমনকি মাঝরাতেও এখানকার রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আপনার কানে ভেসে আসবে সেই উত্তেজক আর্তি— ‘ক্যাচ ইট’! দিনের বেলায় পেশাদার অপেশাদার ক্রিকেটারে গিজগিজ করে জায়গাটি। প্রায় ৫০০ ক্রিকেটমোদীর প্রতি দিনকার ক্ষুধা মেটাচ্ছে এ পোলো গ্রাউন্ড। পাশাপাশি শুয়ে আছে প্রায় ৫০টি ‘বাইশ গজ’। কে কোনো দলের খেলোয়াড়, তা বোঝার উপায় নেই। শুধু কান পাতলে শুনতে পাবেন অসংখ্য ক্রিকেটমোদীর হূদয়ের দাবী— হাউজদ্যাট! (পোলো গ্রাউন্ড)
(পাকিস্তানের সাবেক প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার ও আম্পায়ার শাকিল খান)