অক্টোবরে চিলিতে গড়াবে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ। মোহাম্মদ জাদ্দুকে এখন তাই দেখা যেত সিরিয়ার জাতীয় দলের সঙ্গে। দিনগুলি কেটে যেতো অনুশীলনে। রাত ফুরাত স্বপ্নের ঘোরে। চোখের সামনেই খোলা ছিল ফুটবলের কুঁড়ি থেকে কুসুম হয়ে ফোটার দুয়ার !
কিন্তু এখন, জাদ্দুর দিন থেকে রাত— সারাক্ষণ ঘোর লাগা অপেক্ষার প্রহর। মা আর দুই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে কবে! ‘যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যুর খবর শুনতে পারি’— শঙ্কাটা জাদ্দুর নিজের!
শঙ্কার পাশাপাশি স্বপ্নও আছে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো হয়ে ওঠার স্বপ্ন! পর্তুগিজ তারকার সেই বিশেষ কৌশলটা তার খুব পছন্দের। রুটিনমাফিক প্র্যাকটিস শেষে চর্চা চলে রোজ। পায়ের পাতা থেকে বলটাকে প্রথমে বুকের ওপর; দেখলে মনে হবে আঠা দিয়ে লাগানো! এর পর পেছনে আরো উবু হয়ে গলার ওপর দিয়ে গড়িয়ে মুখ বরাবর। দুই ঠোঁটের ওপর গিয়ে থামে বলটা। তখন জাদ্দুর ব্যালেন্সটা সত্যিই দেখার মতো! পিঠের ওপর গড়িয়ে বলকে ফের পায়ের পাতায় বসানোর আগে চুমু অপরিহার্য। কৌশলটির সফল প্রয়োগ ঘটাতে পারলে জাদ্দুর মুখে হাসি ফোটে।
শুধু সিরিয়া বললে ভুল হবে। জাদ্দু গোটা এশিয়ান ফুটবলেরই ভবিষ্যৎ! তার নেতৃত্বে গত বছর থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে খেলে সিরিয়া। এতে সুযোগ এসে যায় অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে খেলার। কিন্তু গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ঘর হারানো মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৬ মিলিয়ন; যাদের মধ্যে জাদ্দু এখন নিজেও এক আশ্রয়প্রার্থী। সে কারণে আগামীর তারকা যাচাইয়ের মঞ্চে ডানা মেলার স্বপ্নটা যে তার স্বপ্নই থেকে যাবে, তা এখনই বলে দেয়া যায়। ল্যান্ডন ডনোভান, সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, টনি ক্রোসরা এ আসর খেলেই উঠে এসেছেন। সে পথ থেকে বিচ্যুত জাদ্দু এখন স্রেফ একজন শরণার্থী। জার্মানি তার আশ্রয়স্থল। গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে সাড়ে তিন হাজার মাইল পথ। এ যাত্রাটাকে ‘কুসুমাস্তীর্ণ’ ভাবলে ভুল করবেন। সিরিয়া থেকে জার্মানি— মাঝে ভূমধ্যসাগর আর মাইলের পর মাইল সড়কপথ সম্পর্কে জাদ্দুর উক্তি, ‘কীভাবে যে জার্মানিতে এসেছি, তা জীবনে কখনো ভুলতে পারব না। মৃত্যুকে দেখতে হয়েছে খুব কাছ থেকে।’
জাদ্দুর আপাত নিবাস অস্ট্রিয়ান ও সুইস বর্ডার-সংলগ্ন বাভারিয়ান পার্বত্য অঞ্চল। জায়গাটার প্রাচুর্য ঘন পাইনের সারি আর পাহাড়ের নৈসর্গ। এমন জায়গায় মোটামুটি মানের একটি ঘরে গাদাগাদি করে ছয়জনের বসবাস। জাদ্দুর বাবা বিলাল, চাচা জাকারিয়া, জাদু নিজে ও আরো তিনজন সিরীয়; যারা তাদের মতোই প্রাণ হাতে করে পালিয়েছেন দেশ ছেড়ে। এখানে আশ্রিত হওয়ায় জার্মান কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত প্রথম তিন মাসে এলাকাটি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না। সপ্তাহের তিনদিন ফুটবল অনুশীলন করতে জাদ্দুকে তাই আলাদা পাস জোগাড় করতে হয়। র্যাফেনবার্গের ট্রেনিং সেন্টার এখান থেকে ৩০ মাইল দূরের পথ।
অনুশীলনের দিন ছাড়া জাদ্দুর তেমন কোনো কাজ নেই। বাকিদেরও সময় কাটে বেহুদা। জাকারিয়া যেমন ব্যস্ত থাকেন সিগারেট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে! জার্মানিতে সিগারেটের দাম বেশ চড়া। খরচ কমাতে তাই সিগারেটের ভেতরের তামাক প্রথমে বের করে নেন জাদ্দুর চাচা। এর পর কাগজ মুড়িয়ে বানানো সিগারেট থেকে চিকন, কয়েকটি শলাকায় তা ভরে টানেন আরামসে। এভাবে এক সিগারেট খাওয়া যায় কয়েকবার!
লাতাকিয়া সিরিয়ার বন্দরনগরী। এ শহরেই জাদ্দুর বেড়ে ওঠা। জায়গাটা সিগারেটের তামাক উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। তামাক ‘লাতাকিয়া’র নামেই শহরের নাম। জাদ্দুর চাচার সিগারেটপ্রীতির কারণটাও উদ্ঘাটিত! আট বছর বয়সে শহরটিতে স্থানীয় একটি ক্লাবের নজড়ে পড়ে জাদ্দু। হুত্তেন--সিরিয়ান প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব। এরপরই ডাক আসে বয়সভিত্তিক জাতীয় দল থেকে। গৃহযুদ্ধের আগের সে সময়গুলো জাদ্দুর জীবনের সোনালি অতীত। ফুটবলপ্রেমে মজে ছেড়ে দেন স্কুল। ‘ফুটবল খেলাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খেলাটাকে সম্ভবত মা-বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসি’— স্বীকারোক্তি জাদ্দুর।
গৃহযুদ্ধ শুরুর পর জাদ্দুর ফুটবলচর্চা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে সিরিয়ায়। প্রিমিয়ার লিগ চললেও সেটা ছিল নামমাত্র। এর মধ্যে ফিফা নির্দেশ জারি করে, সিরিয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য নিরাপদ নয়। খেলার জন্য তাই দামেস্ক আসতে হতো জাদ্দুকে। পথে বিপদ ঘটেছে বহুবার। দুবার তাদের বাস আক্রমণ করেছে বিদ্রোহীরা। তাদের দাবি, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো দলে খেলা যাবে না। খুনের হুমকি পেয়েছেন বহুবার। তবুও খেলা থামাননি। বোমা পড়েছে অনুশীলনের মাঠে। প্র্যাকটিসের সময় তাই চোখ-কান খোলা রাখতে হতো। এই বুঝি শেল পড়ে! কিন্তু জাদ্দুর জীবনে যুদ্ধের প্রথমে শেলটা সরাসরি আঘাত হেনেছে হূদয়ে।
তারেক ঘারির; জাদ্দুর পেয়ারের ইয়ার। পাশাপাশি রুমমেটও। থাইল্যান্ডে অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে জাদ্দুর নিশ্চিত সতীর্থ। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ একদিন মর্টার শেলের আঘাতে দুজনের মর্ত্যলোকের বন্ধুত্বের ঘুড়িটা কেটে যায়। মাত্র ১৫ বছরের জীবন! তারেকের ছিন্নভিন্ন দেহের একটা ছবি আছে জাদ্দুর মুঠোফোনে। বন্ধুর মৃত্যুতে সে দুদিন ধরে শুধুই কেঁদেছে।
অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে সাসপেন্ড ছিলেন জাদ্দু। ম্যাচটা ৭-১ গোলে জিতে নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। ভগ্ন মনোরথে দেশে ফেরার পর বেশি দিন মন টেকেনি তার। গৃহযুদ্ধের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল সিরিয়া। জার্মানিতে উড়াল দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাদ্দু। ওখানকার লিগে একসময় খেলার স্বপ্ন দেখত সে। কিন্তু সে সময় এয়ারপোর্টে গিয়ে জানতে পারে, গোটা দলই রয়েছে নো ফ্লাই লিস্টে! সিরিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও তখন জাদ্দুকে এড়িয়ে যায়।
পিতৃছায়া হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন জাদ্দুর বাবা। পাচারকারীদের রুট ছিল, তুরস্কের ভূখণ্ড থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি। ১৩ হাজার ডলারের কমতি ছিল। অগ্যতা বাড়িটা বেচে দেন বিলাল। কিন্তু তিনি জানতেন না, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পার হতে গিয়ে মৃতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার!
জাদ্দুদের নৌকার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৭০ ফুট। যাত্রী সংখ্যা ১৫০-এর মতো। ছেলে থেকে বুড়ো, নারী থেকে শিশু। নৌকায় গাদাগাদির শেষ নেই। তুর্কি উপকূল ছাড়ার ৬ ঘণ্টা পর বলা নেই কওয়া নেই, নৌকাটি হঠাৎ করেই ডুবতে শুরু করে! প্রাণে বাঁচতে নৌকার সব ভারী বস্তু তারা পানিতে ফেলে দেয়। এমনকি পোশাকও! রাত জেগে পানি সেচার দায়িত্ব নেয় ছেলেরা। এভাবে কেটে যায় পাঁচ রাত। একপর্যায়ে ইতালীয় সেনাবাহীনি এসে তাদের উদ্ধার করে।
ইতালির অভিবাসী শিবির থেকে বের হয়ে তারা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় ভূখণ্ডে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পৌঁছা যায় মিলান পর্যন্ত। রাত নেমে এলে ঘুমাতে হতো ট্রেন স্টেশনে। এভাবে একদিন এক পাচারকারীর দেখা পেয়ে যায় তিনজন। মিউনিখের শরণার্থী শিবির পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সম্মত হয় সেই পাচারকারী। এজন্য জাদ্দুর বাবাকে খোয়াতে হয় শেষ সঞ্চয়টুকু। মিউনিখের সেই শরণার্থী শিবিরে কিছুদিন কাটানোর পর জাদ্দুর ঠিকানা এখন ওভারস্ট্রফেনের পাইন বনঘেরা সবুজ ভূমি।
প্রতিভা থাকলে তার আলো ঠিকরে বেরোবেই। জাদ্দুর ফুটবল প্রতিভার জেল্লায় মজে যান ওভারস্ট্রফেন শহরের মেয়র তনয়া। তার অনুরোধে জাদ্দুকে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করানো হয় রফেনবার্গ ক্লাবে। ট্রায়ালের ১৫ মিনিটের মাথায় রফেনবার্গের এক খেলোয়াড় তাকে কিনে নেয়ার অনুরোধ করেছিলো কোচের কাছে! কোচ পত্রপাঠ রাজি হয়ে যান। এখন জাদ্দুর পেছনে ছুটছে বুন্দেসলিগার ক্লাবগুলো। এ কারণে রফেনবার্গে আগামী মৌসুমেই জাদ্দুর শুরু, সম্ভবত আগামী মৌসুমই শেষ!
রফেনবার্গের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে প্রতিদিনের চিত্রটা এখন এ রকম— সার বেঁধে অনুশীলন করছে সবাই। রুটিনমাফিক এ অনুশীলনের যবনিকা ঘটে একসময়। সবাই নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলেও যায়। পড়ে থাকে শুধু জাদ্দু। স্ট্রাইকারদের ছুটতে হয় গোলের জন্য। কিন্তু এ কাঁচা বয়সেই জাদ্দুকে গোল করার পাশাপাশি ছুটতে হচ্ছে পরিবারকে যত দ্রুত সম্ভব নিজের কাছে আনার জন্য। খেলোয়াড় হিসেবে জার্মানিতে যদি থাকা-খাওয়ার পাকা বন্দোবস্তটা হয়ে যায়, তাহলে তো ভালোই। ইতালিতে ফেরা যাবে না। ও দেশে পরিবার নিয়ে বাস করা কঠিন। লাতাকিয়ার নরক গুলজারে এখনো পড়ে আছেন জাদ্দুর মা আর দুই ভাই। কোনো অমঙ্গল ঘটার আগেই ওদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য সবার আগে চাই ক্লাব আর খেলা। পায়ের নিচের মাটিটা তাহলে আরেকটু শক্ত হয়। এ আশা নিয়ে বেঁচে থাকা জাদ্দুকে এখন তাই দেখা যায় সবার শেষে অনুশীলনের মাঠ ছাড়তে। তার আগে রোনালদোর ট্রিকটা একবারের জন্য কসরত করে নিতে তার কখনই ভুল হয়নি। পায়ের পাতা থেকে বুকে, তার পর গলার ওপর দিয়ে বল গড়িয়ে গন্তব্য দুই ঠোঁট। চুমুর পর চুমু! সেই দুটি ঠোঁট দিয়ে; যার গহিনে লুকানো স্বপ্নকে জাদ্দু বলে দেয় অকপটে— ‘কপালে লেখা থাকলে একদিন তার (রোনালদো) চেয়েও ভালো খেলোয়াড় হতে পারি।’ [img|http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/Nasiruits/Nasiruits-1438335459-f0996eb_xlarge.jpg