কমল বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । কিছুটা দূরের বাড়িটার বারান্দার রেলিং-এ তিনটা কাক বসে আছে । একটা ছোট বাচ্চা এসে হাত নাড়তেই কাক তিনটা উড়ে গিয়ে বসলো রাস্তার উপরে ঝুলানো একটা তারে । কাক তিনটা ঐ তারে বসার প্রায় সাথে সাথেই দুইটা কাক উড়ে গেল । আর কমল অবাক হয়ে দেখতে লাগলো তৃতীয় কাকটাকে । কাকটা কিছুক্ষণ কেঁপে তার থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে । কমল লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেল । কমল দেখল কাক আর তিনটি নেই । আরও অনেকগুলো কাক ঐ কাকটাকে ঘিরে উড়ছে আর "কা কা" ডাকছে । সেই "কা কা" ডাকে মুহূর্তের মধ্যেই চারদিক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে । আর ঐ উত্তেজনা যেন কমলকেও পেয়ে বসেছে । প্রতিটি "কা কা" ডাক বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কমলের মাথায় । হঠাত মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল ওর , তীক্ষ্ণ ব্যথা । যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে । আর তাকিয়ে থাকতে না পেরে জানালার কাছেই চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো কমল । তারপর নিজের অজান্তেই মেঝেতে শুয়ে পড়লো । জ্ঞান হারাল কমল ।
যখন জ্ঞান ফিরল , কমল তখন বিছানায় শুয়ে আছে । ওর ডানদিকে বিছানা ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে ওর আম্মু আর ডাক্তার আঙ্কেল । ডাক্তার আঙ্কেল কমলকে বললেন ,
- তোমার কি এখনও মাথা ব্যাথা আছে কমল?
কমল মাথা নেড়ে বলল ,
- না আঙ্কেল । কিন্তু আমার কি হয়েছে ?
- আসলে তেমনকিছুই হয়নি তোমার । মাথা ব্যাথা তো একটা সাধারণ রোগ বাবা । কয়েকদিন রেস্টে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে ।
কমল কিছুই বলল না । ও ডাক্তার আঙ্কেলের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল । ডাক্তার আঙ্কেল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,
- আমি এখন যাই বাবা । তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে । ঠিক আছে ?
কমল হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল । ডাক্তার আঙ্কেল মুচকি হেসে চলে গেলেন ।
আজ সতেরো দিন হল এই ঘরের বাইরে পা পড়েনি কমলের । প্রতিটি দিন-রাত কাটে বিছানায় শুয়ে আর বিছানা থেকে দু-কদম দূরত্বে জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে । মাঝে মাঝে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বই পড়ে ও । এভাবে ভালই সময় কেটে যায় । তবুও চৌদ্দ বছর মুক্ত জীবনের স্পর্শে থাকা একটা কিশোরের জন্য সারাদিন একটা ঘরে আবদ্ধ থাকা মোটেই সহজ নয় । আজ ওর মনে হয় , ঝড়-তুফানে বায়ুস্রোতে গাছগুলোর গা ভাসিয়ে দেয়াটা যেন উদ্ভিদকুলের মুক্ত সচল জীবন লাভের জন্য এক বিন্দু প্রয়াস । গাছের মত কমলও যেন ওর বিছানার সঙ্গে এক অদৃশ্য শেকড় সম্পর্কে আটকে আছে । কোনোভাবেই ছিন্ন করা যাচ্ছেনা এই সম্পর্কটা ।
কমল বুঝতে পারে , আর বেশীদিন ও থাকবেনা এই ঘরে । কিছুদিন পরই ওকে সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখে আসা হবে এক অন্ধকার ঘরে । যদিও কেও ওকে এই সম্পর্কে কিছু বলেনি এ সম্পর্কে , তবু বুঝতে পারে ও । মা যখন রান্নাঘরে ক্রন্দন পর্ব শেষ করে চোখমুখ মুছে , খাবার নিয়ে কমলের ঘরে আসে , মায়ের চোখের কোনের এক বিন্দু অশ্রু ওর চোখের আড়াল হয়না । কমল তখন নিজ হাতে ওর পাশে বসা মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ,
- কাঁদছ কেন মা ? দেখো , সব ঠিক হয়ে যাবে ।
মা কিছু বলেনা । ছেলের মুখের আশার বাণীতে নিজেকে মনে মনে শক্ত করার চেষ্টা করে মা । কিন্তু যখন ছেলের কোমল , মায়াবী শ্যামা বর্ণের চেহারার দিকে চোখ যায় , মা তখন নিজের মনকে থামিয়ে রাখতে পারলেও , নিজের চোখকে আর থামাতে পারেনা । ঝরতে থাকে অবিরাম জলধারা । ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মা তখন শব্দ করে কাঁদতে থাকে । আর এই কান্না-ই কমলকে জানিয়ে দেয়- কিছুই আর ঠিক হবেনা । সময়ের সাথে ঘনিয়ে আসছে এক রাত্রি । বিশাল সে রাত্রি । অসীম শূন্যতায় , অসীম অন্ধকারাচ্ছন্ন সে রাত্রি । যে রাত্রির শুধু শুরু আছে , শেষ নেই ।
রাত তিনটায় হঠাত ঘুম ভেঙে গেল কমলের । নিচু ভলিউমে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে পাশের বাড়ির শ্যামা আন্টিদের বাসা থেকে ।
" কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে-
আমরা পেয়েছি ভাই মানব জনম।
এ জনম চলে গেলে-
আর পাবো না না না,
আর মিলবে না।
তাই হৃদমাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেবনা। "
গানের কথাগুলো ভালো অনুভূতির সৃষ্টি করে । কমল বিছানা থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । আকাশে হলদে চাঁদ দেখা যাচ্ছে । ওর মনে পড়ে গেল রেশমির কথা । রেশমি বলেছিল ,
- শোন কমল , চাঁদহীন আকাশ কপালে টিপবিহীন রূপবতী নারীর মতই সুন্দর , আমার আপু বলেছে ।
- হ্যা । ঠিক এখন টিপ ছাড়া তোকে যেমন লাগছে তেমন ।
রেশমি অনেক হেসেছিল কমলের এই কথাটা শুনে । রেশমি এখন দিনাজপুরে । আর এক বছর আগের কথা ,রেশমির বাবার বাস দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর ওরা কলোনি ছেড়ে চলে যায় গ্রামের বাড়ি । কমল কখনোই ভাবতে পারেনি রেশমি এতোটা দূরে চলে যাবে । চলে যাবার আগের দিন রেশমি এসেছিলো কমলের কাছে । এসে চুপচাপ কমলের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল । কমল সেদিন কিছুই বলতে পারেনি রেশমিকে । শুধু তাকিয়ে ছিল ওর দিকে । রেশমি কখন কেঁদে ফেলে , এই ভেবেই কমল কিছু বলেনি সেদিন রেশমিকে । কিন্তু কোন কাজ হয়নি । কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই কমলকে অপ্রস্তুত করে রেশমি শব্দ করে কান্না শুরু করে । তারপর কমলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কাঁদতে কাঁদতে প্রায় দৌড়িয়ে রেশমি চলে গিয়েছিল সেদিন । এটাই ছিল রেশমির সাথে কমলের শেষ দেখা ।
ভাবতে ভাবতে কমলের মনোযোগ আবার গানের দিকে গেল । এখনও রবীন্দ্রসংগীত বাজছে , তবে আগেরটা না , অন্য আরেকটা । "ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো,তোমার মনেরও মন্দিরে ।" এটা কমলের প্রিয় গান । এই গানটা ওর বাবারও প্রিয় ছিল , কমল ওর মায়ের কাছ থেকে শুনেছে । বাবাকে দেখেনি কমল । ওর জন্মের আগেই ওর বাবা মারা যায় । বাবা ছিলেন নৌবাহিনী কর্মকর্তা । নৌবাহিনীর সাদা পোশাকে ওর বাবার একটা ছবি ঝুলানো আছে ড্রইং রুমে । কমলের মনে হয় , ওর মায়ের মত দুখিনী আর কেও নেই । ও জানেনা কি হয়ছে ওর । তবে এটা জানে ওর জীবনস্রোত অত্যন্ত দ্রুত মৃত্যু অভিমুখে প্রবাহিত হচ্ছে । কমল ওর মায়ের শেষ সম্পদ । কমল না থাকলে কি নিয়ে বাঁচবে মা !
কমল বিছানায় শুয়ে পড়ে । ওর আর ভাবতে ভালো লাগছে না । মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে আবার । বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কমল । চাঁদটা এখন আর দেখা যাচ্ছেনা । হঠাত ওর সামনে পুরো আকাশ জুড়ে রেশমির চেহারা ভেসে উঠল । কমল অবাক হল । চাঁদবিহীন আকাশ আজ সত্যিই তাহলে টিপবিহীন রেশমির রুপ নিল ! কমল অস্থির হয়ে পড়লো । ওর মাথা ব্যাথা বাড়ছে । ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হচ্ছে ব্যাথা । কমলের মনে হল , ও আজই মারা যাবে । কমল ওর মা-কে ডাকতে চাইল । কিন্তু ডাকতে পারছেনা । কোন শব্দ বের হচ্ছেনা কমলের মুখ দিয়ে । কমল শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ডাকতে চাইল । কিন্তু কোন ফল পেলনা । তখন কমল সামনে ওর বাবাকে দেখতে পেল । সাদা পোশাকে বাবা কমলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । তবে এই সাদা পোশাকটা নৌবাহিনীর সাদা পোশাক না । একটা সাধারণ সাদা কাপড় , পেঁচিয়ে রেখেছে কমলের বাবাকে । সেই কাপড়ে মুখটা ছাড়া বাবার শরীরের সমস্ত অঙ্গ ঢাকা পড়ে আছে । বাবা কমলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
- তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা ? এই দেখো , বাবা এসে পড়েছি তোমাকে নিতে । আর কোন কষ্ট হবেনা তোমার । এসো বাবা , এসো আমার সাথে । আমরা ঐ আকাশে মিলিয়ে যাব ।
কমল দেখল , যেটাকে বাবা আকাশ বলছে সেটা আকাশ না । সেটা রেশমির মুখ । টিপ ছাড়া , ফরসা একটা মুখ । সেই মুখটাও যেন বারবার কাছে ডাকছে কমলকে । "এসো কমল,এসো!কি হল কমল?দেরি করছ কেন?আসবে না তুমি তোমার রেশমির কাছে?
কমল এখন আর ওর আম্মুর কথা মনে করতে চাইল না । ওর বাবার সাথে ও ঐ চাঁদহীন আকাশটায় মিলিয়ে যাবে বলেই ঠিক করলো । তারপর ঘুমিয়ে গেল কমল , চিরতরে ঘুমিয়ে গেল । ওর মা-কে না বলেই ঘুমিয়ে গেল !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৯